আধুনিক যুগের পাকিস্তান দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কথা প্রায়ই শুনা যায়। দেশটির সামরিক বাহিনীর মর্জির উপর অনেক রাষ্ট্রপ্রধান নিজেদের মসনদকে নিজেদের ভাবার সুযোগ পেতেন। তাদের আক্রোশে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান পদও খুইয়েছেন। ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠার আরেক উদাহরণ দেখা যায় মধ্যযুগের ভুবনবিখ্যাত সাম্রাজ্য অটোমান সালতানাতে। ইউরোপের এই এলিট ফোর্সের নাম জেনিসারি। যারা সমকালীন সময়ে অপরাজেয় এক পদাতিক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা আর সামরিক আচরণে তাদের এক অদ্বিতীয় বাহিনী হয়ে উঠার গল্প রোমাঞ্চকর। অনেক যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার প্রমাণ দিয়ে তারা হয়ে উঠেছিল অটোমান সালতানাতের প্রতিরক্ষার ত্রাণকর্তা। অটোমান সুলতানদের প্রিয় এই বাহিনীর গল্পটা অনেকটা শেক্সপিয়রের নাটকের মত। চলুন তাদের কাহিনী শুনা যাক।
অটোমান তার্কিশ শব্দ ইয়েনি চেরি (যার অর্থ নতুন সৈন্য’) থেকে জেনিসারি নামটির উৎপত্তি। প্রথম দিকে এই পদাতিক বাহিনীর কাজ ছিল সুলতানের নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু ক্রমেই এই বাহিনীকে সংস্কার করে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। অটোমান সুলতান প্রথম মুরাদের (১৩৬২-৮৯) আমলে এই বাহিনী তার যাত্রা শুরু করে। আলবেনিয়া ও গ্রিস থেকে খ্রিস্টান কিশোররের জোরপূর্বক ধরে এনে তুর্কি পরিবারে এদের রাখা হতো। কঠোর প্রশিক্ষণ আর পড়ালেখার মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামি ও তুর্কি সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত করা হতো। এক পর্যায়ে তাদের সৈনিক হিসেবে মূল প্রশিক্ষণ দিয়ে সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হতো। জোর করা খতনা করিয়ে তাদের খোজাদের তত্ত্বাবধানে রাখা হতো। প্রথম দিকে আলবেনিয়া ও গ্রিস থেকে খ্রিস্টান শিশুদের ধরে নিয়ে আসলেও এক পর্যায়ে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাংগেরি, দক্ষিণ রাশিয়া থেকেও তাদের নিয়ে আসা হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর জেনিসারি বাহিনীই ছিল ইউরোপের সুপ্রশিক্ষিত ও স্থায়ী পদাতিক বাহিনী। ভার উত্তোলন, রেসলিং, রোদে দাঁড়িয়ে থাকা, মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।খ্রিস্টান কিশোররা যখন প্রশিক্ষণের পর বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত তখন সুলতানের নামে তাদেরকে আনুগত্যের শপথ করতে হতো। পরিবার ফেলে আসা এসব সৈন্যদের সুলতানই ছিলেন সব।প্রশিক্ষণ শেষে দক্ষতা অনুযায়ী কাউকে পদাতিক, কাউকে গোলন্দাজ, তীরন্দাজ ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে নিয়োগ দেয়া হতো। যুদ্ধকালীন সময় বাদে জেনিসারিরা পৌরকেন্দ্রিক দায়িত্বও পালন করত। কখনো পুলিশ হিসেবে, আবার কখনো দমকল কর্মী হিসেবেও তাদের দেখা যেত।
জেনিসারিদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল, নিষিদ্ধ ছিল দাড়ি রাখাও। সবসময় ব্যারাকে অবস্থান করতে হতো তাদের। তাদেরকে উচ্চ বেতন দেয়া হতো। পেনশনের ব্যবস্থাও ছিল। এমনকি মাঝে মাঝে সুলতান স্বয়ং জেনিসারি সৈন্যদের বেতন গ্রহণের সময় নিজের বেতনও গ্রহণ করতেন। ফলে সৈন্যদের মাঝে সুলতানের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পেতো। জেনিসারি সৈন্যদের পোশাক ছিল অন্য বাহিনী থেকে আলাদা। জেনিসারী কমান্ডারকে বলা হত Soup cook. তাঁকে এক বিশেষ আদলের সামরিক পোশাক পরতে হত যার হাতা ছিল তুলনামূলক লম্বা। তারাই সর্বপ্রথম মিউজিকাল ব্যান্ড বা সামরিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করে। ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জেনিসারিরা bork নামের এক বিশেষ শিরস্ত্রাণ পরিধান করত। এই শিরস্ত্রাণের সম্মুখভাগে আবার থাকত ‘ভ্রাতৃত্বের চামচ’। এর প্রতীকী অর্থ ছিল এমন, যেসব জেনিসারি সৈন্য জীবন দিয়েছে, যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে তারা সবাই ভাই ভাই। জেনিসারিদের ব্যাটালিয়নকে বলা হতো অরটা। তিনটি উপ-বিভাগে বিভক্ত ছিল তারা। প্রথম বিভাগটির নাম ছিল সিমাট। যেটি প্রায় একশোরও বেশি ব্যাটালিয়ন পরিমাণ সৈন্য নিয়ে গঠিত ছিল। দ্বিতীয় বিভাগটির নাম ছিল বেইলিক। এরা ৬১ টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল। আরেকটি বিভাগ ছিল সেকবান যা ৩৪ টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল। সুলতান ছিলেন জেনিসারি বাহিনীর সার্বভৌম কর্তা। প্রথম দিকে বলকান অঞ্চল ও ইউরোপের অন্যান্য বিজিত অঞ্চল থেকে জোর করে খ্রিস্টান কিশোরদের ধরে নিয়ে আসলেও ধীরে ধীরে খ্রিস্টান পরিবারদের মধ্যে নিজ সন্তানকে জেনিসারি বাহিনীতে দেয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
যদিও জেনিসারি বাহিনী অটোমান সালতানাতের প্রধান সামরিক শক্তি ছিল না তবুও সুলতানগণ তাদের উপরই আস্থা রাখতেন বেশি। এই বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই জেনিসারিরা অংশ নেয়। জেনিসারি বাহিনী অগ্রবর্তী অশ্বারোহী সেনাদলের পেছনে থেকে যুদ্ধে অংশ নিতো। যুদ্ধের কৌশলের অংশ হিসেবে যখন অশ্বারোহীরা পশ্চাৎপদ হওয়ার ভান করত তখন জেনিসারিরা মধ্যভাগের দায়িত্ব নিত। জেনিসারি বাহিনীতে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী এবং তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত ছোট ছোট বিশেষজ্ঞ সৈন্যদল ছিল। প্রকৌশলীরা দুর্গের প্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করে দুর্গ দখল করতে অন্যদের সাহায্য করতো।
কথিত আছে, একেকটি জেনিসারি এতোটাই হিংস্র ছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্রে হাত বা পা ছিটকে গেলেও তারা অবশিষ্ট অঙ্গ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতো। কসোভোর যুদ্ধ, চালদিরানের যুদ্ধ, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কনস্ট্যান্টিনোপল দখলে জেনিসারি বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ক্রুসেডের এক যুদ্ধে ইউরোপীয় জোটের কাছে প্রায় হারতে বসেছিল অটোমান বাহিনী৷ ইউরোপীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হাঙ্গেরির রাজা৷ ইউরোপীয় সৈন্যরা যখন তুর্কি বাহিনীকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল ঠিক তখনই নজিরবিহীন যুদ্ধশৈলী প্রদর্শন করে জেনিসারি বাহিনী। যুদ্ধের মোড় পালটিয়ে নতুন পজিশন গ্রহণ করে অল্প সদস্যের এ পদাতিক দল বিশাল ইউরোপীয় বহরের একেক সৈন্যকে প্রবল হিংস্রতার সাথে হত্যা করে। হাঙ্গেরির রাজার মাথা কেটে এনে সুলতানের সামনে রাখে জেনিসারিরা। সে দৃশ্য দেখে স্বয়ং সুলতান নিজেই বলেছিলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ এ দৃশ্যে সন্তুষ্ট হবেন না”
জেনিসারি পদাতিকদের মধ্যে গোলন্দাজ ইউনিট তরবারি ও বর্শা হাতে পদাতিক ইউনিটের চেয়ে কার্যকরী ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে জেনিসারিরা মাসকেট নামের ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে। এছাড়া হাত গ্রেনেড ব্যবহারও করত তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে বা যুদ্ধ পূর্বকালীন সময়ে জেনিসারি বাহিনী স্বতন্ত্র পদ্ধতির মাধ্যমে যুদ্ধের সাংগঠনিক কাজ সম্পাদন করত। মুসলিম ও ইহুদি চিকিৎসকদের একটি দল সার্বক্ষণিক তাদের সাথে থাকত। ফলে আহত সৈন্যগণ খুব সহজেই চিকিৎসা লাভ করত। যা আধুনিক যুগের যুদ্ধকালীন মেডিকের সাথে তুলনা করা যায়।
যেসব খ্রিস্টান শাসকরা জেনিসারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই এই বাহিনীর মতো একটি স্থায়ী ও প্রশিক্ষিত সেনাদলের অভাব বোধ করেছিলেন যা পরবর্তীতে তাদের নিজস্ব স্থায়ী বাহিনী গড়ে তোলার প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
জেনিসারিদের বিদ্রোহ ও পতন
প্রথমদিকে খ্রিস্টান কিশোরদের জেনিসারি হিসেবে নিয়োগ দিলেও শেষের দিকে এসে মুসলিম ও তুর্কি নাগরিকদেরও জেনিসারি বাহিনী হিসেবে নিয়োগদানের যোগ্যতা প্রবর্তন হয়। তাদের বিয়ের সুযোগও করে দেয়া হয়। জেনিসারিদের প্রতাপ এতোই বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা অটোমান সশস্ত্র দলের আধুনিকায়নে বাঁধা দেয়। তাদের প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হবে এই ভয়ে তারা সুলতানের ওপর প্রভাব খাটানো শুরু করে। এমনকি তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। ১৪৪৯ সালে তারা প্রথম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিদ্রোহ করে। এর পর থেকে তারা বিভিন্নভাবে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে। নতুন কোন সুলতানের অভিষেক হলে জেনিসারিদের উপঢৌকন দিয়ে তাদের খুশি রাখতে হতো। রাজকীয় ভোজে জেনিসারিরা যদি খাবার গ্রহণ না করত তাহলে মনে করা হতো তারা নতুন সুলতানকে মেনে নেয়নি। ১৮০৭ সালে বিদ্রোহের মাধ্যমে জেনিসারিরা তৃতীয় সেলিমের পদচ্যুত ঘটায়। ১৮২৬ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ জেনিসারিদের দমন করার মতো সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার অনুগত গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণ বিদ্রোহন্মুখ জেনিসারিরা দাঁড়াতে পারেনি৷ ৪ হাজার জেনিসারিদের হত্যা করা হয়। অবশিষ্টদের বিভিন্ন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
জেনিসারি ব্যারাকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকে। আর এরই সাথে শেষ হয় অটোমান সালতানাতের গর্বিত এক বাহিনীর সোনালি অধ্যায়।