খ্রিস্টপূর্ব ২৪৭ সাল। ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পারস্যের পার্থিয়া প্রদেশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর থেকেই তার সেনাপতি প্রথম সেলিউকাস নিকাতোর পারস্য ও মেসোপটেমিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন। আলেকজান্ডারের সাত জন সেনাপতির মধ্যে সেলিউকাসই অধিকার করেছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো। তবে এই মুহূর্তে সেলিউসিড সাম্রাজ্য এখন ভীষণ দুর্বল। মিশরের টলেমীদের সাথে আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে প্রায় মুষড়ে পড়েছেন সেলিউকাসরা। এ-ই তো সুযোগ পার্থিয়া অধিকারের। ক্যাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব দিকে মধ্য এশিয়ার উপত্যকা অঞ্চলের ‘পার্নি’ উপজাতিরা একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করেছেন এতো দিন। এবার আর যাযাবর জাতি হিসেবে নয়, কারো অধীনেও নয়, স্বাধীনভাবে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়তে চান তারা। আর এই অভিযানে তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্য পার্নি নেতা আর্সাসেস।

মাটির ফলকে ঘোড়ার পিঠে একজন পার্থিয়ান পুরুষ © British Museum

পার্থিয়ান গভর্নর অ্যান্ড্রাগোরাস সেলিউসিড শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে, চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে আর্সাসেস পার্থিয়া জয় করেন এবং একে একটি স্বাধীন অঞ্চলে পরিণত করেন, গড়ে তোলেন পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে ভারত ও চীন পর্যন্ত বিস্তৃত পার্থিয়ান সাম্রাজ্য, যার আরেকটি নাম আর্সাসিড সাম্রাজ্য।

খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য। © Britannica

বোঝাই যাচ্ছে, রাজা আর্সাসিডের নাম অনুসারেই সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছে। ‘আর্সাসেস’ নামটির উৎপত্তি প্রাচীন পারস্যের শব্দ ‘আর্সান’ থেকে, যার অর্থ ‘হিরো’। ‘হিরো বলতে আমরা বুঝি নায়ক, বীর কিংবা দৃঢ় চরিত্রের পুরুষকে। নিজের নামকে যথার্থই প্রমাণ করেছিলেন রাজা প্রথম আর্সাসেস। একটু একটু করে নিজেদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়িয়েছিলেন নতুন পার্থিয়ান পরিচয় লাভ করা পার্নিরা। খুব দ্রুতই তারা স্থানীয় পার্থিয়ানদের মাঝে মিশে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পার্থিয়ানরা মেসোপটেমিয়ার উর্বর সমভূমিসহ পুরাতন আকেমেনিড সাম্রাজ্যের সমস্ত প্রধান অঞ্চলগুলো জয় করে নিয়েছিলেন। আর সেই সাথে টাইগ্রিস নদীর উত্তর-পূর্ব তীরে অবস্থিত মেসোপটেমিয়ার টেসিফোন শহরটি পার্থিয়ানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়ে যায়। পূর্বে ব্যাক্ট্রিয়া থেকে পশ্চিমে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত বিস্তৃত এই শহরটি সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ছিলো।

আকেমেনিডদের সাথে পার্থিয়ানদের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তারা নিজেদেরকে আকেমেনিডদের বৈধ উত্তরসূরী বলে মানতেন। আকেমেনিডদের মতোই পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের প্রজারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পালন করতে পারতেন। তবে পার্থিয়ানদের মধ্যে পারস্যের প্রভাব বিদ্যমান থাকলেও গ্রীক প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি। শিল্প ও স্থাপত্য উভয় ক্ষেত্রে তো এই প্রভাব ছিলোই, এমনকি রাজা আর্সাসেস গ্রীক ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে। তাই ‘গ্রীক-প্রেমিক’ বলে ডাকা হতো পার্থিয়ানদেরকে।

পার্থিয়ান রাজার রৌপ্য মুদ্রা © World History

আর্সাসেসের গড়ে তোলা সাম্রাজ্যে বিপত্তি যে আসে নি, তা নয়। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে দ্বিতীয় আর্সাসেস রাজা হলে পার্থিয়া আবারো আক্রমণ করেন সেলিউকাস নিকাতোরের উত্তরসূরি তৃতীয় অ্যান্টিওকাস। কিন্তু তা ছিলো অবশ্য সাময়িক। অ্যান্টিওকাস দ্বিতীয় আর্সাসেসকে হত্যা না করে তাকে গভর্নর পদে বসিয়ে রেখে যান। আর এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ পার্থিয়ান অভিজাতরা দ্বিতীয় আর্সাসেসকে পদচ্যুত করে প্রিপেশিয়াসকে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রিপেশিয়াসের মৃত্যুর পর তার ছেলে ফ্রেটিস এবং ফ্রেটিসের মৃত্যুর পর আরেক ছেলে মিথ্রিডেটিস পার্থিয়ান রাজা হন। এই মিথ্রিডেটিসই ছিলেন শ্রেষ্ঠ পার্থিয়ান শাসক, যাকে সাইরাস দ্য গ্রেটের সাথেও তুলনা করা হতো। মিথ্রিডেটিসের সময়েই পার্থিয়ান সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ বিস্তার লাভ করে।

এরই মাঝে আস্তে আস্তে করে পার্থিয়ানদের প্রতিদ্বন্দ্বী এক পরাশক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে। হ্যাঁ, রোমান সাম্রাজ্যের কথাই বলছি। প্রথম দিকে সেলিউসিডদের ওপর রোমানদের আগ্রাসনে পার্থিয়ানদের সুবিধাই হয়েছিলো। সেলিউসিডদের সম্পূর্ণ অপসারণ পার্থিয়ান সাম্রাজ্যকে শান্তিপূর্ণ ও নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলো। তবে পরবর্তীতে এই রোমানরাই পরিণত হয় পার্থিয়ানদের শত্রুতে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে রোমান সেনাপতি মার্কাস ক্র্যাসাস লিসিনিয়াসের নেতৃত্বে পরিচালিত পার্থিয়ান অভিযানে পার্থিয়ানরা রোমানদেরকে খুব বাজেভাবে পরাজিত করেছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালেও পার্থিয়ানরা রোমানদের বিরুদ্ধে আরও একটি বড় বিজয় লাভ করে, আর্মেনিয়ায় মার্ক অ্যান্টনির সৈন্যদলকে পরাজিত করার মাধ্যমে। এরপর পার্থিয়ান ও রোমানরা একটি যুদ্ধবিরতিতে যায়। তবে তা ছিলো অস্থায়ী। কারণ উভয় সাম্রাজ্যই গ্রেট ইউরেশীয় প্রান্তরের প্রবেশদ্বার ও সেন্ট্রাল এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য মরিয়া হয়ে ছিলো।

পার্থিয়ান আর্কিটেকচারাল অলঙ্কার © World History

রোমানদের বিরুদ্ধে পার্থিয়ানরা তাদের শেষ বিজয়টি লাভ করে রোমানদের মূল দুর্গ নিসিবিসের নিয়ন্ত্রণ লাভের মাধ্যমে। তবে ততো দিনে তাদের শিরদাঁড়া আর মজবুত ছিলো না। রোমের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য। অবশেষে চারশো বছরের শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে সাসানীয়দের সাথে সংঘটিত হরমোজগানের যুদ্ধে, ২২৪ সালের ২৮ এপ্রিল।

খ্রিস্টপূর্ব ২৪৭ সাল থেকে খ্রিস্টপরবর্তী ২২৪ সাল পর্যন্ত ব্যাপ্তিকালের পুরোটা সময় জুড়েই পার্থিয়ান সাম্রাজ্য ছিলো প্রাচীন বিশ্বের এক অন্যতম প্রধান শক্তি। প্রাচীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম ও চীনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সিল্ক রোডের বাণিজ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে দীর্ঘ দিন টিকে থাকা এই সাম্রাজ্য নিয়ে কোনো চর্চা হয়ই না বললে চলে। প্রাচীন বিশ্বের এই সমস্ত সাম্রাজ্যের গৌরব পুনঃরুদ্ধারের দায়িত্ব এবার কিন্তু আমাদের হাতেই ন্যস্ত।

রেফারেন্স: