যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেও একটি প্রধান ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে উপাসনার রীতি চালু হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমাদের পূর্বপুরুষদের এতো এতো ঈশ্বর কোথায় গেলো? তাদের জন্মই বা কি করে হয়েছিলো? তাদের ধারণার সৃষ্টিই বা কি করে হলো?
যদি মিশরের কথাই ধরি, তবে বর্তমানে মিশর একটি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সব সময় কি মিশর তা ছিলো? নীলনদের তীর তো ছিলো সবুজে ঘেরা। ৭০০০ বছর আগে থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থেকে আজকের এই বালুময় মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।

ইনানা: মেসোপটেমিয়ার দেবী © ancientart.as.ua.edu
শিকারি ও বর্বর জাতিগোষ্ঠীরা যখন একটু একটু করে সভ্য হতে শুরু করলো, তখন তারা উর্বর ভূমিগুলোতে কৃষিকাজের মাধ্যমে নতুন করে একটি সভ্য জীবনধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। এই শিকারিরা যখন হঠাৎ করে কৃষকে পরিণত হলো তখন তাদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা সমস্ত কিছুতেই এলো বিশাল পরিবর্তন। আগে তারা যা কল্পনাও করে নি, তা নিয়েই তারা গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলো। আর এই গভীর ভাবনা থেকেই জন্ম হলো বিভিন্ন ঈশ্বরের। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি, দুর্যোগ বা ব্যাখ্যাতীত যে কোনো ঘটনার মধ্যে তারা ঈশ্বরকে খুঁজে পেলো এবং নতুন উদ্ভূত এই বিশ্বাস থেকে জন্ম হলো বহুবিধ ঈশ্বরের ধারণার।
তারা তাদের আশেপাশের সমস্ত কিছুর মাঝেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেলো। কারণ তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলো, ঈশ্বর তাদের জীবনধারার স্থিতিশীলতাকে বজায় রাখে এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদেই তারা একটি সভ্য জীবন উপহার পেয়েছে।

হোরাস: সূর্য ও আকাশের মিশরীয় ঈশ্বর © ancientart.as.ua.edu
নিজেদের মধ্যে তারা একটি নেতৃত্বের ধারাও তৈরি করলো, যাকে রাজা কিংবা সম্রাট বলে অভিহিত করা হতো এবং বেশিরভাগ সভ্যতার ক্ষেত্রে এই রাজা কিংবা সম্রাটই তাদের প্রধান পুরোহিত হতেন। মিশরীয়দের ক্ষেত্রে এই নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রধান পুরোহিত বা রাজাকেই ফারাও বলা হতো।

শামাশ: প্রাচীন ব্যাবিলোনিয়ার ঈশ্বর © ancientart.as.ua.edu
ধীরে ধীরে তারা মৃত্যুর বাস্তবতা উপলব্ধি করলো এবং একটা পর্যায়ে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস স্থিত হলো যে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা চিরন্তন রূপ লাভ করে। মিশরীয়রা এই চিরন্তন পবিত্র আত্মাকে বহনকারী দেহ, অর্থাৎ মানুষের দেহকে মৃত্যুর পরেও সংরক্ষণের জন্য এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করলো। কারণ তারা এই পবিত্র আত্মা বহনকারী দেহকে বিনষ্ট করতে চাইতো না। নিজেদের পরিধেয় কাপড় ধোয়ার জন্য তারা ব্যবহার করতো এক ধরনের সোডা। নিজেদের দাঁত পরিষ্কার রাখার জন্য তারা ব্যবহার করতো আরেক ধরনের ব্রেড সোডা। এই দুটোকে একত্রে মিশিয়ে তারা তৈরি করতে সক্ষম হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভূত ও আশ্চর্যজনক রাসায়নিক মিশ্রণ, যার মাধ্যমে কোন প্রাণীদেহকে আদ্রতামুক্ত করে শুষ্ক ও হাজার বছরের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব। এই পদ্ধতির নামই হলো মামিফিকেশন বা মমিকরণ।

আটেন: মিশরের একেশ্বরবাদী ঈশ্বর © ancientart.as.ua.edu
মমিকরণ পদ্ধতি মিশরীয়দের জন্য ছিলো সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার। এর মাধ্যমে পরজন্মের সুরক্ষিত কোডটিকে মিশরীয়রা ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলো। দুই ধরনের লবন থেকে তৈরি এক অদ্ভূত ও চমকপ্রদ রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে মিশরীয়রা এক অনন্য ভূমিকায় বিশ্বে অধিষ্ঠিত হলো। এরপর থেকে মৃত ব্যক্তিও বিভিন্ন সভ্যতার জন্য পরিণত হলো দেবতা বা ঈশ্বরে। অসংখ্য ঈশ্বরের এই ধারণা শুধু বিশ্বাসেই সীমাবদ্ধ রইলো না। এগুলোর প্রতিফলন ঘটলো প্রাচীন সভ্যতার নির্মিত বিভিন্ন স্থাপত্যকলা ও শিল্পেও। কতোশত ভাস্কর্য, পিরামিড, মন্দির, সমাধি, প্রাসাদ নির্মাণের মাধ্যমে প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে! আমাদের মাঝে জগতের বিস্ময় সৃষ্টি করে এখন পর্যন্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সে সব স্থাপত্য এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিস্ময় তৈরিও করছে এরা।

নারাম-সিন: সুপ্রাচীন আক্কাদিয় সভ্যতার ঈশ্বর © ancientart.as.ua.edu
কালের আবর্তে এসব ঈশ্বরেরাই ধীরে ধীরে মানবাকৃতিতে মানুষের বিশ্বাসে স্থিত হলো এবং মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-ভাবনায় আবারো বিস্তার পরিবর্তন আসতে লাগলো। পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান এই ধারাই মানুষকে সভ্য থেকে সভ্যতর করে তুললো এবং এক পর্যায়ে বিভিন্ন ঘটনাবলি ও বিবেকের তাড়ণা থেকে মানুষের মনে বহু ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাটি ক্রমশই হ্রাস পেতে লাগলো, যা আমাদেরকে আজকের দিনের অধিকাংশ ধর্মমতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধারণায় স্থিত করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পুরনো ঈশ্বরের ধারণাগুলো বর্তমানে বিভিন্ন হিরোইক গল্প ও মিথে পরিণত হয়েছে।