বাংলার গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এই অঞ্চলের প্রতিটি জীবনে তার প্রভাব রেখেছে, ধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়। জোয়ারের সময় অসংখ্য নদীর পলিমাটি ভেসে এসে জমিকে যেমন উর্বর করে দেয়, তেমনি বাংলার মন্দির-মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির টেরাকোটা অলঙ্করণ নির্মাণে দিয়েছে অফুরান ঐশ্বর্য্য। যদিও বিষ্ণুপুরের মন্দিরের টেরাকোটারর আলোচনা সর্বাগ্রে, আর মসজিদের বিষয়ে আলোচনা নেই বললেই চলে। খুব কম লোকেই জানে যে, বিষ্ণুপুরের মন্দির তৈরি ১৬ শতকে, অন্যদিকে তার বহু আগেই সুলতানি আমলে মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির টেরাকোটা নকশা ব্যবহার করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবাংলার বহু জেলায় (যেমন- মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান) তা আজোও স্পষ্ট বিদ্যমান, এখনও সেইসব মসজিদগুলো উন্নত কারিগরী দক্ষতা ও শৈল্পিক সৌন্দর্য্ প্রদর্শন করছে।
১২ শতকের শেষের দিকে আফগান নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মসজিদ তৈরি ও মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির টেরাকোটা অলঙ্করণের ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল। বখতিয়ার খলজি সেন বংশের লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সেইসময় এই অঞ্চলে বাড়ি-ঘর বা ভবন নির্মাণের জন্য পাথর ও শক্ত কাঠের উপাদান ছিল দুর্লভ, সর্বত্র পাওয়া যেত কাঁদামাটি। এই কাঁদামাটি পুড়িয়েই ইট তৈরি করা হতো এবং পোড়ামাটির টেরাকোটা অলংকরণ করা হতো।
কারো কারো মতে, প্রাক-মুসলিম যুগের বাংলার মন্দির গুলোর অধিকাংশ ছিল ওড়িষা নাগার বা রেখা শৈলীর, যেখানে ইটের নকশা বা টেরাকোটা অলংকরণ করার জন্য খুব কম জায়গাই থাকতো। বাংলায় পাথর দুর্লভ হলেও মন্দিরের প্রতিমা মূর্তি তৈরির জন্য রাজমহল ও ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আমদানী করা হতো। আর একারনেই পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্পীদের চেয়ে পাথরের ভাস্কর শিল্পীদের দাম ছিল বেশি। পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্পীদের জন্য এটা ছিল একটা বিড়ম্বনা। তবে মুসলিমদের আগমনের পরে ১৩ শতকে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। নতুন শাসকেরা মসজিদ নির্মাণে স্থানীয় পোড়ামাটির টেরাকোটা তৈরির শিল্পীদের বেশ গুরুত্ব দিলেন, কারণ সেখানে তারা প্রতিমার বদলে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতাপাতার অলংকরণ ব্যবহার করতো। ফলে পাথরের ভাস্কর শিল্পীরা পৃষ্টপোষকতা থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করলো। বাংলার সুলতানি আমলে বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, গেট, সেতু ইত্যাদি স্থাপত্য কাঠামো নির্মিত হয়েছিল এবং ১৩৫০ সাল থেকে পরবর্তী ২০০ বছরে তারা পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্পকে চরম উৎকর্ষতার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। যা আমরা বাংলার মধ্যযুগের রাজধানী গৌড়ের হযরত পান্ডুয়া, মালদা ও বাংলাদেশের চাপাঁইনবাবগঞ্জের টিকে থাকা স্থাপত্যে দেখতে পাই।
ইসলামে মানুষ ও প্রাণীর ছবি অঙ্কন নিষেধ থাকায় সুলতানি শাসকেরা মধ্য এশিয়া ও দিল্লী সালতানাতের মসজিদ স্থাপত্যের অনুকরণে বাংলার মসজিদে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতাপাতার টেরাকোটা অলংকরণ এবং গ্লেজড টাইলস ও মোজাইকের ব্যবহার করেছিলেন। নকশার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো মিহরাব ও কিবলার দেয়ালকে। এছাড়া দেয়ালের প্যানেলে, প্রবেশপথের খিলানে, এবং কুলুঙ্গির স্প্যান্ড্রিলে বহুল পরিমাণে টেরাকোটার অলংকরণ ব্যবহার করেছিল।
এবার চলুন, সেরকম কিছু মসজিদের সাথে পরিচিত হয়ে আসি।
১. আদিনা মসজিদঃ
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম মসজিদ হযরত পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ। এই বিশাল আয়তনের মসজিদটি সুলতান সিকান্দার শাহের শাসনামলে (১৩৬৪-১৩৭৫ খৃ.) নির্মিত হয়েছিল। এতো বড় ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্যের টিমপেনামের গায়ে খচিত টিকে থাকা কিছু টেরাকোটা এখনো অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। এগুলোতে মূলত ফুলের নকশা করা এবং তার সাথে ঝুলন্ত বাতির নকশা (হিন্দুদের শিকল ও ঘন্টা মোটিফের মতন) ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বাহিরের দেয়ালের দিকে বিভিন্ন টেরাকোটা প্যানেল রয়েছে। আদিনা মসজিদই বাংলার একমাত্র হাইপোস্টাইল ছাদবিশিষ্ট মসজিদ, যেখানে ৩৬০ টি গম্বুজ ছিল।
২. লট্টন মসজিদঃ
৫০০ বছর পরেও গৌড় নগরীর ধ্বসাবশেষের মধ্যে সবচেয়ে গ্লেজড টাইলস ও ছিদ্রবিশিষ্ট মোজাইক সমৃদ্ধ টিকে থাকা ভালো মসজিদটি হলো ১৪৭৫ সালে নির্মিত লট্টন মসজিদ। এখানে মধ্য এশিয়ার টেরাকোটা শৈলীর খুব চমৎকার ব্যবহার করা হয়েছিল। একই ধরনের অলংকরণ আমরা চিকা মসজিদ ও চামকাটি মসজিদেও দেখতে পাই। চিকা মসজিদের কাছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিরাট প্রবেশ পথ রয়েছে, যাকে গুমতি গেট বলে। গ্লেজড টাইলসের নকশা ও কার্ণিসে বক্র ইটের অলংকরণের জন্য গুমতি গেট বিখ্যাত।
৩. তাঁতিপাড়া মসজিদঃ
তাঁতিপাড়া মানে তাঁতি শ্রেনির মানুষদের আবাসন এলাকা। মনে করা হয় যে, ১৪৮০ সালে জনৈক মীরশাদ খান মালদা জেলার
তাঁতিপাড়া মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দেয়ালে অনেক ধরনের টেরাকোটা নকশার প্যানেল রয়েছে। সেখানে খেজুর গাছের চিত্র থেকে শুরু করে শিকল ও ঘন্টা মোটিফ, হিন্দুদের পুর্ণঘট নকশা, গোলাপ ফুল সহ বিভিন্ন লতাপাতার অলংকরণ রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস মতে, পদ্ম ফুল জীবনী শক্তির প্রতিক এবং এটা স্বর্গীয় ফুল। এখানে বিভিন্ন ধরনের পদ্ম ফুলের টেরাকোটাও আঁকা রয়েছে।
৪. কদম রসুল মসজিদঃ
বিশ্বাস করা হয় যে, এখানে হযরত মুহাম্মদ সা. এর কদম মোবারক বা পদচিহ্ন রয়েছে, যে কারণে মসজিদটির নাম কদম রসুল মসজিদ। সুলতান নুসরাত শাহের সময়ে ১৫৩১ সালে নির্মিত এই মসজিদে সাধারণ মসহিদের মতো কোন মিহরাব নেই, তবে ভেতরে একটি কালো আলাদা চেম্বার রয়েছে, যেখানে পদচিহ্নযুক্ত পাথরটি রক্ষিত রয়েছে। এই মসজিদের বহির্গাত্রের দেয়ালের সমস্তটা শিকল ও ঘন্টা মোটিফ সহ কাঁটা ইটের বিভিন্ন টেরাকোটা নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত, যা এটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। এখানে প্রবেশপথের খিলানে পদ্ম ফুলের ব্যবহার করা হয়েছে। এই মসজিদের পাশে ছাদবিহীন একটি হলঘর এবং বাংলার দোঁচালা আকৃতির ছাদবিশিষ্ট একটি সমাধি রয়েছে। জানা যায়, এটি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জেনারেল ফতেহ খানের সমাধি।
উপরের মসজিদ সমূহ ছাড়াও গৌড়-পান্ডুয়াতে সুলতানি শাসনামলের আরোও কিছু স্থাপত্য-ইমারতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যেগুলোতে আজোও ইসলামিক টেরাকোটা শিল্পের সৌন্দর্য্ প্রদর্শিত। সেগুলোর মধ্যে বিশাল প্রবেশপথ দাখিল দরওয়াজা, ৮৪ ফুট উঁচু গৌড়ের ফিরোজ মিনার এবং সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট একলাখী সমাধি উল্লেখযোগ্য।
আশাকরি, আরেকটি পর্বে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।