উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে জলরঙে আঁকা শিল্পকর্মে ঢাকার ঐতিহাসিক ঈদ মিছিল। ছবিতে তৎকালীন ঢাকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চকবাজার, বড় কাটরার ফটক এবং মীর জুমলার কামান ‘বিবি মরিয়ম’ দৃশ্যমান। ঈদের এই মিছিল নিমতলি প্রাসাদ থেকে বের হয়ে হোসেনি দালান, বেগমবাজার, চকবাজার ঘুরে আবার নিমতলিতে গিয়ে শেষ হত।
পূর্বকথাঃ ১৮ শতকের প্রথমভাগ; সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যয়সংকোচন ও রক্ষণশীল নীতির কারণে মুঘল চিত্রকরেরা নতুন পৃষ্ঠপোষকের সন্ধানে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লেন। এই শিল্পীদের একটি অংশ এসে পৌঁছালেন বাংলার সেসময়কার রাজধানী মুরশিদাবাদে। নবাব মুর্শিদকুলি খান এবং পরবর্তীকালে নবাব আলীবর্দি খানের সহযোগিতায় শিল্পীরা বেশ স্বস্তি বোধ করলেন, বিকশিত হতে থাকল মুঘল ধারার মিনিয়েচার চিত্রকলা। কিন্তু তাদের সৌভাগ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে আবারও তারা কর্মহীন হয়ে পড়লেন। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা এই জীবিকার ওপর চরম আঘাতরূপে এলো বাংলা এগারশ ছিয়াত্তরের (ইংরেজি ১৭৭০) মন্বন্তর, কর্মহীন বহু শিল্পী অনাহারে প্রাণ হারালেন। বেঁচে থাকবার তাগিদে ক’জন শিল্পী আবারও দেশান্তরী হলেন; এবার তাঁরা এসে পৌঁছালেন ইসলাম খান আর শায়েস্তা খানের গড়া প্রাচীন নগরী ঢাকায়।
ঢাকায় তখন চলছে নায়েব নাযিমদের শাসনকাল। ইংরেজ আধিপত্যের কারণে তাঁদের ক্ষমতা তখন খুবই সীমিত। ১৭৮৫ সালে এই দায়িত্বে আসীন হলেন নুসরাত জঙ। বড় সৌখিন মানুষ তিনি। প্রশাসনিক কাজের পর অবসরে ক্যালিগ্রাফির চর্চা করেন আর সুযোগ পেলেই সংগ্রহ করেন ইংরেজ শিল্পীদের আঁকা নানান চিত্রকর্ম। চার্লস ডি’অয়লি ১৮০৮ সালে নিমতলিতে নায়েব নাযিম নুসরাত জঙের প্রাসাদ পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়ে লিখলেন – “The Nawab’s Durbar Hall is so crowded with English prints and paintings that not an inch of the walls can be seen.” সেসময়ে কোম্পানির চাকুরে টেইলরের অনুরোধে নবাব লিখতে শুরু করেন ঢাকার ইতিহাসের ওপর প্রথম প্রামান্য বই (ফারসি সেই বই আরো কিছু সংযোজনসহ ‘তারিখ-ই-নুসরাত জঙ’ নামে ১৯১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়)। সেসময় প্রতিবছরই নায়েব নাযিমদের উদ্যোগে ঢাকা নগরবাসীদের জন্য কয়েকটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজন করা হত; এদের মধ্যে প্রধান ছিল ঈদ আর মহররমের শোভাযাত্রা। নুসরাত জঙ পূর্বসূরীদের এই ঐতিহ্যকে নিজ দরবারের শিল্পীদের তুলিতে অমর করে রাখবার উদ্যোগ নিলেন।
ইংরেজ আধিপত্য এবং নায়েব নাযিমদের ভিন্ন রুচির কারণে মুঘল শিল্পী ও তাদের উত্তরসূরীদের শিল্পরীতি ততদিনে অনেকটাই বদলে গেছে। মিনিয়েচারের বদলে ছবি আঁকা শুরু হয়েছে বৃহৎ ক্যানভাসে, দেশী কাগজে। রঙের ব্যবহারেও এসেছে পরিবর্তন- মুঘল পদ্ধতির ঘন জলরঙের (Gouache) পরিবর্তে শুরু হয়েছে ইংরেজ পদ্ধতির স্বচ্ছ জলরঙের(Watercolour) ব্যবহার। যেমন এখানে যে ছবিটি দেয়া হয়েছে তার আকার ২৪”x ১৮”, দেশী কাগজের ওপর লাল, সবুজ, হলুদ, বাদামি ও কালো রঙের মিশ্রণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে খুঁটিনাটি নানা বিষয়। নান্দিকতার থেকেও এসব ছবিতে জোর দেয়া হয়েছে সমকালীন মানুষের পোশাক, জীবনধারা, উৎসব, স্থাপত্য এসবের উপর। এরকম আরো ৩৮টি ছবি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে আছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এসব ছবির শিল্পীদের নাম প্রায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। শুধু একটি নামেরই স্বাক্ষর পাওয়া গেছে- আলম মুসাওয়ার। ধারনা করা হয় এই শিল্পীর প্রকৃত নাম আলম, শিল্পী হওয়ার কারণে নামের শেষে মুসাওয়ার যোগ হয়েছে যা কি-না চিত্রশিল্পীর আরবী প্রতিশব্দ।
নায়েব নাযিম পদ বিলুপ্ত হয় ১৮৪৩ সালে। এরপর আর এরকম কোনো চিত্রকর্মের নজির পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হল নিযামতের দরবারের শিল্পী ও তাদের উত্তরসূরীরা এরপর কোথায় হারিয়ে গেলেন? এই শিল্পীদের এক বংশধরকে ১৯৪০ এর দশকে ঢাকার বাবুবাজারের মোড়ে গ্লাস পেইন্টিং এর ব্যবসা করতে দেখেছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। হেবকের সাথে দু’তিন রকম অক্সাইড গুড়া ও তিসির তেল মিশিয়ে গ্লাসের উপর ফুটিয়ে তুলতেন কাবা শরীফ, দুলুদুল ঘোড়া ইত্যাদি নানান ছবি, সাথে জীবিকার প্রয়োজনে বিক্রি করতেন নানারকম বাণী লেখা বাঁধাই- “বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না”, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” ইত্যাদি। তিনি থাকতেন ছোট কাটরার এক বহু পুরাতন বাড়িতে। আর সবকিছুর মতন একসময় তিনিও হারিয়ে যান, সাথে লুপ্ত হয় ঢাকার চিত্রকলার ইতিহাসের এক অনন্য ধারা।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. India and British Portraiture, Mildred Archer, London, 1979
২. বাংলার চিত্রকলা, অশোক ভট্টাচার্য্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৪
৩. বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ২০০৩।