জ্যৈষ্ঠ বা অন্যান্য সময়ের গরমে দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা এই শতকে পা দিয়েও, বৈদ্যুতিক পাখা বা পানি ঠান্ডা করার যন্ত্রের কথা ভাবতেও পারেন না; তাদের ভরসা আদিকালের হাতপাখার বাতাস আর মাটির কলসের ঠান্ডা পানি।
যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন গোটা ভারতবর্ষ আর দেশের বিভিন্ন বড় শহরতলিতে যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা, যশোরে ব্রিটিশ আর সামর্থ্যবানরা আগেকার রাজ রাজাদের মতো হাতের টানা পাখা ব্যবহার করত, তাদের ঘরের সিলিংয়ে ঝুলত বিশাল টানাপাখা যা শীতল পাটি বা কাপড় দিয়ে তৈরি করা হত আর এটির শেষ প্রান্তে দিনে রাতে ক্লান্তিহীন দড়ি টানার জন্য ছিল ভৃত্য বা পাঙ্খা-বর্দার। সর্বদা মালিক ঘরেই থাকতেন কিংবা ঘরের বাইরে, ঘরে বসেই তারা তাদের ব্যাবসা বানিজ্যিক বিষয়ে আলোচনা করত, একারনে বেশিরভাগ সময় তারা বধির পাঙ্খা-বর্দারদের বেছে নিতেন। এতে করে তারা নিজেকে নিরাপদ ভাবতেন। স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়ে আলোচনা করতে পারতেন।
কখনো দড়িটি সিলিং থেকে ঘরের দেয়ালের একটি ছোট গর্ত দিয়ে চলে যেত ঘরের বাইরে। আবার অনেকের তো বাড়ির সীমানার বাইরে ছিল পাখা-ওয়ালাদের বসার জায়গা। যাতে ঘরের কোনো আলোচনা শুনতে এবং দেখতে না পারে। এই পাখাওয়ালারা সবাই সমাজের দরিদ্রতম গোষ্ঠীর মানুষ ছিল। তারা তাদের এই পরিসেবার জন্য যুতসামান্যই সম্মানি পেত।
এরপর ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও অনেক জায়গায় পাঙ্খা-বর্দারদের দেখা যেত। আমেরিকার দক্ষিণ রাজ্যগুলোতে বহু বাড়ির মালিকদের নিজস্ব পাঙ্খা-বরদার ছিল। ১৯ শতকের শেষদিকে বিদ্যুতের আগমন এবং বৈদ্যুতিক সিলিং ফ্যানের বিকাশ এই পেশায় জড়িতদের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে। যা তাদের আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়। বিংশ শতাব্দীতেও বেশ কিছু জায়গায় দেখা যেত এই টানা পাখা আর পাঙ্খা-বরদারদের।
বঙ্কিমচন্দ্র খেদ করে লিখেছিলেন ‘লাঠি তোমার দিন গিয়াছে’৷ তাঁর অক্ষম অনুকরণে বলা চলে: ‘টানা পাখা তোমার ও দিন গিয়াছে’।