বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাসভবন। সম্ভবত এই ভবন নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে এক ধরনের কৌতুহল রয়েছে। শুনা যায় সুলতানী আমলে হযরত শাহাজালাল দখিনি এই জায়গায় বসবাস করতেন। তিনি এবং তার অনুসারী বৃন্দ সুলতানের লোকদের দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হলে (৮৮১ হিজরি) তাদেরকে এখানেই কবর দেওয়া হয়। তারই ফলশ্রুতিতে এই স্থানটি একটি মাজার হিসেবে পরিচিত হতে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য কালক্রমে এর গুরুত্ব কমে যায়।
মোঘল শাসনামলে মির্জা মুকিম সুবেদার মীর জুমলার অধীনে নও নুওয়ারা মহলের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। পুরনো পল্টনের দক্ষিণ পাশে ছিল তার বাসভবন। এই বাসভবনের ভেতরের ও বাইরের অংশে দুটো বড় টিলা ছিল। একটি টিলা এখনও বঙ্গভবনের সীমানার মধ্যে রয়েছে। ভেতরে বিদ্যমান বিশাল পুকুরটি মতিমহল (মতির পুকুর) নামে পরিচিত ছিল। মোগল শাসনের শেষদিকে সম্ভবত এলাকাটি পরিত্যক্ত হয়। মানুক হাউজ নামে একটি ভবন এখনও বঙ্গ ভবন চত্বরে রয়েছে।
ধারণা করা হয় যে হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে মানুক নামের একজন আর্মেনীয় জমিদার এখানে বাস করতেন। এই আর্মেনীয় জমিদার মানুকের নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয় মানুক হাউজ। ঢাকার নবাব আব্দুল গনি মানুকের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন এবং এখানে তিনি একটি বাংলো তৈরি করেন। যার নামকরণ করা হয় দিলখুশা ভবন।
নবাব আব্দুল গনি ১৮৬৬ সালে তার জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা আহসান উল্লাহর জন্য তৈরি করেন দিলকুশা বাগান বাড়ি। সেই দিলকুশা বাগান বাড়ির দক্ষিণ অংশকে ইজারা দিয়ে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কালীন সময়ে উত্তর আসাম ও পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় নির্মাণ হয় গভর্নমেন্ট হাউজ। কালের পরিক্রমায় তা গভর্নর হাউজ এবং সবশেষে বঙ্গভবনে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে বঙ্গভবন এলাকায় ‘মানুক হাউজ’ ও ‘দানা দিঘি’ ছাড়া অন্যকোন নিদর্শনের অস্তিত্ব নেই। তবে বঙ্গভবন এলাকার অভ্যন্তরে দুটো সমাধি সৌধ আজও বিদ্যমান। একটি নওগাজি এবং অন্যটি চন্দন শাহের।
সোজা কথায় বর্তমান বঙ্গভবন যেখানে অবস্থিত তা ছিল হযরত শাহাজালাল দখিনি (রহ.) নামক একজন সুফি সাধকের। সুলতানের চরের দ্বারা সুফি সাধক এবং তার অনুচরবৃন্দ নিহত হলে তাদের এই স্থানে কবরস্থান করা হয়। স্থানটি দ্রুতই তখন সাধকের ভক্তদের নামে পরিচিতি লাভ করে।
যাহোক আবারো ফিরে আসি ১৯০৫ সালে। এ সময় বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকার স্থানটি কিনে নেয় এবং এখানে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করা হয়। যা ১৯১১ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেলের অস্থায়ী বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯১১-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রাসাদকে ‘গভর্নর হাউজ’ ডাকা হতো। এ সময় এটি বাংলার গভর্নরের অস্থায়ী বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রাসাদটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ননের বাসভবনে পরিণত হয়। ভবনটি বেশ কয়েকবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে ১৯৬১ সালে এটি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পর ১৯৬৪ সালে ভবনটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে গভর্নর হাউজের নাম বদলে বঙ্গভবন রাখা হয়। যা অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে। ঐ দিনই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন এবং এই ভবনটিকে রাষ্ট্রপতি ভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান, হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদসহ সকল রাষ্ট্রপতির সময় এটি রাষ্ট্রপতি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিগণ এই ভবনে বসবাস করেন। রাজনীতিবিদ ,বুদ্ধিজীবী ও বিদেশী কূটনৈতিকদের জন্য এখানে রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা হয়। ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় স্থাপিত অন্যান্য স্থাপত্যের মতো এটিও অনেকটা ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যে নির্মিত। ১৯৬১ এবং ১৯৬৪ সালে সংস্কারের পর ভবনটিতে ব্রিটিশ স্থাপত্য এবং বাঙালি স্থাপত্যের সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। এটি মূলত চারদিকে প্রাচীর ঘেরা একটি ভবন। বঙ্গভবনে রয়েছে ৪৭ একর খোলা জায়গা। ভবনটির নিচতলার মেঝের ক্ষেত্রফল ৬৭০০ বর্গমিটার। রাষ্ট্রপতির বাসভবন উত্তর-পূর্বদিকে। দ্বিতীয় তলায় ৯ টি সুদৃশ্য শয়নকক্ষ।
দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন গভর্নর হাউজে মন্ত্রিসভা বৈঠক করেছেন। ঐ সময় গভর্নর হাউজকে বঙ্গভবন নামে অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির দপ্তরে সামরিক ও বেসামরিক সচিবালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা ও দর্শকদের জন্য বিদ্যমান কক্ষগুলো ভবনের নিচতলায় অবস্থিত। এছাড়াও এতে রয়েছে আসবাবপত্র রাখার কক্ষ। একটি সভাকক্ষ। একটি দরবার কক্ষ, একটি ছোট ভোজন কক্ষ এবং স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্য সভাকক্ষ। এছাড়া দ্বিতীয়তলায় ৫ টি অফিস কক্ষ। একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং একটি স্টুডিও। তৃতীয় তলায় বৈদেশিক কূটনৈতিক এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য চারটি আলাদা কক্ষ।
এসবের বাইরে নিরাপত্তা অফিস ব্যাংক, ডাকঘর, ক্যান্টিন, দরজির দোকান, একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা রেজিমেন্টের জন্য একটি ব্যারাক, বঙ্গভবনের দর্শনার্থী ও কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার আলাদা ৩টি স্থানে। এছাড়া সামরিক সচিব ও সহকারী সামরিক সচিবের জন্য ২টি বাংলো।