আন্দোলনে, যুদ্ধে গুজব বিরাট ভূমিকা পালন করে। যারা আন্দোলন দমাতে চায় তারা আন্দোলনকারীরা যাতে ভয় পায় তারা সেইরকম গুজব তৈরি করে।আন্দোলনকারীরাও এমন গুজব চায় যেটা তাদের চাঙ্গা রাখবে।অনেক গুজব পরে মিথ্যা পরিণত হয়। যেমন রওশন আরার কাহিনিটি। ভারতীয় সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে ‘রোশেনারা’ যেটি শুদ্ধ উচ্চারণ নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একটি খবর মানুষকে বেশ চাঙ্গা করে তুলেছিলো, সেটা হচ্ছে টিক্কা খানের মৃত্যু। রটেছিলো মুক্তিযাদ্ধারা তাকে হত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও সেটা ব্যাপকভাবে রটেছিলো।কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দর্পণ পত্রিকায় এপ্রিল মাসে ‘এই কলকাতায়’ সেই খবরের উল্লেখ ছিলো…

‘টিক্কা খান নিহত’।
“সামসুদ্দিনের গুলিতে জঙ্গি জল্লাদ টিক্কা নিহত? জয়, জয় বাংলা!’
বিমর্ষ চায়ের দোকানে বিজয়োৎসবের জয়ধ্বনি বেজে উঠে আবার।”
[দর্পণ,কলকাতা,৯.৪.১৯৭১]

অমিতাভ চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি ছড়া লিখে ফেললেন……
টিক্কা তোলেন হিক্কা
এক গুলিতেই কাৎ।
ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া
ঠুঁটো জগন্নাথ।
কয়েকদিন পরে জানা যায় খবরটি মিথ্যা।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও গুজব রটেছিলো যে তিনি গ্রেফতার এড়িয়েছেন।পরে ছবিসহ খবর প্রকাশ করা হলে সবাই সেই কঠিন সত্যটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছু কিছু গুজব মিথে পরিণত হয়, রওশন আরার কাহিনিটি সেইরকম একটি মিথ,যা এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন।

কাহিনিটি ছিলো…

ঢাকার এক তরুণী ছাত্রী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি একটি ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছেন এবং নিজে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধের সেই নয় মাস রওশন আরার আত্মত্যাগের কাহিনি… অবরুদ্ধ দেশের মানুষ,শরনার্থী- মুক্তিযাদ্ধা এবং যারা বাংলাদেশের জন্য ভারতে আন্দোলন করছিলেন তাদের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছিলো।

১১ই এপ্রিল বার্তা সংস্থা ইউ এন আই খবরটি এভাবে পরিবেশন করে—-
“রোশেনারা বেগমের নামে মৃত্যু স্কোয়াড জলপাইগুড়ি, ১১ই এপ্রিল (ইউ এন) …
বুকে মাইন বেঁধে পাক সমরাস্ত্র ট্যাঙ্কের সামনে জীবন উৎসর্গ করে ঢাকার রোশেনারা বেগম। ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে যে অতুলনীয় বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তারই নামে বাংলাদেশে মুক্তিফৌজ একটি আত্মোৎসর্গ বাহিনী গড়ে তুলেছেন। নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে এরা রোশেনারা বেগমের মতো পাকিস্তানি সমরাস্ত্র ধ্বংস করবেন।
শীর্ষস্হানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, বিপুল সংখ্যক যুবক এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই বাহিনী ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয়ে আগ্রহী।”
[ দৈনিক কালান্তর, কলকাতা, ১২.০৪.১৯৭১]

রওশন আরাকে নিয়ে স্কেচ। প্রকাশিত হয়েছিলো দৈনিক যুগান্তরে।

বামপন্থার সমর্থক ছিলো সাপ্তাহিক কম্পাস। এর সম্পাদক ছিলেন ফরিদপুরের বিপ্লবী পান্নালাল দাসগুপ্ত (১৯০৯-১৯৯৯)। ১৯৭১ সালে কম্পাসের প্রতিটি সংখ্যাকেই বলা যায় বাংলাদেশ সংখ্যা।
এরকম এক সংখ্যায় আবদুল কাদের লিখলেন—‘বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় গেরিলা যুদ্ধের মূলসূত্র’। গেরিলারা কি পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে পারেন তার ১৯টি সূত্র তিনি দিয়েছিলেন। শেষ বা ১৯ নম্বর সূত্রে তিনি লিখেছিলেন—

“ ১৯. শত্রুদের খাদ্য সরবরাহ ব্যাবস্থা বানচাল করা চাই।ধরা যাক, শত্রুরা ক্ষুধার্ত। আমাদের একজন ফেরিওয়ালা সেজে ঠিক আম- কাঁঠালের মতো দেখতে কতকগুলি বোমা পটকা বানিয়ে এদের সামনে গিয়ে হাজির হলেন।সুযোগ বুঝে সব বোমা-পটকা ছুঁড়ে তিনি শত্রুদের ঘায়েল করতে পারেন।একটি পাঠা,একটি ছাগল,খাসি বা গরুর গলায় মাইন বেঁধে, শত্রুদের ঘাঁটির দিকে আমরা ছেড়ে দিলাম।শত্রু সৈন্যরা এর মাংস খাওয়ার লোভে দূর থেকে যদি একে গুলি করে, তাহলে মাইন ফেটে মুহূর্তের মধ্যে সব শত্রু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।[কি অসম্ভব কল্পনাশক্তি!]
তখন বীরাঙ্গনা রোশেনারার( যিনি বাংলাদেশের রণাঙ্গনে নিজেকে বলি দিয়ে, মাইন ফাটিয়ে শত্রুর ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছেন) কাজ বিনা আত্মবিসর্জনে সম্ভব হবে।”
[কম্পাস ১৯.৬.১৯৭১]

রওশন আরার কাহিনিটি প্রচারিত হয় ৩১ শে মার্চ। ২রা এপ্রিল কলকাতার মহিলারা ‘ রোশেনরা’ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

মহিলা সভায় ‘রোশেনারা’ দিবস পালনের আহ্বান
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ১ম এপ্রিল— আজ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে একটি মহিলা সভায় আগামী ৫ই এপ্রিল ‘রোশেনারা দিবস’ হিসাবে পালন করার জন্য পশ্চিম বাংলার নারী সমাজের কাছে আহ্বান জানানো হয়। শ্রীমতি রোশেনারা বেগম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী, যিনি নিজের বুকে মাইন বেঁধে পাকি সৈন্যদের প্যাটন ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্যাঙ্কটি বিধ্বস্ত করেন। পূর্ব বাংলার ভাই- বোনদের আত্মত্যাগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্তের [বহি] প্রকাশ শ্রীমতি বেগম।”
[ দৈনিক কালান্তর,২. ৪. ১৯৭১]]

এ সংক্রান্ত আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয় দুদিন পর—-
“৫ই এপ্রিল ‘রোশেনারা দিবস” উপলক্ষ্যে মহিলা বিক্ষোভ মিছিল ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির উদ্যোগ।
( রিপোর্টার)

কলকাতা, ৩এপ্রিল— ঢাকা মহিলা কলেজের যে ছাত্রীটি বুকে ‘মাইন’ বেঁধে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধিকার ও গনতন্ত্র রক্ষায় আত্মবলিদানের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছেন, সেই রোশেনারা বেগমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটি আগামী সোমবার ৫ই এপ্রিল ‘রোশেনারা দিবস’ পালনের আহ্বান জানিয়েছে।

ঐদিন রাজ্যের সমগ্র মহিলা সংগঠন, ছাত্রী-শিক্ষিকাসহ সকল নারী সাধারণকে বেলা তিনটায় শহিদ মিনার ময়দানে দলে দলে সমবেত হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে।ঐখান থেকে পাকিস্তান হাই কমিশন এবং ব্রাহ্মদেশের কনস্যুলেট দপ্তরের সামনে মহিলা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়া হবে।এই মিছিলে যোগদানের জন্য বিশেষভাবে ছাত্রী সমাজের কাছে আবেদন করা হয়েছে।”
[ দৈনিক কালান্তর ৪.৪.১৯৭১]
৫ তারিখ পালিত হয় ‘ রোশেনারা দিবস’। ঐদিন কলকাতায় ‘সুদীর্ঘ জঙ্গি মহিলা বিক্ষোভ মিছিল’ হয়।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী—-

রোশেনারা দিবসে মহিলাদের বিক্ষোভ মিছিল
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা ৫ এপ্রিল— আজ ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্দ্যোগে এক সুদীর্ঘ জঙ্গী মহিলা বিক্ষোভ মিছিলের আয়াজন করা হয়।মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে যাত্রা শুরু করে এবং বিভিন্ন রাজপথ পরিক্রমার পর কলকাতাস্থিত পাক হাইকমিশনারের আবাসের সামনে এসে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এপার বাংলার মেয়েরা ওপারের নারী সমাজকে অভিনন্দন জানিয়ে মিছিলে আওয়াজ তোলেন— ‘এপারের মেয়েরা ওপার বাংলার পাশে আছে’এবং সেই সংগ্রামী নারী সমাজের মূর্ত প্রকাশ অমর শহীদ বীরাঙ্গনাকে স্মরন করে ধ্বনি তোলে— “বীরাঙ্গনা রোশেনারা তোমায় আমরা ভুলিনি ভুলবো না।” মিছিলটির পক্ষ থেকে পার হাইকমিশনারের কাছে একটি প্রতিনিধি দল একটি স্মারকলিপি দিয়ে আসেন।স্মারকলিপির অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে “ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী ফৌজ প্রত্যাহার করা হোক এবং বাংলাদেশের স্বাধীন গনতান্ত্রিক সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক।”
[ দৈনিক কালান্তর ৬.৪.১৯৭১]

বিক্ষোভ সমাবেশের পর মিছিলটি শেষ হয়। বক্তব্য রাখেন—- অরুন মুন্সী, অর্পণ বন্ধোপাধ্যায়,ইলা মিত্র প্রমুখ। একই তারিখে ইম্ফলে ‘রোশেনারা দিবস’পালিত হয়। আরো পরে দৈনিক যুগান্তর সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে—-
অল্পদিন আগেই ঢাকা মহিলা কলেজের ছাত্রী রোশেনারা মাইন বুকে বেঁধে শত্রু ট্যাঙ্কের সামনে ধাঁপিয়ে পড়ে আত্মদানের মূল্যে ট্যাঙ্কটি ধ্বংস করে অমর হয়েছেন। আর একটি ছাত্রী নিবাসের অর্ধশতাধিক তরুণী সেদিন কোন উপায় না দেখে ছাদ থেকে নিচের তলায় লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণের দ্বারা জহরব্রতী রাজপুত ললনাদের ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।পূর্ব বাংলার বীরাঙ্গনাদের নামে তাই সত্য ও মনুষ্যত্বের পূজারি মাত্রই জয়ধ্বনি দিবেন। প্রাণের চেয়ে মান বড় সবচেয়ে বড় দেশ ও জাতি, সকলকে এই চিরপুরান কথাটি তাঁরাই মনে করিয়ে দিলেন নতুন করে।
[১২.৪.১৯৭১]

বলা বাহুল্য,দ্বিতীয় খবরটিও সত্য নয়, কিন্তু এখবর দিয়েও উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সেই সময় রওশন আরাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতাও লেখা হয়েছ।বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন।ঠাকুর পরিবারের বিপরীতে ছিলো তাঁর অবস্থান। বামপন্থায় বিশ্বাস করতেন।ইউরোপ, সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলেন দীর্ঘ দিন।
৩ বৈশাখ, ১৩৭৮ [এপ্রিল ১৯৭১] সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ‘রোশেনারা’ নামে ছাপা হয়েছিলো তাঁর একটি কবিতা।
এটাতো মেট্রপলিটানের দামি মানুষের কথা…

এবারে আসি,আসামের কামরূপের গোলকেশ্বর গোস্বামী, কবি হিসাবে তাঁকে কেউ চিনতো কিনা সন্দেহ…তিনি কাছাড় থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘রওশন আরাকে নিয়ে বের বড়সড় একটি কবিতা লিখেন। কবিতার নাম ছিলো—‘ রওশন আরা॥ গোলকেশ্বর গোস্বামী, কামরূপ। রমেন চৌধুরীও তেমন পরিচিত কবি নন, কিন্তু রোশেনারা তাঁকেও আপ্লুত করেছিলো। তিনি লিখেছিলেন—-
বেহেস্তের রোশনাই ‘রোশেনারা’॥ রমেন চৌধুরী

এরপর নামি কবি সিদ্ধেশ্বর সেন পর্যন্ত তাঁর কবিতায় উল্লেখ করলেন রোশেনারার কথা——

…বুকে বেঁধে নিয়ে মাইন যে নব মমতা
প্যাটন ট্যাঙ্কে ঝাঁপিয়ে পড়া
জয়,জয়,জয় কিশোরী ঢাকেশ্বরী
বাঙলা, রোশেনারা
জনসাধারণ জয়
আজাদীর ঝঞ্ঝায়…

৪ঠা এপ্রিল মনোজ বসু দৈনিক আনন্দবাজারে ছোট্ট একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন।তাতেও ছিলো ‘রোশেনারার’ নাম।
তিনি লিখেছিলেন—-

“আধুনিকা কলেজি মেয়ে, এই সেদিন অবধি অতি বড় সৌখিন মেয়ে— বিশৃঙ্খল বেশভূষা,হাঁটুভর ধুলো, বিশুদ্ধ মুখ। সে মুখে কতদিন ভাত উঠেনি কে জানে! তপস্বিনী মূর্তি এরাও সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে রোশেনারা বেগম এদেরই একটি। বুকে যে মাইন বেঁধে শত্রুর প্যাটন ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ট্যাংঙ্ক ঘায়েল হলো, সোনার মেয়ে নিজেও ছিন্নভিন্ন।
আমি তোমাদের কোন সেবায় লাগতে পারি মা জননীরা—
ক্ষুধার অন্ন? অঙ্গ বস্ত্র? মাথার উপর আচ্ছাদন?
তাঁরা বলে, অস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও—বলে হাজারে হাজারে হাত বাড়িয়ে ধরেছে।”

সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী

এবারে আসি মূল কাহিনিতে—-

এই কাহিনির নির্মাতা সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী। ১৯৭১ সালে আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ এর সংবাদদাতা। তিনি লিখেছেন…
“আমি তখন সীমান্তের বিভিন্ন প্রান্তে, কখনো তেলিয়াপাড়া, কখনো ব্রাহ্মনবাড়িয়া, আবার কখনো রামগড়,কখনো আখাউড়া ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করি। বীরত্বের অমর কাহিনির সংবাদ পরিবেশন করি।কখনো বা রণাঙ্গনের শৌর্যবীর্যের কাহিনি সংগ্রহ করি।যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অকুতোভয় মানুষের রঙ্গ কৌতুকের কাহিনিও তার থেকে বাদ যায় না। তবে বেশির ভাগ সংবাদই ছিলো মানবতার মূল্যবোধকে তুলে ধরার তাগিদে।অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদের জন্য কখনো বাংলার দামাল ছেলে মেয়েদের কল্পিত বীরগাঁথা আমাকে তৈরি করতে হয়েছে।

১লা এপ্রিল আমারই কলমে বেরুলো এরকম একটি সংবাদ——
একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে রাজপথে নেমে বুকে মাইন বেঁধে খান সেনাদের একটি ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটির নাম দিয়েছিলাম ফাতেমা বা অন্য কিছু ( স্বভাবতই সেই সময়ের প্রয়োজনে একটি কল্পকাহিনি মাত্র)।

আহমদ ছফা ( ৩০ জুন ১৯৪৩—২৮ জুলাই ২০০১) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ছফা ভাই ( প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা) হাতে কলম নিয়ে বলে উঠলেন,কলেজ পড়ুয়া মেয়ের নাম আধুনিক হওয়া উচিত। তিনি নামটি শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন রওশন আরা বলে।”
[বিকচ চৌধুরী, লক্ষ মুঠিতে ঝড়ের ঠিকানা,আগরতলা ২০০৩]

দৈনিক সংবাদের ১লা এপ্রিল সংখ্যায় বিকচ চৌধুরির প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়——
“ ঢাকার রওশন আরা তার অমূল্য জীবনকে অর্ঘ্য দিয়ে মানুষের ইতিহাসে চিরস্থায়ী অধ্যায় রচনা করে। রওশন আরা ঢাকা মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পাকি নাজি বাহিনীর ট্যাঙ্কের আক্রমনে যখন ঢাকার নাগরিক- জীবন বিধ্বস্ত তবু মানুষের মনে স্বাধীনতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস থাকেনি। তখন এই তরুণী তাঁর বুকে মাইন বেঁধে নিয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্যাঙ্কের নিচে। গোলা বোঝাই এই ট্যাঙ্ক তীব্র গর্জনে মুখ থুবড়ে পড়ে। রওশন আরা তাঁর জীবনকে সার্থক করে তুলেছে মহৎ আত্মদানের মধ্য দিয়ে।”

ঐ সময় ঢাকায় মহিলা কলেজ নামের কোন কলেজ ছিলো না।ট্যাঙ্ক তখন ঢাকার রাস্তায় নাই,অপারেশন সার্চ লাইট সেরে ফিরে গেছে সেনানিবাসে।রওশন আরা মাইন পেলেন কোথায়? এরকম অনেক প্রশ্ন তোলা যেতো,কিন্তু কেউ তোলেনি। পত্র পত্রিকায় কখনো তাকে কলেজ, কখনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বলা হলো।পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক লেখকরা রওশন আরাকে ‘রোশেনারা’ বানিয়ে দিলেন, এবং সেই নামেই তিনি ভারতে বিখ্যাত হয়ে গেলেন।

যেদিন এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়, সেইদিনই বিদেশি সাংবাদিকরা এটি লুফে নেন।বার্তা সংস্থা ইউএনআই সংবাদটি পরিবেশন করে। অন্যদিকে আগরতলায় হৈচৈ। ৮ই এপ্রিল স্কুল কলেজের ছাত্রীরা রওশন আরা দিবস পালন করে।’নারী অভ্যুদয়’এর রাজ্য কমিটির পক্ষে মায়া রায় চৌধুরী এক বিবৃতিতে “রওশন আরা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্য করার আবেদন জানান।” ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে উঠে রওশন আরা বিগ্রেড।

এই কাহিনী এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন। গুজব এইভাবে মিথ হয়,আর মিথের জোর এমনিই!

কৃতজ্ঞতাঃ
মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন দলিলপত্র
মুনতাসীর মামুন।