১৮১৯ সালের ২৪ শে মে লন্ডনের কেনসিংটন (Kensington) প্রাসাদে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্ম হয়। তার পুরো নাম আলেকজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া, মা ডাকতেন দ্রিনা বলে। তিনি ছিলেন ডিউক অব কেন্ট এডওয়ার্ডের একমাত্র সন্তান। এই এডওয়ার্ড ছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ পুত্র। ১৮২০ সালে ভিক্টোরিয়ার বয়স যখন একবছরও পূর্ণ হয়নি তখন বাবা এডওয়ার্ড মারা যান। এরপর মা একাই তাকে বড় করে তোলেন। ভিক্টোরিয়া কখনো স্কুলে যাননি। তার জন্য একজন জার্মান গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়েছিল। সে জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠে।
১৮৩৭ এর জুনে রাজা চতুর্থ উইলিয়াম মারা যাবার পর খুব সকালে ভিক্টোরিয়াকে বলা হয় তিনি এখন ব্রিটেনের রানি। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ রানীর সাথে দেখা করেন। ২৮ জুন ছিলো রানীর সিংহাসনে বসার দিন। প্রথা অনুযায়ী ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে রানীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়। উপস্থিত জনতা রানী দীর্ঘজীবী হোক বলে স্লোগান দিতে থাকে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলেছিল এ অনুষ্ঠান। তিনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী সম্রাজ্ঞী।
১৮৪০ সালে তাঁর মামাতো ভাই আ্যালবার্টের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৮৪১ সালে তাদের প্রথম সন্তান ভিকির জন্ম হয়। মোট নয় ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছিল তাদের ঘরে।
এবারে আসছি রানি ভিক্টোরিয়া আর ভারতীয় আবদুল করিমের সত্য এবং বিতর্কিত সম্পর্কের কাহিনি নিয়ে—-
১৮৮৭ সাল। রানি ভিক্টোরিয়ার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হচ্ছে। তাঁর সাম্রাজ্য তখন খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে, পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ জুড়ে তার বিস্তৃতি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন, এই উৎসবে কিছু ভারতীয় ‘প্রিন্স’কে আমন্ত্রণ জানালে বেশ ভাল হয়। রানির পার্টিতে সারা বিশ্বের সামনে সাম্রাজ্যের রবরবা তুলে ধরা যাবে। এ উপলক্ষে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত থেকে দুজন সহকারী নেওয়া হয় তাঁর জন্য। একজন আবদুল করিম ও আরেকজন মুহাম্মদ বক্স নামের দুই তরুনকে। তাদের কাজ ছিল খাওয়ার টেবিলে রানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এবং প্রয়োজনমতো কাজকর্ম করা।
আবদুল করিমের বয়স ২৪ বছর। তাকে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিশেষ উপহার একটি মোহর দিয়ে। তখন রানীর কাছে ব্রিটিশের দখল করা বিভিন্ন দেশ থেকে সোনার মোহর পাঠানোর নিয়ম ছিল সম্মানের প্রতীক হিসেবে। মোহর দেখে রানী বুঝতেন, তার শাসনভুক্ত দেশগুলো ভালো চলছে। রানীর সামনে এই মোহর উপস্থাপনেরও কিছু কায়দা-কৌশল ছিল। সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মচারীদের সাজিয়ে রাজকীয় কায়দায় উপস্থাপন করা হতো। করিম ছিলেন তেমনই একজন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই রানির প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন।
রানি যখন ভ্রমণে যেতেন, তখন তাঁর পরিবার এবং রাজপ্রতিনিধিদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি আবদুল করিমকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আগ্রার আবদুল করিম একজন নিতান্তই সাধারণ মানুষ ছিলেন কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ভিক্টোরিয়াকে আকৃষ্ট করে। ভিক্টোরিয়া আবদুল করিমকে তিনি তাঁর “মুন্সি” হিসেবে নিয়োগ দেন।
আবদুল করিম রানিকে তাঁর চিঠি লেখার কাজে সাহায্য করতে শুরু করলেন। রানি সই করছেন চিঠিতে, করিম দাঁড়িয়ে আছেন পিছনে বা পাশে— শান্ত, ধীরস্থির। রানির খুব ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষা শেখার ইচ্ছে, করিম তাঁকে দিলেন ছোট্ট একটা পকেট-বই, উর্দু শেখার। রানি সব সময় সেটি নিয়ে ঘুরতেন। এর পরেই তিনি উর্দুতে করিমকে চিঠি লিখতে থাকেন । বেশ কটি চিঠি পড়ার পর পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন l
রানি আবদুল করিমের কাছে ভারতের খোঁজখবর নিতে থাকেন। তিনি রানিকে বললেন তাঁর দেশের কথা, সেখানকার আদবকায়দা, উৎসবের কথা। করিম তাকে আগ্রার তাজমহলের কথা জানান। সম্রাট শাহজাহানের করুণ পরিণতি, পুত্রের হাতে বন্দীজীবনের কথাও বাদ যায় না। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর সম্রাটের তাজমহল গড়ার কাহিনী ভিক্টোরিয়া শোনেন। আগ্রা ফোর্টে বন্দীজীবনে থাকার সময় দীর্ঘশ্বাস ও কষ্ট নিয়ে চাঁদনী রাতে দূর থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলার কথা শুনে রানী আপ্লুত হন। এরপর ভারতীয় সংস্কৃতির কথা আসে, রানী মুগ্ধ হয়ে শোনেন সবকিছু। চব্বিশ বছরের আবদুল করিম তাঁর চোখে ধরা দিল এক নতুন রূপে !
এক দিন রানির রান্নাঘরে করিম তাঁর মশলার বাক্স নিয়ে হাজির। রানির জন্য ‘কারি’ রান্না করলেন। করিমের কারি রানির মন জয় করল। ভিক্টোরিয়া বললেন, রোজ এই খাবার তাঁর লাঞ্চে চাই। চিকেন কারি আর ডাল খুব প্রিয় ছিল তাঁর। বাকিংহাম প্যালেসে এক কালা আদমির এই উত্থান অনেকেই বরদাস্ত করতে পারলো না । করিমের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হল, সে আসলে গুপ্তচর, মুসলিম পেট্রিয়টিক লিগ-এর সঙ্গে যুক্ত, ব্রিটিশবিরোধী। এও রটানো হলো করিম চোর।
১৮৯৭ সালে, রানির সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এই সব ষড়যন্ত্র তুঙ্গে উঠল। সারা বিশ্ব যখন রানির বৈভব আর সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ, ঠিক তখনই মুন্সিকে কেন্দ্র করে রাজদরবার হয়ে উঠেছিল একটা ফুটন্ত কড়াই। রাজ কর্মচারীদের মেজাজ খারাপ, এমনকী সবাই গণ-পদত্যাগের হুমকিও দিল। কিন্তু কিছুতেই রানিকে টলানো গেলনা। প্রিয় মুন্সির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বরং পরিবার ও প্রাসাদের বাকি সদস্যদের উদ্দেশে একটা কড়া নোটিস পাঠালেন। সবাইকে বললেন মুনসিকে সম্মান করতে। ভেবেছিলেন তাঁকে নাইটহুডও দেবেন, পরে মত পরিবর্তন করে তাঁকে এমভিও (মেম্বার অব দ্য ভিক্টোরিয়ান অর্ডার) উপাধি দেন।
বলা বাহুল্য তাদের এই মেলামেশা রাজপরিবারের কেউ সহজ ভাবে নিতে পারেনি, তাই তাঁকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ষড়যন্ত্রে রাজপরিবার থেকে শুরু করে সভাসদ, এমনকি খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দরবারও জড়িয়ে যায়। সবার চিন্তাই ছিল যে কোনভাবে করিমকে হটানো রানীর মহল থেকে। সেই ষড়যন্ত্র নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা তৈরি হয়। বইও লেখা হয়। এ নিয়ে কল্পকাহিনীরও শেষ ছিল না। এখনো আলোচনা, সমালোচনা আছে। রাজপরিবারের গবেষকরা বিস্ময় নিয়ে সেই কাহিনীর ওপর কাজ করেন।
অবশেষে রানীকে জানানো হলো, ভারতীয় ব্যক্তিটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছেন। তার স্ত্রী ভারতে বসবাস করেন। তিনি স্ত্রীর খবর রাখেন না। ব্রিটিশ শাসনে এভাবে চলতে পারে না। রানী ডাকলেন করিমকে, জানতে চাইলেন সবকিছু সত্য কিনা? জবাবে করিম জানান, সব সত্য। তার স্ত্রী আছে। তবে সন্তান নেই। রানী বললেন, তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, শিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে একটি ভাষা শিখছিলাম। মুন্সি নামে ডাকছি। কারণ তুমি বলেছ, ভারতে শিক্ষকদের মুন্সি বলা হয়। তুমি আমার সঙ্গে এই মিথ্যা না বললেই পারতে। তুমি তোমার স্ত্রীর প্রতি অবিচার করছ। জবাবে করিম বললেন, আপনি জানতে চাননি তাই বলতে পারিনি।
এরপরও তিনি করিমকে বের করে দেননি বরং তখনই তিনি নির্দেশ দেন করিমের পরিবারকে ভারত থেকে বাকিংহাম প্যালেসে নিয়ে আসতে।
তাঁর নির্দেশ মতো করিমের স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়িতে। বিষয়টি রাজপরিবারের কারও পছন্দে হয়নি।করিমের স্ত্রী ও শাশুড়ির সম্মানে রানী রাজপ্রাসাদে আলাদা অনুষ্ঠান করেন। বোরকা পরেই করিমের ভারতীয় স্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বসেন রানীর পাশে। রাজকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না।
ভিক্টোরিয়ার শরীর যখন ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই করিমের ইংল্যাণ্ডের পাট চুকবে তাই বেঁচে থাকতেই আগ্রা শহরে ওর নামে বড় একটা বাড়ি কিনিয়ে রেখেছিলেন । কি চোখে দেখতেন তাকে রাণী ? প্রেম না শুধুই বন্ধুত্ব । নাকি বৈভবের আড়ালে নিঃসঙ্গ এক রমণীর বেঁচে থাকার অবলম্বন? সম্পর্ক যাই থাক দুই অসম বয়সী নারী পুরুষের পারস্পরিক নৈকট্য মেনে নেয়নি ইংল্যান্ডের রাজপরিবার ।
১৮৯৯-এর নভেম্বরে অসবর্নে (Osborne) শান্তির মৃত্যু এল রাণির । কফিন বন্ধ করার আগে, শেষ যে মানুষটি তাঁকে দেখতে এলেন, তিনি আবদুল করিম। বন্ধুর জন্য প্রার্থনায় ঠোঁটদু’টো নিঃশব্দে নড়ছে। রানীর মৃত্যুর পর প্যালেস থেকে করিম ও তার পরিবারকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়। রানীর দেওয়া সব উপহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। করিমের ক্ষমতা দেখে এত দিন যারা ক্ষুব্ধ ছিল তারা সবাই লাশের শেষকৃত্য সম্পন্নের আগেই বের করে দেয় করিমকে। অথচ একদিন করিমই সবার নাকের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন এই রাজপ্রাসাদে। আজ রানী নেই তাই করিমেরও এখানে জায়গা নেই।
তাঁদের সম্পর্কের কথা পরে জানা যায় আবদুল করিমের লেখা ডায়েরি থেকে। ১৯০১ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আবদুল করিমকে। এরপর বাকি জীবন তিনি আগ্রার কাছে একটি জায়গায় নিভৃতে বসবাস করেন, তার জন্য এ জায়গার বন্দোবস্ত করে দিয়ে যান রানি ভিক্টোরিয়া নিজেই। ১৯০৯ সালে ৪৬ বছর বয়সে মারা যান আবদুল করিম।
#তথ্যসূত্র:
#বাংলাদেশ_প্রতিদিন
#ইন্টারনেট
#Victoria & Abdul
#সাংবাদিক_শ্রাবণী_বসু_with_Aranibhas_Gupta.