৩০০ খ্রিপূর সিন্ধু চুক্তি চন্দ্রগুপ্ত এবং প্রথম সেলুকাস নিকেটোরের মধ্যে|

প্রথম সেলুকাস নিকেটোর এবং প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা

৩২৩খ্রিপূতে ম্যাসিডোনিয়ার তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর আফ্রিকা এশিয়া জোড়া সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে তৈরি হয় আন্তিগোনের ম্যাসিডোনিয়া, টলেমির মিশর, আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের এশিয় সাম্রাজ্য। সেলুকাস(৩৫৮-২৮১ খ্রিপূ) বিশাল বাহিনী নিয়ে কয়েকবার হিন্দুকুশ পেরোবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কিছু বছরের মধ্যেই মন্ত্রী চাণক্যের কূট কৌশলে ভারতবর্ষে নন্দ সাম্রাজ্য ধ্বংস এবং বেশ কিছু গণ্যরাজ্য দখল করে ১৫০ বছরের মোর্য সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর(৩২০-২৯৭ খ্রিপূ) নেতৃত্বে। চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের মত উত্তরে সাম্রাজ্য বাড়াবার উদ্যম নেন।

সেলুকাস প্রথম নিকেটোর ইরাকের ব্যাবিলনিয়া এবং ব্যাক্ট্রিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন। আলেকজান্ডার যে অভিযানে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি সেই ভারতবর্ষ দখলে উদ্যমী হলেন। উত্তর আর উত্তর পশ্চিম ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি গণরাজ্য দখল করে সমগ্র উত্তর ভারতে রাজত্ব ছড়িয়ে দেওয়া চন্দ্রগুপ্ত বা সান্ড্রাকোটাসকে সিন্ধু নদের তীরে চ্যালেঞ্জ জানালেন প্রথম সেলুকাস। আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যর্থ হওয়ার কয়েক দশকের মধ্যেই ৩০৫ খ্রিপূতে প্রথম সেলুকাস সিন্ধু পেরিয়ে সমুদ্রের মত চন্দ্রগুপ্তের বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। যুদ্ধে কী ঘটেছিল সে সম্বন্ধে ইতিহাস আশ্চর্যজনকভাবে নীরব, কিন্তু দুই মহান সাম্রাজ্যের সীমানা হল সিন্ধু নদ। যুদ্ধে যাই ঘটে থাকুক না কেন দুই সম্রাট শান্তিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিন প্রাচীন ঐতিহাসিক জাস্টিন, আপ্পিয়ান আর স্ট্রাবো সূত্রে দুই সম্রাটের যে চুক্তি পত্রের বয়ান পাচ্ছি ইতিহাসে সেটা সিন্ধুর চুক্তি নামে খ্যাত। চুক্তির তিন শর্ত ছিল, ১। আলেজান্দ্রিয় এবং আর্কিমিডিয় সাম্রাজ্যের আগ্রাসন নীতি থেকে বেরিয়ে এসে সেলুকাস তার সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের গান্ধার, পারাপামিসাডাই(পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান), জেড্রোসিয়ার(বালুচিস্তান) পূর্বাঞ্চল, আরাকোসয়া(দক্ষিণ আফগানিস্তান) এবং হেরাট চন্দ্রগুপ্তের অধিকারে ছেড়ে দিলেন। ২। বিনিময়ে চন্দ্রগুপ্ত দিলেন ৫০০ যুদ্ধ হাতি। ৩। চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসিয় বংশের রাজকন্যা বিবাহ করলেন।

সেলুকাসের অঞ্চলের অধিকার ছেড়ে দেওয়া আর রাজকন্যা বিবাহ দেওয়ার বদলে যে ৫০০ যুদ্ধ হাতি উপহার পেলেন গ্রিসিয় ঐতিহাসিকদের ভাষায় সেটা ছিল বদলাবদলি(I take in return)। বিবাহের পণ হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত ঐ অঞ্চলগুলো পেলেন বদলে দিলেন হাতি। দক্ষিণে শান্তি স্থাপন করে সেলুকাস বিশ্বের সেরা বাংলার ৫০০ যুদ্ধ হাতি সম্বল করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এন্টিগোনাস মনোথ্যালমাস, সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জয় করতে উদ্যত হলেন। চন্দ্রগুপ্ত পেলেন ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমের একচ্ছত্র আধিপত্য। গ্রিসিয় ঐতিহাসিক ফাইলার্কাস জানাচ্ছেন চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে এক গোছা উপহার পাঠান তার মধ্যে প্রধান ছিল যৌনউত্তেজনা তৈরির ওষুধ। এছাড়া বাঘও পাঠান। এথেনিয়াস বলছেন চন্দ্রগুপ্তের পুত্র আমিত্রোকোটাস বা বিন্দুসার এন্টিওকাসের অনুরোধে মদ্য, ডুমুর এবং এক তার্কিক(সফিস্ট) পাঠান। এন্টিওকাস মজা করে উত্তর দিলেন The figs and sweet wine we will send you, but it is not lawful among the Greeks for a sophist to be sold। মাথায় রাখতে হবে চন্দ্রগুপ্ত বেশ কয়েকবার আলেকজান্ডারের স্মৃতিতর্পণ করেছেন। প্লুটার্ক বলছেন সান্ড্রাকোটাস দাবি করেছেন তিনি প্রথম যৌবনে আলেকজান্ডারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নিজেকে আলেকজান্ডারের সঙ্গেও তুলনা করতেন। তিনি যতবার বিতস্তা(গ্রিসিয় ভাষায় হাইপাসিস) নদী পার করেছেন প্রত্যেকবার তিনি প্রয়াত সম্রাটের সমাধিতে বলি প্রদান করে সম্মান জানিয়েছেন। যুদ্ধের ঘণঘটা পেরিয়ে তিন প্রজন্ম ধরে সেলুকাসিয় এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হবে। চন্দ্রগুপ্তের রাজধানীতে এলেন ইন্ডিকার লেখক মেগাস্থিনিস। বিশ্বজুড়ে পাওয়া গিয়েছে ইন্ডিকার ছিন্নপত্র। ইন্ডিকা এবং তৎকালীন বৌদ্ধ সাহিত্য সে সময় জানা বোঝার একমাত্র তথ্য সূত্র। প্রথম সেলুকাস শান্তি বজায় রাখলেও তার উত্তরাধিকারী তৃতীয় এন্টিওকাস বিশাল বাহিনী নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে আসেন – সে অন্য গল্প অন্য কোনও সময়।

সূত্র – পল কসমিন, ল্যান্ড অব এলিফ্যান্ট কিং; রাচেল মারিস সম্পাদিত দ্য গ্রিকো ব্যাক্ট্রিয়ান এন্ড ইন্ডো-গ্রিক ওয়ার্ল্ড