কিছুদিন আগেও রংপুর শহরের সালেক পাম্প সংলগ্ন রাস্তার পাশে একটা কবর দেখা যেতো। বর্তমানে কবরটি আর নেই। রাস্তা সম্প্রসারণের কারণে সম্প্রতি কবরটিকে স্থানীয় মুন্সিপাড়া কবরস্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে। রংপুরবাসীরা জানলেও দেশের অনেকেই হয়তো এই কবরের কথা শুনেননি কিংবা জানেননা। এই কবর সম্পর্কে আমারও জানা ছিলনা। সম্প্রতি রংপুর গিয়ে আমার ভগ্নীপতির (Motiur Rahman) মুখে প্রথম কবরটির কথা জানতে পারি। এই কবরটি হল- ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদের।

শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ ছিলেন মুঘল রাজ বংশোদ্ভূত। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম (রাজত্বকাল ১৭৮৮ খৃস্টাব্দ -১৮০৬ খৃস্টাব্দ) ছিলেন তাঁর বাবা শাকের উদ্দিন মুহাম্মদের আপন চাচাতো ভাই। শাকের উদ্দিন মুহাম্মদের আপন বড় ভাই নবাব নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং এর মেয়ে শাহজাদী চাঁদ বিবির সাথে শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদের বিয়ে হয়। নবাব নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং এর অপর মেয়ে শাহজাদী লাল বিবি ছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর (রাজত্বকাল ১৮০৬ খৃস্টাব্দ -১৮৩৭ খৃস্টাব্দ) এর স্ত্রী ও শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর (রাজত্বকাল ১৮৩৭ খৃস্টাব্দ -১৮৫৭ খৃস্টাব্দ) এর মা। সেই সূত্রে শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ ছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর এর খালু। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নবাব নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং হলেন বাংলার ঐতিহাসিক চরিত্র ‘নূরলদীন’। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ এর নূরলদীনই হলেন এই বাকের মুহাম্মদ। বাকের মুহাম্মদ বর্তমান রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ফুলচৌকি গ্রামে বসবাস করতেন। এই ফুলচৌকি গ্রামে তখন ক্ষমতাসীন মুঘল রাজ বংশের অনেক পরিবারেরই বসতি ছিল। নবাব নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং ছিলেন ইংরেজদের কথিত ফকির, সন্ন্যাসী ও প্রজা বিদ্রোহী দলের নেতা। জনমনে বিভ্রান্ত ছড়ানোর জন্য ইংরেজরা নবাবকে ডাকাত সর্দার হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এমনকি নবাবকে ফকির মজনু শাহ নামে অভিহিত করে আন্দোলনকে প্রশমিত করার অপচেষ্টা হয়েছে।

এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় হায়দার চৌধুরী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ গ্রন্থে, যা ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। বাকের মুহাম্মদ ১৭৮০-৯০ সালের মধ্যবর্তী কোন একসময় ইংরেজদের অতর্কিত আক্রমনে লালমনিরহাট জেলার মোগলহাটে গুরুতর আহত হন এবং পরে ফুলচৌকি গ্রামে মারা যান। নবাব নূর উদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং এর মৃত্যুর পর তাঁর দুইছেলে কামাল উদ্দিন মুহাম্মদ ও জামাল উদ্দিন মুহাম্মদ (বাহার নামেও সমধিক পরিচিত) ইংরেজদের বিরুদ্ধে গোপন লড়াই অব্যাহত রাখেন। তাঁর মেয়ে শাহজাদী লাল বিবিও ছিলেন বাবার মতোই ইংরেজ বিরোধী। তিনি তাঁর পিতৃগৃহ রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি এলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে গোপনে যোগাযোগ করতেন এবং কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করতেন। তবে বাকের মুহাম্মদের সন্তানদের এই গোপন ভূমিকার কথা ইংরেজদের অজানা ছিলনা। সম্ভবত ১৮৩২-৩৩ সালের দিকে শাহজাদী লাল বিবি ফুলচৌকি গ্রামে আসেন। তিনি ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের সাথে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হতে যাচ্ছিলেন; পথিমধ্যে রংপুরের নগর মীরগঞ্জ, বড় রংপুর, তামপাট ইউনিয়ন এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাঁর সাথে মারা যান রাজা ভবানী পাঠকও। যতদূর জানা যায়, ইংরেজরা এদেশীয় কিছু দোসরকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করে। যেখানে শাহজাদী লাল বিবিকে হত্যা করা হয়, সে জায়গাটি বর্তমানে সমর দিঘী নামে পরিচিত। তাঁর কবরও রয়েছে সেখানে। লাল বিবির হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভাই কামাল ও বাহার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন। কিন্তু ইংরেজরা সুকৌশলে কামালকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, আর বাহার মারা যান ইংরেজদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে।

শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ সম্পর্কে খুব কম ঐতিহাসিকই আলোকপাত করেছেন। তাই তাঁর সম্পর্কে যা জানা যায় তা খুবই সামান্য। পশ্চিমা কোন ঐতিহাসিকের লেখনীতে ওয়ালিদাদ সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়না। হতে পারে এদেশীয় কোন ব্যক্তির বীরত্বের কথা স্বভাবতই তাঁরা জানাতে আগ্রহী ছিলেন না। রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থের একাধিক জায়গায় ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আহমেদ ছফা রচিত ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ এর নাম পাওয়া যায়। তবে হায়দার চৌধুরী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ গ্রন্থেই ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায়। কারণ লেখক নিজেও ছিলেন ফুলচৌকি গ্রামের বাসিন্দা এবং খুব সম্ভবত মুঘল বংশের। ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লীর নিকটবর্তী মীরাট এলাকায় সক্রিয় ছিলেন। ইতিহাসে সিপাহী বিদ্রোহের একজন সহ-অধিনায়ক হিসেবে তাঁর নাম পাওয়া যায়। সিপাহী বিদ্রোহের ডামাডোল শেষ হলে ইংরেজরা এই বিদ্রোহে জড়িতদের খুঁজে নির্মূল করা শুরু করে। রংপুর অঞ্চলের বিদ্রোহ প্রশমিত হবার পর ইংরেজরা শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদকে ফুলচৌকি গ্রাম থেকে এক সহযোগী- গৌস উদ্দিন মুহাম্মদ (লাল বিবির ভাতিজা) সহ আটক করে। তাঁদের দুজনকেই হাতির পায়ের সাথে বেঁধে রংপুর নিয়ে আসার পথে বর্তমান কারমাইকেল কলেজের কাছে গৌস উদ্দিন মুহাম্মদ মারা গেলে, ইংরেজরা তাঁকে সেখানেই ফেলে রেখে চলে যায়। পরে স্থানীয়রা তাঁকে সমাহিত করে কবর পাকা করে দেন। রেল লাইন ধরে লালবাগ থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে সামান্য এগিয়ে গেলেই পরবে গৌস উদ্দিন মুহাম্মদের কবর। ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ মারা যান বর্তমান সালেক পাম্প সংলগ্ন স্থানে। ইংরেজরা তাঁর মৃতদেহ এখানে ফেলে রেখে গেলে স্থানীয় ফকিররা এই জায়গাতেই তাঁকে সমাহিত করেন। ১৫৭ বছর পর আবার নতুন করে এই বীর সিপাহীর শেষশয্যা পাতা হয় নগরীর মুন্সিপাড়া কবরস্থানে।