রবীন্দ্রনাথের বিয়ে প্রসঙ্গে কিছু মজার ঘটনা আছে। তার বিয়ের বয়স নাকি হু হু করে গড়িয়ে যাচ্ছিল। ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘রবিকাকার বিয়ে আর হয় না।’ বিয়ে হয় না কেন এমন সুপুরুষ মানুষটির? অনেক মেয়ে দেখা হলেও কুল গোত্র মিলিয়ে পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। পূর্বপুরুষেরা পিরালি ব্রাহ্মণ বিধায় অন্য শ্রেণির মানুষেরা তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান না। অবশেষে জ্ঞানদানন্দিনীর পৈতৃক বাড়ি যশোরের (বর্তমানে খুলনা) নরেন্দ্রপুরে পাত্রীর সন্ধানে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী ও জ্ঞানদানন্দিনী। সেই সময় ফুলতলা গ্রামে বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীকে তারা দেখেন। পাত্রী দেখা সম্পর্কে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ- ‘‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই।
বৌঠানরা যখন বড়োবেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন আমি বললুম, ‘তোমরা যা হয় কর, আমার কোনো মতামত নেই। তারাই যশোরে গিয়েছিলেন, আমি যাই নি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারি এস্টেটের বেতনভুক্ত কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মামাবাড়িও একই গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন দক্ষিণডিহির অধিবাসী রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা সারদা দেবীকে, যেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগের পাঁচ পুরুষও এই গ্রামে বিয়ে করেন। কারণ, এ এলাকাতেই তখন ঠাকুর পরিবারের সমগোত্র পীরালি ব্রাহ্মণদের বসবাস ছিল। ২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ, রবিবার, ইংরেজি ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বেণীমাধব রায় চৌধুরী ও দাক্ষায়নী দেবীর একমাত্র কন্যা ভবতারিণী দেবী ওরফে ফুলি ওরফে ফেলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়। বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস ২ দিন আর ভবতারিণীর বয়েস সবে নয় বছর ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মামা নিরাঞ্জন রায়চৌধুরী ও হিরণ্ময় রায়চৌধুরীর মাধ্যমে কন্যাহ্বানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়। ঠাকুরবাড়ির প্রথানুযায়ী বিয়ের পর ভবতারিণী দেবীর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।
পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য পাত্রীর পিত্রালয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে কন্যাহ্বানের নিয়মানুযায়ী পাত্রীকে পাত্রের বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রীপক্ষ সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন। বেণীমাধব রায়চৌধুরী আত্মীয় স্বজনসহ কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এ জন্য কন্যা পক্ষের পাথেয় খরচ বাবদ ষাট টাকা, বাড়ি ভাড়া বাবদ বাইশ টাকা তিন পাই খরচ বহন করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার ক্যাশ বইয়ে সে হিসাব রয়েছে। সেই ক্যাশ বইয়ের হিসাবে আরো জানা যায়, বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রও ছাপা হয়েছিল এবং ডাকযোগে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন নিজের হাতে লেখা একটি বিচিত্র রকমের পত্র লিখে। নিমন্ত্রণপত্রটি হুবহু এরকম:
‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি
– অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
মহর্ষি তখন হিমালয়ে। কবির মা সারদা দেবীও গত হয়েছেন।খুবই ঘরোয়া আর অনাড়ম্বর ভাবে তাঁদের বিয়ে হল। ঠাকুরবাড়ির বিয়েতে একটা বেনারসি শাল গায়ে দেবার চল ছিল। রবীন্দ্রনাথ সেটিই গায়ে দিলেন।জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ের ঘরে এলেন। ব্যাপারটা এমন যেন অনেক দূর থেকে অনেক ঘুরে বর এলেন কনেকে নিয়ে যেতে।পিঁড়ির উপর দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে বরণ করা হল। কনেকে সাতপাক ঘুরিয়ে করা হল সম্প্রদান। এই ছোট্ট অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়েই মৃণালিনী এলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। বিয়েতে জমাটি বাসরও হয়েছিল। বাসরঘরে নতুন বৌকে স্বরচিত ও সুরারোপিত গানও শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আ মরি লাবণ্যময়ী/কে ও স্থির সৌদামিনী…।’ মৃণালিনীরা শুধুমাত্র পিরালি ব্রাহ্মণ ছাড়া সামাজিক, আর্থিক, আধ্যাত্দিক কোনো দিক থেকেই অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তুলনীয় ছিলেন না। তবে ঠাকুর পরিবারের উপযুক্ত করে মৃণালিনী গড়ে তুলেছেন নিজেকে। বিয়ের পর দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে পড়াশোনার জন্য লরেটো হাউসে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। ইংরেজি শেখার জন্য খোদ মেমসাহেব শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হয়। মৃণালিনী জীবিত ছিলেন ঊনত্রিশ বছর। তাঁদের ব্যস্ত, অভাবী বিবাহিত জীবন ছিল উনিশ বছরের।