“Din dhal jaye hay…” সত্যিই তো তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ গলার আওয়াজে একটা সময় সারা ভারতবাসীর দিন রাত, সময় কিভাবে পার হয় যেত তার হিসেব রাখা কঠিন ছিল। প্রায় ১৪টিরও বেশি ভাষায় গান গেয়ে থাকলেও তিনি বেশী খ্যাতি পান হিন্দী সিনেমা জগতে। এই কিংবদন্তীর শিল্পসত্তার বৈশিষ্ট্য হল, তিনি সিনেমায় অভিনীত হিরোদের লিপ সিন অনুযায়ী নিজের গলার সুর বদল করতেন যাতে দর্শকের মনে হয় নায়কই গানটি গাইছেন। এই কিংবদন্তী আর কেউ নন – সঙ্গীত জগতের এক ধ্রুবতারা রফি সাব।
প্রায় ৭০ বছর আগেকার তাঁর গাওয়া গানগুলো আজকের প্রজন্মের কাছেও সমানভাবে প্রিয়। ১৯২৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর ব্রিটিশশাসিত পাঞ্জাবের কটলা সুলতান সিং গ্রামে মোহাম্মদ রফি জন্মগ্রহণ করেন। রাফি সাবের গান শেখার সূত্রপাত রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ফকিরদের থেকে। তাঁদের গাওয়া কাওয়ালিতে আকৃষ্ট হয়েই তাঁর সঙ্গীত জগতের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তারপরে তিনি ওস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ খানের কাছে গানের তালিম নেন। এছাড়াও ভারতীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখেন পণ্ডিত জীবন লাল মাট্টু এবং ফিরোজি নাজমির থেকে। পরবর্তীকালে তাঁর পরিবার লাহোরে চলে গেলে তিনি সেখানে চলে যান এবং তাঁর প্রথম মঞ্চ পরিবেশনা করেন ১৩ বছর বয়সে।
১৯৪১ সালে সিনেমা জগতে তাঁর প্রথম পদার্পণ ‘গুল বালোচ’ নামক পাঞ্জাবি সিনেমার প্লেব্যাক করে, যেটি রিলিজ করে ১৯৪৪ সালে। সেই একই বছরে তিনি ‘অল ইণ্ডিয়া রেডিও লাহোর’-এ নিমন্ত্রণ পান। তারপর ১৯৪৫ সালে তিনি ‘গাঁও কি গোরি’ নামক সিনেমায় প্লেব্যাক করে হিন্দী সিনেমাজগতে পদার্পণ করেন। কর্মজীবনের প্রথমার্ধে তিনি বেশির ভাগ গান করেন নওশাদ আলির নির্দেশনায়। এছাড়াও ও.পি. নায়ার, শঙ্কর জয়কিষণ, শচীনদেব বর্মণ, রোশন প্রমুখের সাথেও তিনি পরবর্তীকালে কাজ করেন। কিন্তু নওশাদ আলির সাথে রাফি সাবের যুগলবন্দী হিন্দী সিনেমা জগতে রাফি সাবের ক্ষেত্রে ভীষণ ফলদায়ক হয় এবং তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। তিনি প্রায় ১৪৯টি গান নওশাদ আলির জন্যে গান।
এরপর আসেন শচীনদেব বর্মণ। তাঁর সাথে রফি সাব প্রায় ৩৭টি সিনেমায় কাজ করেন৷ যার মধ্যে ‘প্যায়াসা’ (১৯৫৭), নউ দো গ্যারা (১৯৫৭), ‘কালা পানি’ (১৯৫৮), ‘কাগজ কা ফুল’ (১৯৫৯), ‘কালা বাজার’ (১৯৬০), ‘তেরে ঘর কে সামনে’ (১৯৬৩), গাইড (১৯৬৫), ‘আরাধনা’ (১৯৬৯), ‘ইশক্ পর জোর নেহী’ (১৯৭১) ও ‘অভিমান’ (১৯৭৩) অন্যতম৷
রাফি সাভের জীবনে চরম সাফল্য এবং খ্যাতি আসে শঙ্কর জয়কিষণের সাথে পার্টনারশিপে৷ প্রায় ৩৪১টি গান রাফি সাব জয়কিষণজির জন্যে করেন৷ যাদের মধ্যে অন্যতম এবং বিখ্যাত গুলি হল – ‘বসন্ত বাহার’, ‘প্রফেসর’, ‘জঙ্গলী’, ‘আসলি নকলি’, ‘রাজকুমার’, ‘সুরাজ’, ‘ব্রহ্মচারী’, ‘আরজু’, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’, ‘দিল তেরা দিওয়ানা’, ‘ইয়াকিন’, ‘প্রিন্স’, ‘লাভ ইন টোকিও’, ‘বেটি বেটে’, ‘দিল এক মন্দির’, ‘দিল আপনা অর প্রীত পারায়ে’, ‘গাবান’ এবং ‘জব পেয়ার কিসি সে হোতা হ্যায়’৷ রাফি সাবের ডুয়েট গানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গান তিনি আশা ভোঁসলে, মান্না দে এবং লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে গেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ফিল্ম ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন বেস্ট সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড পান ‘তেরে গলিওঁ মে না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ’ ( হাওয়াস্, ১৯৭৪) গানটির জন্যে। তিনি ১৯৭৭ সালে ‘কেয়া হুযা তেরা ওয়াদা’ গানটির জন্যে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড পান।
১৯৮০ সালের ৩১শে জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। তাঁর শেষ গাওয়া গান ‘শাম ফির কিউঁ উদাস হ্যায় দোস্ত/ তু কাহিঁ আশ পাশ দোস্ত’, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই তিনি রেকর্ড করেন। তাঁকে জুহুর এক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয় এবং তাঁর শবযাত্রা এক বৃহৎ আকার নেয়। প্রায় ১০,০০০-এরও বেশি মানুষ এই শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন। এখনও বছরে দুবার (রফি সাহেবের জন্মদিন এবং মৃত্যু দিনে) তাঁর অনুরাগী ব্যক্তিরা রফি সাবের সমাধিতে আসেন।
লেখা – Srinanti Roy
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel