আলাউদ্দিন খিলজির জন্ম ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। বীরভূমে। জাতিতে তুর্কি। তুর্কি আমলে ভারতে দিল্লি সালতানাতের যে ভিত্তি নির্মাণ হয়েছিল, সুলতান খিলজির হাত ধরে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। ১২৯৬ সালে চাচা জালালুদ্দিন খিলজির পরে আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লির মসনদে বসেন। গোটা ভারতবর্ষে শক্তিশালী শাসনের তিনিই ছিলেন অগ্রপথিক। তিনি একের পর এক রাজ্য জয় করেন অথবা কর দেওয়ার শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য করেন। ১২৯৭ সালে গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, ১৩০১ সালে মেওয়াতের রাজা রতন সিং, ১৩০৩ সালে চিতোর এবং ১৩০৫ সালে মালব বিজয় করেন।
ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা ঠিক রাখতে আলাউদ্দিন খিলজি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। সামরিক বিভাগে ব্যাপক সংস্কার আনেন। পদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সৈনিক ও কর্মকর্তাদের বেতন নির্ধারণ করেন। বাজারদর নিয়ন্ত্রণের জন্য জিনিসপত্রের দর বেঁধে দেন। যাতে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম নিয়ে মুনাফা করতে না পারে। মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন। সামরিক বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গোয়েন্দা বিভাগ চালু করে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আমলাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর বেশ নজরদারি করতে শুরু করেন। যাতে কোনোভাবেই বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠতে না পারে। (তারিখে ফারিশতা : আলাউদ্দিন খিলজি অধ্যায়)।
তিনি এই বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে বেশ শক্তিশালী ছিলেন। খুব শক্ত ভিত্তির ওপর তিনি তার সাম্রাজ্য দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন এবং তাতে সফল হয়েছিলেন। মধ্যযুগের তিনিই প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি জমিজমার জরিপ করিয়েছিলেন, জায়গির প্রদান ও ভূমিদান প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়ে ছিলেন। রাজস্ব কর ধার্য করে বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। বাজারদর ও বাজারনীতি প্রবর্তন করে তাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাতে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা সম্ভব হয় এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারে। এতে ব্যবসায়ীরা তার প্রতি মনঃক্ষুণ হলেও সাধারণ মানুষ তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। ভারতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক গোলাম আহমদ মর্তুজা লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন খিলজির শাসনযোগ্যতা ও কর্তৃত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্বার্থপরতার কারণে তার ব্যক্তি চরিত্রে কিছুটা কালিমা লেপন হয়েছিল।’ (ইতিহাসের ইতিহাস : ১৫৮ পৃষ্ঠা)।
ব্যক্তি আলাউদ্দিন খিলজিকে নিয়ে আরও বিভিন্ন যে অপবাদ দেওয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো তিনি হিন্দুদের ওপর নির্মম অত্যাচার করতেন। এর উত্তরে ইতিহাসবিদ ড. ঈশ্বরী প্রসাদ লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন হিন্দুদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছিলেন বলে যে তথ্যটি প্রচার করা হয় তা সত্য নয়।’ (মেডিভাল ইন্ডিয়া : ২০৮ পৃষ্ঠা)।
আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন একজন সফল শাসক। ড. উত্তরণ দাশগুপ্ত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘২০ বছর শাসনকালে মঙ্গোলদের আক্রমণ কমপক্ষে ছয়বার সফলভাবে নস্যাৎকারী এই শাসক ছিলেন তার সময়কালে একজন অতি বুদ্ধিমান ও মার্জিত শাসক।’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যা)। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মোট ছয়বার ভারতবর্ষকে বর্বর তাতারদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। এ জন্য ভারতের বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের তার ওপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তাতারদের আক্রমণে তিনি পরাজিত হলে আজ ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতসহ সারা বিশ্বে মুক্তি পায় বহুল আলোচিত-সমালোচিত চলচ্চিত্র ‘পদ্মাবত’। চিতোরের রানি পদ্মাবতীর জীবন কাহিনি উপজীব্য করে নির্মিত এই চলচ্চিত্র মুক্তির আগেই ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। চলচ্চিত্রে রানি পদ্মাবতী ও রাজা রতন সিংয়ের চরিত্রের অবমাননা করা হয়েছে দাবি তুলে এর প্রতিবাদে মাঠে নামে রাজপুত ও হিন্দুত্ববাদী বেশ কয়েকটি সংগঠন। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কুশপুত্তলিকা দাহসহ আরও নানা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালায় সংগঠনগুলো। এমনকি ভারতের কোথাও এই চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেয় তারা। পরে বিভিন্ন বিচারালয়ের আদেশে পদ্মাবত মুক্তি পায়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং রাজপুতরা তাদের দাবি থেকে সরে আসে। চলচ্চিত্রটি দেখার পর তারা জানায়, প্রতিটি ঐতিহাসিক চরিত্রের সঠিক ও সফল রূপায়ণ হয়েছে চলচ্চিত্রে এবং রাজপুত বা রানি পদ্মাবতী কাউকে এখানে কোনো ধরনের অপমান বা অবমাননা করা হয়নি।
পদ্মাবত চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে দেখানো হয়েছে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিকে। একজন খারাপ চরিত্রকে যতভাবে কল্পনা করা যায়, তার কোনোটাই বাকি রাখেননি পরিচালক। তাকে একজন অত্যাচারী, উভকামী, হিন্দুদের ওপর অত্যাচারী, লম্পট ও বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন একজন শাসক হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমরা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পত্রিকার পাতায় এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ দেখেছি; পড়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, পদ্মাবত মুক্তির আগেই রানি ও রাজপুতদের অবমাননার অজুহাত তুলে হিন্দু ও রাজপুতরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে; কিন্তু সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্র বিকৃত করে তাকে একজন হিংস্র মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করার কারণে ভারতের সহনশীল মুসলমানদের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো প্রতিবাদ আসেনি, যা সবাইকে বেশ অবাক করেছে।
১৫৪০ সালে মালিক মুহাম্মাদ জায়াসি রচিত পদ্মাবত নামক এক মহাকাব্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আদিত্য মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তৎকালীন ইতিহাসে রানি পদ্মাবতীর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।’ (আলজাজিরা : ১৬ নভেম্বর ২০১৭)। রানি পদ্মাবতী মালিক মুহাম্মাদ জায়সির একটি কাল্পনিক চরিত্র। পরে আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওল ১৬৪৮ সালে বৌদ্ধ রাজা আমত্য মাগন ঠাকুরের আদেশে এটি অনুবাদ করেন। অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি বলেন, ‘পদ্মাবত মহাকাব্য পরবর্তী সময়ে ভারতে বহুল জনপ্রিয়তা পায় এবং লোককাহিনি হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। হাস্যকর ব্যাপার হলো, এতদিন পরে এসে মানুষ এসব লোককাহিনি সত্য হিসেবে বিবেচনা করছে। আর রানি পদ্মাবতীকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে দাবি করছে।’ (দ্য কাইন্ট : ডিসেম্বর ১৭ সংখ্যা)।
একথা স্পষ্ট, রানি পদ্মাবতী নামে চিতোরের কোনো রানি আদৌ ছিলেন না, যাকে হাসিল করার জন্য আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর আক্রমণ করবেন। আলাউদ্দিন খিলজি পৃথিবীর ইতিহাসের অংশ আর রানি পদ্মাবতী লোককাহিনি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই, তাকে দেখে পাগল হয়ে যাওয়া সুলতানের পক্ষে কীভাবে সম্ভব! ঐতিহাসিকরা প্রায় সবাই বলেছেন, চলচ্চিত্রে আলাউদ্দিন খিলজিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুল ও বানোয়াট।
ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন, চলচ্চিত্রে আলাউদ্দিন খিলজিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বানোয়াট ও ভুল। রাজা রতন সিং চরিত্রটিকে বিনম্র ও বুদ্ধিনাম শাসক হিসেবে দেখাতে গিয়ে তার বিপরীতে আলাউদ্দিন খিলজিকে নিষ্ঠুর ও বর্বর শাসক হিসেবে দেখানো হয়েছে। (এনডিটিভি অনলাইন : ২৫ জানুয়ারি ২০১৮)।
এছাড়াও শান্তনু ডেভিড তার এক কলামে লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন খিলজি কিছুটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলেও এমন লোভী ও লম্পট শাসক ছিলেন না যে, এক নারীর জন্য তিনি কোনো রাজ্যে আক্রমণ করে বসবেন। চলচ্চিত্রটির পরিচালক হিন্দু আর রাজপুতদের খুশি করতে গিয়ে তাকে অত্যন্ত নীচ চরিত্রের দেখিয়েছেন।’ ভারতের ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, হারবান মুখিয়া ও দেবদত্ত পরিষ্কারভাবে মত প্রকাশ করেন, রানি পদ্মাবতীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এটি একটি কাল্পনিক চরিত্র। আর এই চলচ্চিত্রে দেখানো ঘটনাবলির অধিকাংশই বানোয়াট।
কাজেই একটি বানোয়াট কল্পকাহিনি আর চলচ্চিত্রের ওপর নির্ভর করে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির অবদানকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, বা ক্ষেত্র বিশেষে অস্বীকার করে, তারা উদ্দেশ্যমূলক এই কাজ করছে বলেই আমরা মনে করি। কারণ, বানোয়াট একটি মনগড়া উপাখ্যান একজন মানুষের এত অবদান কখনোই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। বরং তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে। কারন তিনি ইতিহাসের একজন মহাবীর।
লেখকঃ Gulam Hasan Afindi