নীলকররা জমিদার হলে দেশের উন্নতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন দ্বারকানাথ রামমোহন রায়। ১৮৩৩ এর সনদ আইনের পর নীলকররা বাস্তবে হয় একই সাথে নীলকর, জমিদার ও মহাজন। তার এলাকার সে রাজা। সে যা করবে বা বলবে, তাই আইন। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এর মতো নীলকরও বলতে পারতো, “রাষ্ট্র? সে তো আমি!” (L’etat c’est moi’ – ‘I am the state’)। নীল কমিশনে ১৮৪৮ এর ফরিদপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট দেলাতুর বলেছিলেন, “বিলেতে প্রেরিত প্রতিটি নীল বাক্স এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত – মিশ নারিদের এই উক্তি আমারো উক্তি। বল্লম দিয়ে এপিঠ ওপিঠ ভেদ করা, সড়কির জখমিকে বেঁধে আনা, নীলকর ফোর্ডের নিজ হাতে গুলি করে নেটিভ রায়তকে হত্যা করা – স্বচক্ষে দেখা সব।”

বৃটিশ পার্লামেন্টেও লেয়ার্ড বলেন, “সশস্ত্র নীলকররা কৃষকদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে, খুন করছে নয়তো জখম করে পুরে রাখছে নিজেদের তৈরী কয়েদে। এমন উদ্দাম অরাজকতা কোন সভ্য দেশে তুলনা মেলে না।” ওপর মহলে সুসম্পর্কের কারণে ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশও ঘাঁটাতো না নীলকরদের। বরং আতিথ্য নিতো নীলকুঠিতে। বিচারের সময় নীলকর সাহেবরা বসতো ম্যাজিষ্ট্রেটদের পাশের চেয়ারে। নীলকরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় যশোরের ডিপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল লতিফকে ১৮৫৪ তে সরিয়ে দেয়া হয় অসম্মানজনক ভাবে। নিজের নীলকুঠি থাকায় যশোরের লোহাগড়ায় আদালতও স্থাপন করতে দেয়নি নীলকর ম্যাক আর্থার।

নীল বিদ্রোহ

ইউরোপীয়দের ফৌজদারী অপরাধের এক্তিয়ার ছিলো না মফস্বলের আদালতের। বিচার হতো শুধু কোলকাতা সুপ্রিমকোর্ট। দেশ জুড়ে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে ১৮৪৯-এ খসড়া হয় নুতন আইনের। ইউরোপীয়দের বিচার চলবে ফৌজদারী আদালতে।  কিন্তু শুরু হয় হৈচৈ। নীলকর ও ইউরোপীয়দের কাগজ এর নাম দেয় ‘Black Law’। পরিশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় তা প্রত্যাহার করতে। এরই প্রেক্ষাপটে হ্যালিডে ছোট লাট হয়ে এসে ১৮৫৬ এ কুঠিয়ালদেরকে নিয়োগ দেন অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট। এতে অনেক কুঠিতেই অভিযুক্ত কুঠিয়াল রাতারাতি বনে যায় বিচারক। নদীয়ার গোয়ালতলীর বেণীমাধব মিত্রের দলিলপত্র কেড়ে নিয়ে পরিবার পরিজনকে ভিটেছাড়া করা নীলকর লারমুর হলেন তেমনি একজন। বেণীমাধবের আর ফিরে পাওয়া হয়নি নিজ ভিটায়।

এদিকে জোর করে জমিদারদের তালুক পত্তনি নেয়া, তালুকের সেলামি না দেয়া, জোর করেই সই নেয়া – এ সব কারণে আক্রান্ত হচ্ছিল দেশীয় জমিদারেরাও। সাহসী দু’ একজন রুখে দাঁড়ায়। যশোরের ঝাউদিয়ার জমিদার করম আলীর সাথে লড়াইয়ে পর লেজ গুটিয়ে পালাতে হয় কুখ্যাত নীলকর আর্চিবল্ড হীলস-কে। নড়াইলের জমিদার রাম রতন রায়ের নিজেরও ছিল নীল চাষ। সায়েব নীলকরের নীল বাগানের সব নীলগাছ রাতারাতি কেটে লাগিয়ে দেন নারকেলের চারা।

নীলফামারি নীলকুঠি

তবে নীলকরদের সাথে বিবাদে সর্বস্বান্ত হয়ে ভিটেছাড়াও হতে হয়েছে অনেক জমিদারকে । কিন্তু ইজারার মেয়াদ অন্তে দাদন আদায়ের অজুহাতে নীলকর ওয়াটসন কোম্পানী নিজ দখলে রাখে পুঁঠিয়ার রাজা যোগেন্দ্র নারায়ন রায়ের রাজশাহী ও নদীয়া জেলার সম্পত্তি। অবর্ণণীয় অত্যাচারের শিকার হয় পুঁঠিয়ার প্রজারা। এ নিয়ে সূত্রপাত হয় বিবাদের। নিজ অর্থ শ্রম দিয়ে অনেক বিপদ গ্রস্থ প্রজাদের উদ্ধার করেন ঠিক। কিন্তু আহার নিদ্রা ত্যাগ করে মাসের পর মাস পরিশ্রমে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন ১২৬৯ বাংলায় মাত্র ২২ বৎসর বয়সে।

নীলকরদের সাথে লড়াই করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিতুমীর। নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার মধ্যবর্তী নীল চাষ অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল তাঁর এলাকা। সংঘর্ষে নিয়মিত পরাজিত হতো নীলকররা। তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তিতে শংকিত হয় কোম্পানি সরকার। ১৮৩৯ এ কোম্পানী-ফৌজ, গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ডেভিসের বাহিনী যৌথ ভাবে আক্রমণ করে তিতুমীরকে।

হাতি সহ ২০০ হাবসি ও ১০০০ লাঠিয়ালের এই বাহিনী মোকাবেলা করেন তিতুমীর। নারকেল বেড়িয়ার এরকমই আরেক যুদ্ধে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেন তিতুমীর তবে এরো আগে ১৮২৯ এ নীলকর হাঙ্গামায় জালালপুরে জমিদারের লোক ও  কৃষকদের হাতে বন্দী পুলিশকে ছাড়াতে মিলিটারি ডাকতে হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নাম অবশ্য স্মরণীয় কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য। একসময় নীলকুঠির দেওয়ানের কাজ করতেন,  ক্ষুদ্র মহাজন ও জোতদার। নীল বুনতে অস্বীকার করলে ১৮২৯ সালে ১০০০ লাঠিয়াল নিয়ে ভূমিস্যাত করে দেয় চৌগাছা ও তার পাশের গ্রাম। জেলে দেয় শত শত কৃষক। গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে এই দুই বিশ্বাস মামলা ও নিঃস্ব কৃষক পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে সঞ্চিত ১৭০০ টাকা খরচ করে নিজেরাও হন নিঃস্ব।

নীল ফ্যাক্টরি

নারী শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে বরিশাল থেকে লাঠিয়াল এনে গ্রামবাসী শুরু করে লাঠি ও সড়কি চালনা শিক্ ষা।কুঠিয়ালরা এবার ১৫০০ লাঠিয়াল নিয়ে আক্রমণ করে লোকনাথ পুর। কিন্তু তাও পালাতে হয় প্রতিরোধের মুখে। ১৮৫৭ এ সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্থলে আসে রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসন। বঙ্গে নীল চাষ শুরুর একশত বৎসরে নীল-চক্র পরিণত হয়েছে দৈত্যে, যাকে বলে State within state. অরাজক বিশৃংখলা নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজন নীলকরদের সংযত করা।  কিন্তু নীল বিদ্রোহ এদিকে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। খবর আসতে থাকে চারদিক থেকে, চাষীরা সম্মত হচ্ছেনা নীলচাষ করতে।

পাবনা জিলার নিশানপুর কুঠি অঞ্চলে পুলিশ ব্যাটেলিয়নকে তীর ধনুক লাঠি সড়কি নিয়ে ঘিরে ফেলে হাজার দু’ লোক। সড়কি দিয়ে জখম করে ম্যাজিষ্ট্রেটের ঘোড়াকেও । গুলির আওয়াজ থেকে বুঝা যায় বন্দুকও আছে তাদের। আশেপাশের ৫২টি গ্রাম থেকে জড়ো হয়েছে এই লোকজন।কৃষকরা  মজুদ করছে অস্ত্রশস্ত্র। কৃষ্ণনগর জিলা আয়ত্বের বাইরে নীলকরদের। কৃষ্ণনগরের বল্লভপুরে রণ সজ্জিত মহিলাদের দেখেই পিঠটান দেয় নীলকরদের লাঠিয়ালরা। কৃষকরা বিভক্ত ছিল ছয়টি কোম্পানিতে। মহিলাদের হাতে ছিল মাটির হাড়ি পাতিলের অংশ। বিশেষ কায়দায় পিতলের থালা নিক্ষেপ করে শত্রু নিধন। আরো ছিল ইটপাটকেল, কাঁচা বেল।

এড়াও সেরা ববাহিনী ছিল সড়কি চালনার ‘যুথিষ্ঠির’ বাহিনী। ১০০ জন লাঠিয়াল ঠেকাতে যথেষ্ঠ ছিল একজন সড়কিওয়ালা । বুঝা যাচ্ছে প্রয়োজনে যুদ্ধের জন্য সংগঠিত এখন কৃষকেরা, সাথে দেশীয় জমিদার। নীলকররা অভিযোগ করে – ম্যাজিষ্ট্রেট বলছে, স্বেচ্ছায় নীলচাষ না করলে বাধ্য করা যাবে না। নিরাপত্তা চেয়ে ১৮৬০ এর ১৬ই মার্চ নীলকররা পরিস্থিতি উল্লেখ করে স্মারকলিপি দেয় সরকারকে – কৃষকরা লুট করেছে খাজুরার কুঠি, আগুন দেয় চাঁদপুরের গোলদার কুঠির গোলায়, আক্রমণ করে লোকনাথপুরের কুঠি।

মোল্লাহাটির কুঠির ক্যাম্পবেলকে মেরে মৃত মনে করে ফেলে যায় মাঠে, অশ্বারোহী আরেক সাহেবকে আক্রমণ করে রাস্তায়। আদালতে কোন সাক্ষ্যও পাওয়া যাচ্ছেনা নীলকরদদের পক্ষে। খাদ্য দ্রব্যও কিনতে পারছে না নীলকুঠির কর্মচারীরা, ভয়ে পালাচ্ছে কুঠি ছেড়ে। মার্চ এপ্রিল মে জুনে বিদ্রোহের আগুন হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে নদীয়া, যশোর, বারাসত, পাবনা, রাজশাহী, ফরিদপুরে। বারাসতের সব কৃষকেরা এক বাক্যে ঘোষণা করলো, তারা আর নীল বুনবে না। নীল চাষ করানোর সব প্রয়াস ব্যর্থ হলে ১৮৬০ এ আবার ফিরে আসে নীল চাষ না করলে জেলে পুরার ১৮৩০ এর সেই পুরোনো কালাকানুন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দলে দলে কৃষকদের ধরে এনে জেলে পুরতে লাগলো  ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেটরা। পুলিশকে দেয়া হয় সর্বময় ক্ষমতা, নদীয়া যশোর ও নীল চাষের অন্যান্য এলাকায় ডিপ্লয় করা হয় আর্মি।

নীলকরের লোকেরা পাকড়াও করে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বরের সহায়তাকারী বিশ্বনাথকে। আহসান নগরের যে মাঠে ফাঁসী দেয়, এর নাম পড়ে ফাঁসীতলার মাঠ। শুধু দুই বিশ্বাস নন, যশোরের শত শত নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের সাথে জড়িয়ে আছে নাম না জানা অগুণিত আত্মোৎসর্গকারী বীরের নাম। তেমনি একজন মেঘাই সর্দার ছিলেন নীলকরদের মুর্তিমান আতংক। সুযোগে একা পেয়ে নীলকরদের লোকেরা খুন করে তাঁকে। তাঁর বিধবা পত্নী পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠিত করে গ্রামের কৃষকদের বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার বাগদি গড়ে তুলে লাঠিয়াল বাহিনী। বাঁশবেড়িয়া ও খাল বোয়ালিয়ার নীলকুঠি লুঠ করতে গেলে প্রাণ বাঁচাতে সাহেব মেমরা আশ্রয় নেয় পাশে কলিঙ্গা খালের জলে। টানা কয়েকদিন থেকে যান মাথায় কালো হাড়ি চাপিয়ে নাক ভাসিয়ে।

নীল বিদ্রোহের একটি কল্পিত চিত্রকর্ম

১৮৬০ এ মাগুড়ার রায়তরা ম্যাজিষ্ট্রেট টাইলরের নিকট দরখাস্ত পাঠায়, নীলগাছের বান্ডিলগুলি গ্রামেই ওজন করতে হবে, দাম চুকিয়ে তবে নিতে হবে কুঠিতে । চরম ক্ষুব্ধ যশোরের রায়তরা। নীলকরদের প্রতিরোধ করতে বদ্ধ পরিকর হাজার হাজার কৃষক। জোর করে ফসল নিয়ে যাওয়ার জন্য নীলকররা সংগ্রহ করছে গোলা বারুদ, রিভলভার আর লাঠিয়াল। গ্রামের লোকেরা সংগ্রহ করছে লাঠি আর সড়কি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা, দাম না দিলে ফসল দেবে না। প্রতিরোধ করতে নিজেরাই সংগঠিত করতে থাকে নিজেদের বাহিনী। ফলে তা আর সীমাবদ্ধ থাকে না শুধু প্রতিরোধে। মাঝে মাঝেই চলে নীলকুঠি লুট। নিরুপায় সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় জেলে বন্দী কয়েদীদের ছেড়ে দিতে। নূতন করে করে দেয়া হবে ধ্বংস করা ঘর বাড়ি, ফিরিয়ে এনে দেয়া হবে দেশ ছাড়া ভিখারি হয়ে ঘুরে বেড়ানো পরিজনদেরকে। কিন্তু তাও তারা সম্মত হয়নি নীল চাষ করতে।

 

Contributed By: তপন রায়

তথ্যসূত্র – নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ – প্রমোদ সেনগুপ্ত