আরাকানে ইসলামের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে হিন্দু 2016 শাসনামল চন্দ্র রাজবংশের সময় (৭৮৮-৯৫৭)। ইসলামের আবির্ভাবের মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আরাকানে ইসলাম প্রচার হয়েছিল। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মােহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলা জয় করেন। অবশ্য সমগ্র বাংলা জয় করতে আরাে ১০০ বছর ব্যয়িত হয়। দিল্লির প্রভুত্ব অস্বীকারের ক্ষেত্রে বাংলাকে অন্যতম অগ্রণী প্রদেশ বলা হয়। বলতে গেলে বলবনের বংশধরদের অধীনে বাংলা সম্পূর্ণ স্বাধীনই ছিল। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সময় আবার দিল্লির প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে বাংলাকে তিনটি শাসনতান্ত্রিক অঞ্চলে ভাগ করেন। সিংহাসনে বসেই তিনি মােহাম্মদ বিন তুঘলক কদর খানকে লখনৌতিতে, ইজদুদ্দীন আজমুল মুলুককে সাতগাঁয়ে এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহকে সােনারগাঁয়ে অধিষ্ঠিত করেন (১৩৩০)। শিগগিরই গিয়াসউদ্দিন রাজ বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। কিছু দিন পরই তিনি নিহত হলে বাহরাম খান সোনারগাঁয়ের একচ্ছত্র শাসক হন। বাহরাম খানের মৃত্যুর পর ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মােবারক শাহ পু বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করেন (১৩৪০ খ্রি:)।
তিনি ত্রিপুরাকে এ পরাজিত করে নােয়াখালীর দিকে অগ্রসর হয়ে আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করে নেন। আরাকান রাজ মেংদি ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবার চট্টগ্রাম অধিকার করেন। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা নরমেখলা সিংহাসনে আরােহণ। করেন। এ সময় আভার রাজপুত্র দ্বারা আরাকান আক্রান্ত হলে নরমেখলা এর রাজধানী লেঙি-এত’-এর পরাজয় ঘটে। নরমেখলা তখন গৌড়ের সুলতানের (১৩৮৯-১৪১০) আশ্রয় গ্রহণ করেন। ২৪ বছর গৌড়ে নির্বাসিত জীবনযাপন করার পর ১৪৩০ সালে তিনি সুলতান জালালুদ্দীন মাহমুদ শাহের (১৪১৮-৩১) সাময়িক সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।এ সময় বাংলার বহু সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি আরাকানে গমন করেন। মগরাজা নরমেখলা ঐতিহাসিক ১৪৩০ সালে ইসলাম সােলায়মান শাহ নাম ধারণ করে আবার আরাকানের সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে রাজা নরমেখলা স্বাধীন স্বীয় নামাঙ্কিত মুদ্রায় মুসলিম উপাধি, কলেমা, আরবি, ফারসি, রাখেন বাংলা লিপি ইত্যাদি গ্রহণ করে গৌড়ের সংস্কৃতির প্রতি স্বকীয় আনুগত্য প্রকাশ করেন। রাজা নরমেখলা ছিলেন ম্রা উক পদবি রাজবংশের প্রথম সুলতান। অতঃপর মুসলমানরা ১৪৩০ সাল আছে থেকে ম্রাউক রাজবংশের নামে দেশ শাসন করতে শুরু করেন দিল্লির মুসলিম শাসকদের অনুকরণে। পঞ্চদশ শতকের এই পুনর্জাগরণ আরাকানের ইতিহাসকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করে। এর ফলে আরাকানের শাসনব্যবস্থা সালতানাতের রূপ পরিগ্রহ রাজ করে এবং ইসলাম এ অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে।
নরমেখলার পদবি সাথে যেসব মুসলমান আরাকানে আসেন তারা ম্রোহাং’ নামক শাসন স্থানে সন্ধিক্ষন’ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় রাজসভাকে দেশে গৌড় আর দিল্লির অনুকরণে সাজানাে হয় এবং রাজা স্বয়ং পাদিশাহ (বাদশাহ) উপাধি ধারণ করেন। ফারসি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে স্বীকৃত হয়ে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। সরকারি মুদ্রা, পদক ও প্রতীক চিহ্নগুলােতে আরবি হরফে পবিত্র কালিমা এবং কুরআন শরিফের আয়াত ছাপানাের ব্যবস্থা গুহীত হয়। মক রাজবংশের অধীনে আরবি, ফারসি, রােহিঙ্গা থাকে এবং বর্মি ভাষা ও সাহিত্য দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এ সময় ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধ জনগােষ্ঠী ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়। এমনকি বৌদ্ধ রমণীরাও সে যুগে ইসলামের পর্দাপ্রথার চর্চা করত। নরমেখলার পরবর্তী রাজারা স্বাধীনতা অবলম্বন করলেন বটে। কিন্তু তারাও এ প্রথা অব্যাহত রাখেন। তার পরবর্তী ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ২১৫ বছর স্বাধীন আরাকানের রাজারা নিজেদের নামের সাথে একটি মুসলিম নাম পদবিরূপে গ্রহণ ও অনুরূপভাবে মুদ্রায় উৎকীর্ণ করার প্রথা হিসেবে প্রচলিত করেন। (জি. ই হার্ভে, হিস্ট্রি অব বার্মা, পৃ. ১৪০; জে. এ এসপি ভল্যুম ৮, নং ১, পৃ. ৬৫) আরাকানের রাজাদের মুদ্রার সংগ্রহ লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে। নরমেখলার ভাই মেনখরী (১৪৩৪-১৪৫৯) স্বাধীনতা অবলম্বন করেও আলী খা নামে নিজের পরিচয় প্রদান করেন। মেনখরীর রাজত্বকাল থেকে শুরু করে রােসাঙ্গ রাজ | নরপিদিগ্যির (১৬৩৮-১৬৪৫) পর্যন্ত ২০০ বছরের অধিক রাজত্বকাল পর্যন্ত রােসাঙ্গ রাজেরা মুদ্রায় মুসলমানি নাম ও পদবি ব্যবহার করতে থাকেন। অর্থাৎ তারা মুসলমান শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব, উৎকর্ষ, উদারতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই দেশে তারা মুসলমানি রীতি ও আদব-কায়দা অনুসরণ করেছেন।এ সময় সৈন্য বিভাগের প্রধান কর্মচারী থেকে শুরু করে শাসন বিভাগের প্রায় প্রতিটি বিশিষ্ট পদ মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত ছিলেন। এভাবেই পঞ্চদশ শতক থেকে রােসাঙ্গ রাজসভায় মুসলমানদের প্রভাব প্রবল হয়ে উঠতে থাকে।
আরাকানি সাহিত্যেও এ সময় ব্যাপক মুসলমানি প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ সময় আরাকানে মুসলিম পদবিধারী যেসবশাসক ছিলেন পূর্ববর্তী নাম এবং পরবর্তী পদবির একটি তালিকা প্রদান করা যেতে পারে। যেমন : নরমেখলা (১৪৩০- ৩৩) হলেন সাউ মং খান। এভাবে যথাক্রমে মঙ খারি (১৪৩৩-৫৯) হলেন আলি খান, বাসাউ পিউ (১৪৫৯-৮২) হলেন কলিম শাহ, মিঙ দাউ লিয়া (১৪৮২-৯৩) হলেন মউকু শাহ, সাউ নিউ (১৪৯৩-৯৪) হলেন মহামাউক শাহ, মিঙ রনঙ্গ (১৪৯৪) নুরী শাহ, থিঙ গাথু (১৪৯৪-১৫০১) কাউকদদৌলা শাহ, মিঙ রাজা (১৫০১-১৩) হলেন ইলিয়াস শাহ, ঘিরি থু (১৫১৫) জালা শাহ, খাজা তা (১৫১৫-২১) আলি শাহ, মিঙবাজী (১৫৩১-৫৩) যৌবক শাহ, মিঙ পালঙ্গ (১৫৭১-৯৩) সিকান্দর শাহ, মিঙ রাজগী (১৫৯৩-১৬১২), সলিম শাহ, মিঙ খামঙ (১৬১২-২২) হােসেন শাহ, থিরি বুধম্ম (১৬২২-৩৮) সলিম শাহ রেশ সানন্দেই বঙ্গ সংস্কৃতির অনুসরণ করেছেন। যুগ ও পরিবেশের এরূপ পটভূমিতেই কাজী দৌলত আলাওল, মাগন প্রভৃতি কবির আবির্ভাব হয়।
স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন রোসাঙ্গ ও ত্রিপুরার সামন্তসভায় বাংলা কাব্যের চর্চা Karim, ‘was chittagong ever a capital city?” Journal of the Asiatic society of Banlgadesh. Vol. xxx1 no : 1, June 1986, 12-13) মজার ব্যাপার হলাে, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দি, মঘী, কোনাে ভাষাই এ ধারার গতিরােধ করতে পারেনি। এভাবেই আরাকান এক সময় মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালনক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ বিষয়ে যারা আরো জানতে চান তাদের জন্য ডা, এনামুল হক এবং আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ রচিত আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সহিহ্যগন্থটি তথ্যানুসন্ধানীদের কিছুটা হলেও জানপিপাসা নিক করতে পারে বলে মনে হয়।