১১৫০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়। অবশেষে অদ্ভূত ভৌগোলিক পরিবেশ ও অদ্ভূত সব গাছগাছালিতে পূর্ণ ‘এলিয়েন দ্বীপ’ বা ‘ভিনগ্রহবাসীদের দ্বীপ’ খ্যাত ‘সোকোত্রা’ দ্বীপে এসে পৌঁছলেন অ্যারাবিয়ান ভূতত্ত্ববিদ ও মানচিত্রকার মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি। এতোদিন শুধু শুনেই এসেছেন, তবে আজ নিজ চোখে দেখে বুঝতে পারলেন, কেনো ‘এলিয়েন দ্বীপ’ বলা হয় এটিকে। পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গার সাথে এই দ্বীপের অধিকাংশ গাছপালার কোনো মিলই নেই। দুই ধরনের গাছ দেখতে সবচেয়ে বেশি অদ্ভূত লাগছে ইদ্রিসির কাছে। একটা গাছ দেখে মনে হয় যেনো উড়ন্ত কোনো সবুজ থালাকে কিলবিল করতে থাকা অসংখ্য শুঁড়বিশিষ্ট বড় একটি হাতির শুঁড়ের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে, কিছুটা যেনো বিশাল কোনো ব্যাঙের ছাতা। এই গাছের নাম ‘সোকোত্রা ড্র্যাগন ট্রি’ বা ‘ড্র্যাগন ব্লাড ট্রি’। আরেকটা গাছ দেখে মনে হয়, বিশাল কোনো এলিয়েনের শরীর থেকে কতোগুলো হাত বের হয়েছে এবং সেই হাতগুলো গুটিকয়েক পাতা ধরে আছে (একধরনের শসা গাছ)। অদ্ভূত গাছপালাগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে দ্বীপটির আরও গভীরে প্রবেশ করলেন ইদ্রিসি। এই দ্বীপে খুব কম সংখ্যক মানুষ বাস করে। তাই ঝামেলামুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় নির্জন এই দ্বীপের গভীরে এসে গা ছমছম করে ওঠে ইদ্রিসির। এমন ভুতুড়ে জায়গার দেখা হয়তো তিনি আগে কখনো পান নি। তবে এখন আর এতোশত না ভেবে কাজে মন দেয়াই শ্রেয়, ভাবলেন তিনি। ‘সোকোত্রা’ দ্বীপে আল-ইদ্রিসির গবেষণা থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেলো, তা ছিলো বিস্ময় জাগানিয়া। সেখান থেকে নিজ ভূমি স্পেনে ফিরে গিয়ে লিখে ফেললেন তিনি তার গবেষণালব্ধ ফলাফল। বহু বছর ধরে সমুদ্র-বাণিজ্য নিয়ে প্রচলিত ধারণা নিমিষেই ঘুচে গেলো তার লেখনী পড়ে। হ্যাঁ, মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসির লেখা থেকেই প্রথমবার জানা গেছে, সমুদ্র-বাণিজ্যের সাথে শুধু মিশর, আরব ও রোমেরই সম্পর্ক ছিলো না; নিজেদের ইতিহাস লিখে না রাখা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেরও ছিলো গভীর সম্পর্ক, যা ২০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। আর এ সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, ছিলো তার চেয়েও বেশি কিছু। এই জায়গা যেনো ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন ভক্তি ও শ্রদ্ধারই এক অমূল্য ছাপ ধারণ করে চলেছে যুগ-যুগান্তর ধরে।
২০০১ সাল। বেলজিয়ামের এক দল স্পেলিওলোজিস্ট (যারা গুহা বা অন্যান্য বস্তুর গাঠনিক প্রক্রিয়া, বয়স ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন) একটি প্রজেক্ট নিয়ে এই দ্বীপে আসেন। উদ্দেশ্য ছিলো ভৌগোলিক গবেষণা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা এই দ্বীপে ‘হালাহ’ নামের একটি মোটামুটি গভীর গুহা খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের কিছু পাথরের ফলকে তারা ভারতীয় ব্রাহ্মী লিপি দেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, বেশ কিছু ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুও তারা পেয়েছেন। সোকোত্রার আরেকটি গুহা হলো ‘আল-হক’ গুহা, যার কথা না বললেই নয়। ‘আল-হক’ গুহার ভেতর সার্চলাইটের আলো যতো উজ্জ্বল হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়েছে ইতিহাসের মাঝে অনুল্লিখিত সেই সব না বলা কথার; যা মনে করিয়ে দেয়, এক সময় আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার নানা অঞ্চলে কিভাবে বিস্তার লাভ করেছিলেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা, আর এর পিছনে ভারতীয় নাবিকদের গুরুত্ব কতো বেশি ছিলো।
আল-হক গুহার ভেতরে মিলেছে অনেকগুলো ভাষার বেশ কিছু শিলালিপি। অধ্যাপক ক্রিস্টিন রবিন সেই ভাষাগুলোকে সনাক্ত করেছেন ভারতীয়, দক্ষিণ আরবীয়, ইথিওপিয়ান এবং আরামাইক ভাষা হিসেবে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, প্রায় ২১৫টিরও বেশি লিপি সনাক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৯২টিই হলো ব্রাহ্মী লিপি এবং ১টি খরোষ্ঠী লিপি। বেশিরভাগ লিপিগুলোই ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত। এগুলো ছিলো ছোট ছোট নাম, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো পদবীসহ। মনে হয় যেনো, দূর-দূরান্ত থেকে আসা সমস্ত নাবিকেরা নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ বেখেয়ালিপনায় হিজিবিজি অক্ষরে নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কিছু কিছু নামের শেষে আবার ‘নন্দীপদচিহ্ন’ বা ‘ত্রিশূল’ এর মতো বিশেষ কিছু চিহ্ন দেখা গিয়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় দুই মাস্তুলবিশিষ্ট বৈঠাসহ জাহাজের চিত্রও পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো গৌতমীর ছেলে ২য় শতকের সাতবাহন শাসক সাতকর্ণীর মুদ্রার চিত্রের সাথে হুবহু মিলে যায়।
ভারতবর্ষ থেকে ঐ সব অঞ্চলে বাণিজ্য করতে যাওয়া জাহাজের নাবিকদের কাছে এই সোকোত্রা হয়ে উঠেছিলো এক পবিত্রভূমি। আর তার মন্দির ছিলো আল-হক গুহা। কাঠের পাটাতনের উপর খোদাই করা প্রার্থনা-কথা ও প্রচুর পরিমাণে ধূপদানি পাওয়া গিয়েছে সেখানে। ব্যবসায় সফলতা লাভের জন্য ‘সুখদরা মা’ এর পূজা করতো এখানে ভারতীয়রা। আর যেহেতু ‘সুখদরা’ থেকে আসা ‘সোকোত্রা’ একটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ‘স্বর্গসুখ প্রদানকারী’; সেহেতু এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, এই দ্বীপের নামকরণের পেছনেও রয়েছে ভারতীয়দের অবদান।
আল-হক গুহার ভেতর দুটি প্রার্থনা-ফলক পাওয়া গিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে একটির বেশিরভাগ লেখা মুছে গেছে, কারণ এটির সামনের অংশটিই নিচে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। তবে আরেকটি ফলক কিন্তু বেশ অক্ষতই ছিলো। এটি ছিলো আবশাম্মায়ের ছেলে পাল্মিরিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেন আবগারের একটি প্রার্থনা-ফলক, যেখানে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ কামনা করা হচ্ছে।
সুখদ্বার দ্বীপ (যে দ্বীপে সুখ মেলে) সোকাত্রার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাবিকরা জাহাজ থামিয়ে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতেন ‘সুখদরা’ মাকে। কেউ খুব তাড়ায় থাকলে ধূপকাঠি জ্বালিয়েও শ্রদ্ধাটুকু দেখিয়ে যেতেন সমুদ্রের দেবীকে। কেউ কেউ আবার জাহাজ থেকেই ছোট খেলনা নৌকা ভাসিয়ে ঠেলে দিতেন দ্বীপের দিকে, সেটাও শ্রদ্ধা জানাতেই। সমুদ্র যাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশে ছিলো নানা রকমের বিপদ। খারাপ আবহাওয়া এবং ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে সাহসের পরিচয় তো দিতেই হতো, আর তখন তাদেরকে শক্তি দিতো তাদের মায়ের পূজো।
আল-হক এবং হালাহ গুহার ভেতর স্ট্যালাকটাইটস-স্ট্যালাগমাইটসে (কোনো গুহার ভেতর ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে গুহার মেঝে থেকে উঁচু হয়ে পাথরের আকৃতি নেয়া ক্যালসিয়াম কার্বোনেটই হলো স্ট্যালাকটাইট এবং আরেক ধরনের ক্যালসিয়াম লবণ যেটি স্ট্যালাকটাইটের সাথে একত্রীভূত হয় তাকে বলা হয় স্ট্যালাগমাইট) ভর্তি। সবচেয়ে অবাককর বিষয় হলো, সোকোত্রা দ্বীপের গুহাগুলোতে এই স্ট্যালাকটাইটস ও স্ট্যালাগমাইটসগুলোর আকৃতি এতো বিশাল হয়ে থাকে যে সাধারণ উচ্চতাসম্পন্ন কোনো মানুষকে তার সামনে একদম নগণ্য মনে হয়। এটিও এই দ্বীপের আরেকটি অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য। বেলজিয়ামের সেই স্পেলিওলোজিস্ট দল এখানে স্ট্যালাকটাইটস থেকে পানি সংগ্রহ করার জন্য পাত্রও খুঁজে পেয়েছেন।
‘সোকোত্রা’-কে আসলে দ্বীপ বললে ভুল হবে। এটি মূলত চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। এর অদ্ভূত প্রকৃতি একে অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা করে রেখেছে। আফ্রিকার হর্নের প্রায় পূর্বে এবং আরব উপদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত এই ছোট দ্বীপপুঞ্জটি বর্তমানে ইয়েমেনের মালিকানাধীন। এটি ছিলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যস্থল। প্রাচীনকালে বণিকরা প্রথমে দূর-দূরান্ত থেকে ইয়েমেনে এসে পৌঁছাতো এবং ইয়েমেন থেকে একটি নাতিদীর্ঘ যাত্রা করে পৌঁছতে হতো সোকোত্রায়।
সোকোত্রায় বাণিজ্য প্রথমবার শুরু হয় গ্রীকদের আগমনের মাধ্যমে। প্রথম শতকে গ্রীকদের পদচারণা হয়েছিলো এই দ্বীপপুঞ্জে, যা পাথরখন্ডে পাওয়া ভাষার ব্যবহার এবং একটি কাঠের চাকতি দেখে প্রমাণিত হয়। আরো ধারণা করা হয়, তৃতীয় শতকের দিকে এই দ্বীপপুঞ্জটিই ছিলো প্রাচীন যুগের ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র।
এমনকি যীশু খ্রিস্টের সবচেয়ে কাছের ১২ জন (মতান্তরে ১১ জন) শিষ্যের মধ্যে অন্যতম সেইন্ট টমাস ৫০ সালের দিকে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে যখন ভারতবর্ষে আসার জন্য রওয়ানা হন, তখন তিনিও আসার পথে সোকোত্রায় অবস্থান করেছিলেন। আর ধারণা করা হয়, এ জন্যই হয়তো ১৬ শতক পর্যন্ত এই দ্বীপের প্রধান ধর্ম ছিলো খ্রিস্টান ধর্ম। তবে বর্তমানে এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই মুসলমান।
সোকাত্রা দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে মার্কো পোলোর বই ‘দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো’ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। যদিও কোথাও বলা নেই তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন বা গিয়েছিলেন কি না, কিন্তু দ্বীপটি সম্পর্কে অনেক কিছুই পোলো জানিয়েছেন।
১৫০৭ সালে সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলেন পর্তুগীজরা। কিন্তু খুব দ্রুতই তারা বুঝতে পারেন যে, এটি আসলে বসবাসের জন্য সুবিধাজনক কোনো জায়গা নয়। তাই ১৫১১ সালের মধ্যেই তারা এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যান।
সোকোত্রার রাস হাউলেফে ১৭ শতকের অনেকগুলো গুজরাটি শিলালিপির ফলক পাওয়া গেছে। দেখতে কিছুটা সমাধি-ফলকের মতো হলেও আসলে সেগুলো ছিলো গুজরাট থেকে সোকোত্রায় আসা জাহাজগুলোর বিবরণী, যাদের মধ্যে অনেকগুলোই ছিলো রাজকীয় জাহাজ। স্পষ্টভাবে উল্লিখিত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। শিলালিপিগুলো থেকে জানা যায়, সম্রাটের জাহাজগুলোতে কতো জন ক্রু ও বণিক ছিলো, কিভাবে ৫০ দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে তারা এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন এবং প্রায় চার-পাঁচ মাস অবস্থানকালে তাদের কি ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
১৭ শতকে ব্রিটিশরাও বেশ কয়েকবার এই দ্বীপে এসেছিলো। যদিও তারা বুঝতে পেরছিলো যে এটি বসবাসের জন্য অযোগ্য একটি জায়গা, কিন্তু এই জায়গাটির বহুমুখী গুরুত্ব তারাও অনুধাবন করতে পেরেছিলো। এ কারণেই সোকোত্রাকেও তারা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো, যেনো সুয়েজ খাল হয়ে ভারতবর্ষে যাওয়ার পথে এই দ্বীপটিকে তারা তাদের জাহাজের জন্য একটি নিরাপদ প্যাসেজ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ থেকে পাওয়া যায় এই উপমহাদেশের নৌবাণিজ্য সম্পর্কে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য। সোকোত্রায় রপ্তানি করা বহু পণ্যের মধ্যে কিছু ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং সেই বিশেষ পণ্যগুলো ছিলো এই বাংলার। হ্যাঁ, বিস্ময়কর হলেও সত্য, আমাদের এই বাংলার অনেক পণ্য সেখানে ছিলো বিখ্যাত। প্রাচীনকালে সমুদ্রপথে ও স্থলপথে বাইরের বিশ্বের সাথে আমাদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর আদান-প্রদান চলতো। চন্দ্রকেতুগড় বা গাঙ্গে বন্দর তো ছিলো তাম্রলিপ্ত, কৌশাম্বী এবং মথুরার সাথে রোমের বাণিজ্যপথের প্রধান সংযোগ। এমনকি শুধু রোম নয়; চীন, মিশর ও পূর্বমহাদেশীয় দ্বীপপুঞ্জগুলোর সাথেও বাংলার বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিলো গর্ব করার মতো। ইবনে বতুতা ও মা-হুয়ান এর তত্ত্বানুসারে, বাংলা থেকে সুদূর মালদ্বীপে সমুদ্রপথে চাল এবং পুন্ড্রবর্ধন থেকে বিপুল পরিমাণ আখ রপ্তানি হতো। সে সময়ে আখ উৎপাদনে পুন্ড্রবর্ধন এক বিশেষ স্থান লাভ করেছিলো।
গাঙ্গে বন্দর থেকে রপ্তানি করা বিশেষ দুটি পণ্য হলো তেজপাতা ও সুগন্ধি তেল। গাঙ্গে বন্দর থেকে এগুলো পৌঁছাতো তামিলনাডু উপকূলে, তামিলনাডু থেকে স্থলপথে মালাবারের মুজিরিস বন্দর হয়ে পৌঁছাতো পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়। বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত মসলিন বা সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্রের উৎপাদন ও গুণগত মান নিয়ে ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’, আরবি ও ফারসি বিবরণী, রোমান ও চীনা বিবরণী, মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং চাণক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-তে লেখা হয়েছে। বাংলায় উৎপাদিত এই মসলিনসহ আরো অনেক পণ্য রোম, চীন, মালাবার, কাম্বে, পেগু, টেনাসেরিম, সুমাত্রা, সিংহল, মালাক্কা ইত্যাদি প্রদেশে প্রচুর রপ্তানি হতো। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যদ্বীপ সোকাত্রায় বাংলার পণ্যের হদিস মেলা হয়তো খুব বেশি অদ্ভূত নয়, বরং এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গার সাথে প্রাচীন বাংলার মতো এতো বাণিজ্যসমৃদ্ধ একটি অঞ্চলের যোগসূত্র না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক।
সোকোত্রার আরেকটি অন্যতম প্রধান পণ্য যা দক্ষিণ এশিয়া থেকেই রপ্তানি হতো, সেটি হলো ঘি। ঘি ছিলো সোকোত্রায় ভীষণ জনপ্রিয়। শুধুমাত্র ঘি এর বিপুল রপ্তানিই ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সোকোত্রার গভীর বাণিজ্য-সম্পর্ক প্রমাণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
কালক্রমে সমুদ্রপথে আরব ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় ভারতীয়দের সুখদরা মায়ের পূজো। আর এ জন্যই মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসির লেখা থেকে সোকোত্রায় ভারতীয় বাণিজ্য সম্পর্কে প্রথমবার জানা গেছে। তার লেখা থেকেই জানা যায়, এক সময় এই সোকোত্রায় নাকি মেসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডারও এসেছিলেন এই উপমহাদেশের নৌবহরকে দুর্বল করবার উদ্দেশ্য নিয়ে, ছিনিয়েও নিয়েছিলেন ভারতীয়দের কাছ থেকে এই পবিত্র দ্বীপ। তবে সেই ছিনিয়ে নেয়াও যে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, সেটাও বলে দেয় আল-হক গুহার শিলালিপি।
ইতিহাস বড় অভিমানী! যত্ন না নিলে ধুলো জমে যায় তার ওপর। ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে তাকে গুছিয়ে না রাখলে হারিয়ে সে যাবেই। এভাবেই সোকোত্রা থেকেও হারিয়ে গিয়েছিলো ভারতীয় নাবিকদের সমুদ্রযাত্রার কাহিনী। তবে ধুলো-ময়লায় চাপা পড়ে গেলেও ইতিহাস কখনও ধ্বংস হয়ে যায় না, হঠাৎ করেই মাটি খুঁড়তে গিয়ে, কিংবা হাওয়ার্ড কার্টারের মতো কোনো পর্যটকের পায়ের ধাক্কায় খসে যাওয়া আলগা পাথরের পিছন থেকে আচমকাই ফিরে আসে সে। সময়মতো ঠিকই তার জায়গা হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের সমূদ্রযাত্রার ইতিহাস বিশাল ও বিস্তৃত। তার যে বহুবর্ণিলতা, তা-ই দেখতে পাওয়া যায় এই সোকোত্রা ভ্রমণে; নতুন আবিষ্কৃত এক নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বলে। ইয়েমেনের অন্তর্গত বিচ্ছিন্ন এই ভারত মহাসাগর দ্বীপের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় নাবিকদের জীবনের অনেক অজানা গল্প। সোকোত্রার গভীরতম গুহাগুলোর দেয়ালে ভারতীয় বণিকদের আঁকা অসংখ্য দেয়ালচিত্র যেনো প্রতিনিয়ত চিৎকার করে বলে চলেছে ভারতবর্ষের সাথে তাদের প্রাচীন সম্পর্কের কথা।
সমুদ্রের সাথে ভারতীয় বীরের হাজার বছরের অভিজ্ঞতার প্রমাণ ২০০৮ সালে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর মর্যাদা লাভ করা এই সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ, আর এ কারণেই এই ব্যতিক্রমী জায়গাটির গুরুত্ব কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। এতো দিন পরে সেই সমুদ্রচারীদের জীবনের গল্পগুলোকে হয়তো পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হবে না, কিন্তু সত্যি বলতে, এভাবেই গল্পগুলো কৌতুহল বাড়িয়ে দেয় নিজেদেরকে জানার, আর এই কৌতুহলই কিন্তু এক পর্যায়ে আমাদেরকে পৌঁছে দেয় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে, উন্মোচিত হয় প্রকৃত সত্য।