এসেস্কের ষ্টুর নদীর উত্তর তীরে ভিক্টোরীয় যুগের একটি পোড়ে বাড়ী ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কালের সাক্ষী স্বরূপ এই বাড়ীটির ভগ্নদশা দেখে জনমনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়। স্যাঁতসেতে ঘর-দুয়ার, ভাঙা দরোজা জানালা, এদিক সেদিকে আগাছার জঙ্গল — সব মিলিয়ে পরিবেশটি রীতিমত বিভীষিকাময় — দিনের আলোতেও এর পাশ দিয়ে চলতে গেলে গা ছমছম করে ওঠে। ইংল্যাণ্ডে সবার কাছে এটি একটি ভূতুরে বাড়ী বলে পরিচিতি। বাড়ীটিকে ‘বরলী রেক্টরী’ হিসেবে সকলেই চেনে।
শতাব্দীকাল ধরে এই বাড়ীটিতে এবং এর আশপাশে নানা ভুতুরে কাণ্ড ঘটে চলে। কখনও দেখা যায় বাড়ীর সম্মুখ ভাগের রাস্তা দিয়ে বেগে কোন ফিটন গাড়ী ছুটে চলেছে। কখনও চোখে পড়ে কোন এক ধর্মযাজিকা নির্জন এই ভূতুরে বাড়ীটিতে একাকী ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দেখতে পায় মুণ্ডহীন একটি লোক এই ধ্বংসপ্রায় বাড়ীর চত্বরে রহস্যময় ভাবে চলাফেরা করছে। কখনও আবার কোন লোকজনের দেখা নেই হঠাৎ শূণ্য থেকে বিভিন্ন জিনিস উড়ে এসে পড়ে। মনে হয় অদৃশ্য থেকে কেউ যেন এগুলো ছুড়ে ছুড়ে মারছে। মাঝে মাঝে রহস্যময় পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। হঠাৎ কোন জিনিস শূন্যের ভেতর দিয়ে কারো হাতের কাছে এসে পড়ে আবার আচমকা তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। টং টং করে হয়তোবা আচমকাই ঘণ্টা বেজে উঠলো — সকলকে অবাক করে আচমকাই আবার তা থেমে যায়। বাড়ীর দেওয়ালে কেউ যেন হিজিবিজি লিখে রেখে গেল, পর মুহূর্তে আবার কেউ যেন তা মুছে দিয়েও গেল। কাছাকাছি অবস্থিত বরলী গীর্জা থেকে প্রার্থনার সুর ভেসে আসে, অর্গানে সুরের মূর্ছনা শোনা যায়। বড় অদ্ভুত এইসব ব্যাপার স্যাপার।
১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে এই রেক্টরীটি রেভারেও হেনরী ডওসন এলিস বুল নামে একজন উপাচার্যের জন্য নির্মিত হয়েছিল। এটির অদূরে ছিল একটি মঠের অবস্থান। উপাচার্য তার স্ত্রী ও চৌদ্দটি সন্তান নিয়ে এই বাড়ীতে আগমনের পর থেকেই এখানে নানা ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। রাতের আধারে কে যেন দরজার কড়া নাড়ে , কে যেন ধীর পদক্ষেপে বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। বিচিত্র এইসব শব্দ তারা অহরহই শুনতে পেতেন। হঠাৎ হয়তোবা ঘণ্টা বেজে উঠলো, কিংবা কেউ যেন ফিস ফিস করে তাদের কানের কাছে কিছু বলে উঠলো। বাড়ীর সবার কাছে এ এক বিচিত্র আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা। ভয়ে সকলে সিঁটিয়ে রইলেন — দেহের রক্ত বুঝি তাদের হিম হয়ে আসে।
এক রাতে ডওসনের এক কন্যা গালে বিরাট এক চড় খেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অন্য এক মেয়ে দেখলেন একজন বৃদ্ধ লোক লম্বা একটি টুপি পরে কালো ছায়ার মত সমস্ত ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বাড়ীতে প্রায়ই একজন অতিথির আগমন ঘটতো। তিনি এলেই একজন ‘নান বা যাজিকার দেখা পেতেন। তার অর্থ এই যে, এরা কিন্তু কারো কোন রকম ক্ষতি করতো না। কিন্তু এ সব ভৌতিক ব্যাপার স্যাপার সকলের মনের মধ্যে এক অদ্ভুদ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো। তাদের স্নায়ুর উপর অত্যধিক চাপও পড়তো। ২৪ ঘন্টা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করা কী যে ভয়াবহ ব্যাপার – তা সহজেই অনুমেয়!
বৃটেনের ন্যাশনাল ল্যাবরেটারী অব সাইকোলজিকাল রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা হ্যারি প্রাইস এই ভূতুরে রেক্টরীর ঘটনাবলী সম্বন্ধে অনুসন্ধানের সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে আসেন। ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে তিনি ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় এই মর্মে একটি বিজ্ঞাপন দেন যে তার কিছু নির্ভিক ও উৎসাহী যুবকের প্রয়োজন। এই বিজ্ঞাপনে তিনি উল্লেখ করেন যে এই সকল উৎসাহী যুবক তাকে তার পর্যবেক্ষণে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। যুবকদের অবশ্যই সাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত ও পক্ষপাতহীন হতে হবে। এবং দোষ গুণ বিচারেও তারা হবে পারঙ্গম। সেই সঙ্গে তাদের থাকতে হবে প্রচুর অবসর। এর উত্তরে প্রায় দুইশত লোকের দরখাস্ত পড়লো। হ্যারি প্রাইস তাদের মধ্যে থেকে চল্লিশজনকে বেছে নিলেন।
এসব যুবক যথারীতি কাজ শুরু করলো। অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট এলিস হাওয়ে জিনিসপত্রের নড়াচড়া লক্ষ্য করলেন। বাকীরা জানালো যে তারা এমন সব গোলমালের শব্দ শুনছে যার ভাষা দুর্বোধ্য এবং দুজ্ঞেয়। বি, বি, সি, -র কমোডর এ, বি, ক্যাম্পবেল ব্রেইন্স ট্রাস্ট নামে এক অনুসন্ধানকারী তার দল নিয়ে সিলমোহর যুক্ত একটি কামরার দরজা খুলে ভিতরে গেলে তাকে ওখানে কেউ সাবান ছুড়ে মারে। এই দলের আর একজন সভ্য ছিলেন ডঃ সি . ই . এম . জোয়াদ। তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। তিনি জানান যে সে ঐ ঘরে প্রবেশ করার পর লক্ষ্য করা যায় যে, থার্মোমিটারের পারদ দশ ডিগ্রী নীচে নেমে যায়। এই অনুসন্ধিৎসু দলের সকলেই কিছু না কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনার সম্মুখীন হন।
এরপর ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে রেক্টরীটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই গৃহটিতে যেদিন আগুন ধরে সেদিন দুজন রহস্যময় লোককে এই বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে অনেকেই দেখতে পান। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই বাড়ীটিতে তৎকালীন মালিক গ্রেগসন ছাড়া আর কেউ বসবাস করতেন না। এ সব লোক কোথা থেকে আসলো আর তারা গেলই বা কোথায়? যারা দেখলো কেউই কি কাউকে চিনতে পারলো না? অনেকে জানান যে ঐ বাড়ীর কোন এক জানালায় তারা ঐ দিন একটি যুবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। কিন্তু বাড়ীতে আগুন লেগে পুড়ে গেলেও এই আশ্চর্য রকমের ভৌতিক ঘটনাগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। শোফার হার্বার্ড মায়ার্স শুনতে পেলেন অত্যন্ত বেগে ছুটে গেলে ঘোড়ার খুড়ের যে রকম শব্দ হয় ঠিক তেমনি বেগে কিছু যেন রেক্টরীর পাশ দিয়ে ছুটে গেল। দৃশ্যতঃ কোন কিছু তার নজরে পড়লো না। শব্দ শুনে তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্যাক আউট চলাকালীন মাঝে মাঝেই বাড়ীর জানালা গুলোতে দপ করে আলো জ্বলে উঠতো। কারণ অনুসন্ধানের জন্য এয়ার রেইড্ ওয়ার্ডেন ডেকে পাঠানো হতো। কিন্তু এ আলোর কোন হদিশ তারা খুঁজে পায়নি। ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে ঐ স্থানের মাটি খুঁড়ে দেখা হল। তিন চার ফিট গভীর গর্ত করার পরই শ্রমিকেরা একটি মেয়ে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় আবিষ্কার করলো। সেই হাড়গোড়ের সঙ্গে একটি ধর্মীয় চিহ্নযুক্ত লকেটসহ হারও পাওয়া যায়। পরবর্তী ১৯৬১ খৃষ্টাব্দে ঐ অঞ্চলে টর্চের আলো ফেলে, গাড়ীর হেড লাইট জ্বালিয়ে, ক্যামেরা ফ্ল্যাশ করেও বহু অনুসন্ধান চালানো হল। কিন্তু বৃথা। ঐ সব অতিপ্রাকৃত ঘটনা সম্বন্ধে কোন রকম অলোকপাত করাই গেল না। বরলী রেক্টরীর এ সব রহস্যময় ঘটনাবলী ঘটার কারণ উদঘাটনের জন্য বিভিন্ন ভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়।
এমন কি একদল অতি উৎসাহী যুবক যুবতী আত্মা আনারও ব্যবস্থা করেন। তারা এই আত্মা আনার মাধ্যমে জানতে পারেন যে সপ্তদশ শতাব্দীতে লী হার্ভের মঠে ফরাসী দেশীয় একজন ‘নান ‘ বা যাজিকা বসবাস করতেন। তার নাম ছিল মেরী লেইরী। বোরলীতে তখন ওয়েলগ্রেভ্স পরিবার বসবাস করতেন। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধনী। এই অবস্থাপন্ন পরিবারের এক যুবক মেরীকে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে মঠ থেকে বের করে আনে। আত্মার মারফতে তারা আরও জানতে পারেন যে মেরীর প্রেমিকটি পরবর্তীতে তাকে নিষ্ঠুরভাবে গলা টিপে হত্যা করে। সেই দিনটি ছিল ১৬৬৭ সালের ১৭ই মে। আর এই দুর্ঘটনাটি ঘটানো হয় এমন একটি বাড়ীতে যে স্থানে আজ রেক্টরীটি দাঁড়িয়ে আছে। মাধ্যমের মারফত পাওয়া সংবাদ অনুযায়ী আমরা জানতে পারি যে মৃতদেহটি ঐ বাড়ীর সেলারে প্রোথিত করা হয়েছিল। নানটির অতৃপ্ত আত্মা ঐ অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তার প্রতি নিদারুণ প্রবঞ্চনার প্রতিশোধ নিচ্ছিল কি ?