নামটির সঙ্গে সকলেই আমরা কম বেশি পরিচিত। আজকের সমাজের টালমাটাল অবস্থা ও মানুষের মূল্যবোধ যেখানে তলানিতে ঠেকেছে, সেখানে এই মানুষটির দর্শন ও চিন্তাধারা নিয়ে আরও একবার গভীরে গিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন দরকার। চীনের একজন পিলার ও দার্শনিক কনফুসিয়াস খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর লু প্রদেশের ছুফু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে ওনার নাম ছিল কঙ ফু তজু। মায়ের নাম হান ঝোংও বাবার নাম কং হি। কনফুসিয়াস ওঁর সম্মানসূচক উপাধি।
চীনের অধিকাংশ মানুষ এখনও ওঁর মতবাদ ও দর্শনকে পথচলার অঙ্গ হিসেবে মেনে চলেন। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন কনফুসিয়ান তত্ত্ব বা কনফুসীয়বাদের প্রতিষ্ঠাতা। চীনের বর্তমান সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই মতবাদ। শুধুমাত্র চীনের গণ্ডী নয়, আশপাশের দেশগুলিতেও সমানভাবে এই তত্ত্বের প্রভাব পড়েছিল।
অন্ত্যত দারিদ্র্যের মধ্যে শৈশব অতিবাহিত হয় কনফুসিয়াসের। ৩ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহারা হন। কৈশোরেই উপার্জনের পথে নেমে পড়তে হয়। কখনো মেষপালক, কখনো কেরানিগিরি, কখনো লাইব্রেরির চাকরি আবার কখনও শহরের উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের কাজের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরই মধ্যে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। ১৯ বছর বয়েসে বিয়ে করেন, নাম কিগুয়ান। এক বছরের মধ্যেই সন্তান, কং লি জন্ম নেয়। ২৩ বছরে মাতৃহারা হন তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধার অধিকারী। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও সকল বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান, জানার আগ্রহ ও অল্প বয়েসেই ধর্ম, দর্শনে পাণ্ডিত্য ওনাকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছিল। নিজের ছাত্রদের ছয়টি বিদ্যার ওপর জোড় দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। ধনুর্বিদ্যা, হস্তলিপি, হিসাববিদ্যা, সঙ্গীত, রথচালনা ও সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষা দিতেন তিনি। ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে সকলেই আসতে লাগলেন কনফুসিয়াসের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে। তাঁর উদ্যোগে নীচু জাতির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করার সুযোগ পান। সামান্য কিছু খাবার ও অন্য যেকোনো দ্রব্য ছিল ওনার পারিশ্রমিক।
সেই সময় জনগণের অবস্থান অনুযায়ী তাঁদের পেশার শ্রেণীবিন্যাস হত। সামাজিক অবস্থান ও জ্ঞানের কারণে তিনি ছিলেন শী শ্রেণীভুক্ত। এই শ্রেণী বিদ্বান হিসেবে সম্ভ্রান্ত ও শাসক শ্রেণীর সাথে মেলামেশা করতে পারতেন। সেই সময় ‘চি চি’ ছিলেন লু প্রদেশের শাসক। কনফুসিয়াসের প্রবল জ্ঞানের কথা তিনি জানতে পারেন এবং আহ্বান জানান সভায়। প্রথম পরিচয়েই চি চি ওনার জ্ঞানের পরিধি পরখ করে মুগ্ধ হন এবং হিসাবরক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। কর্মদক্ষতায় একে একে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হতে থাকেন। কিন্তু তাঁর চর্চা থেমে থাকেনি। চারপাশের জ্ঞান আরোহণ করতে বেরিয়ে পড়তেন দিকে দিকে। যেখানে যা পুঁথি পেতেন, খুঁটিয়ে পড়তেন ও অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বার করতেন। এই সময় তিনি অনুভব করেন চীনের নানাদিকে দরিদ্র শ্রেণীকে শুধু বঞ্চিত হতে হয় বণিক ও শাসক শ্রেণীর হাতে। দেশজুড়ে অভাব অনটন ও নৈতিক অধঃপতন। কোনোভাবেই কেবল আইন এই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তিনি তাই তাঁর নীতিবোধ ছড়িয়ে দিতে লাগলেন ছাত্রদের মাধ্যমে।
লু প্রদেশের আইনরক্ষকের পদে আসেন ৫২ বছর বয়সে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে শুধু আইন নয়, মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি দরকার। তিনি নিজেই আইন প্রণয়ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নীতিবোধ বিষয়ক উপদেশ দিতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই কর্মচারীদের মধ্যে চারিত্রিক উন্নতি দেখা দিল। ধীরে ধীরে প্রায় সকল জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো ওঁর ভাবধারা। সমগ্র চীন দেশের মধ্যে একমাত্র লু প্রদেশ হয়ে উঠলো নিরাপদ এক জায়গা। চুরি, ডাকাতি, খুন উধাও হল রাতারাতি। পর্যটকরা সারারাত ঘুরে বেড়াতে পারতেন কোনরকম ভয় ভীতি ছাড়াই। অচিরেই লু প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের নির্দেশ পান তিনি।
মানুষকে যিনি ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন তিনি কনফুসিয়াস। বিচারক হলেও মানবিক হতে যিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি কনফুসিয়াস। সমস্ত ধর্মের মানুষকে ভালোবাসা, মানুষকে বিশ্বাস করা, হিংসা না করার বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে এসেছেন তিনি রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে। ৪৭৯ সালে ৭১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কুফু নগরীর কাং লি সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়। আজীবন তিনি বলে গেছেন, “জীবন সত্যিই সহজ, কিন্তু আমরা একে জটিল করে তুলি।”
লেখা – Sunanda Dhali
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel