চট্টগ্রাম শহরের মোট ২৭টি স্থানের ঐতিহাসিক বর্ণনা আমরা দিয়েছি। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে আরো অনেক স্থান রয়েছে যা ইতিহাস সমৃদ্ধ। আমরা মনে করি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য জানতে হলে চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি স্থানের ইতিহাস জানা দরকার। কারণ প্রত্যেকটি স্থানের নামকরণের সাথে রয়েছে একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার বলে আমরা মনে করি।

সংক্ষিপ্ত সার
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। চট্টগ্রাম শিক্ষা, সংস্কৃতি, গ্রামীণ জীবন, লোকজ ঐতিহ্য, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি চট্টগ্রামের পরিচিত জনপদ দর্শনীয় স্থান, সংবাদপত্র, ভাষা ও সাহিত্য– সবকিছুতেই রয়েছে গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য ও ইতিহাস। আমরা আমাদের নিবন্ধে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও দর্শনীয় স্থানসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দিয়ে চট্টগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি। লক্ষণীয় বিষয় ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম এখনো সাধারণ মানুষের কাছে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে। এই ইতিহাস বিমুখতা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে আমাদের এই নিবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য।
চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন নগরী। প্রাচীন গ্রিক ও মিশরীয় ভৌগোলিকদের বর্ণনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের খ্যাতনামা গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির গ্রন্থ পেরিপ্লাসে ক্রিস নামে যে স্থানটির বর্ণনা পাওয়া যায় তাকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সাথে অভিন্ন বলে মত দিয়েছে ঐতিহাসিক ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী। অন্যদিকে ল্যাসন মনে করেন, পেন্টাপোলিস চট্টগ্রামেরই ক্ল্যাসিক্যাল নাম। এ বিষয়দ্বয়ের উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে হলে চট্টগ্রাম নগরী কত পুরানো তা জানা প্রয়োজন। এ অঞ্চলটিকে সুদীর্ঘ কাল থেকে অনেকে শাসন ও শোষণ করেছে এবং এখানে অনেকের আগমন–নির্গমন ঘটেছে। বলা বাহুল্য, চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে বহু দেশের ব্যবসায়ী এখানে এসেছে। বর্তমান গবেষণায় চট্টগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা চট্টগ্রাম শহরের কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
 
আগ্রাবাদ:
চট্টগ্রামের অভিজাত বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ। ১৬৬৬ সালে বুজুর্গ উমেদ খানের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী মগ–ফিরিঙ্গিদের পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করলে চট্টগ্রামে মোগল শাসনের সূচনা ঘটে। এ সময় মোগল বাহিনীর সাথে আগ্রা থেকে আসা সৈন্যরা এই এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করে এলাকাটিতে বসতি স্থাপন করে। তখন থেকেই আগ্রার সৈন্যদের আবাদ করা এ স্থানের নাম হয় আগ্রাবাদ। পরবর্তীকালে এলাকাটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের এক বিরাট অংশ আগ্রাবাদ থেকেই পরিচালিত হয়ে থাকে।
 
আন্দরকিল্লা: আন্দরকিল্লা নামের সাথে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী একসূত্রে গাথা। মগ–ফিরিঙ্গিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চট্টগ্রামবাসীর জান–মালের নিরাপত্তা বিধান এবং সুজা ও সুজা পরিবারের প্রতি আরাকানরাজের নির্দয় অপমায়ের প্রতিশোধ নিতে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তৎকালীন বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম বিজয়ের নির্দেশ দেন। শায়েস্তা খান তার পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে ‘চাট্‌গছা’ অভিযানের প্রধান সেনাপতি করে ৪,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য, সঙ্গে এডমিরাল ইবনে হোসেনের অধীনে ২৮৮ খানা যুদ্ধ নৌকা, গোলা–বারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে ১৬৬৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম অভিযানে প্রেরণ করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ দ্রুত ফেনী নদী পার হয়ে মগরাজ্যে ঢুকে পড়ে এবং জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করতে করতে অগ্রসর হন।

ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ

 
এ সময় সমুদ্রপথে এডমিরাল ইবনে হোসেন (নওয়ারার দারোগা) এবং স্থলপথে ফরহাদ খাঁ, মীর মর্তুজা, হায়াত খাঁ প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি জলযুদ্ধ ও স্থলযুদ্ধের পর ১৬৬৬ সালের ২৫ জানুয়ারি মোগল বাহিনী ‘চাট্‌গছা’ কিল্লা (চট্টগ্রাম দুর্গ) আক্রমণ করেন। পরদিন সব সৈন্য আত্মসমর্পণ করলে ইবনে হোসেন বীরদর্পে ঐ দুর্গ বা কিল্লায় প্রবেশ করেন। ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বুজুর্গ উমেদ খান কিল্লার অন্দরে (অভ্যন্তরে) প্রবেশ করেন এবং কিল্লার নাম দেন ‘আন্দরকিল্লা’। সে থেকে এলাকাটি ‘আন্দরকিল্লা’ নামে পরিচিত। ইংরেজ আমলে জরিপে এলাকাটিকে ‘মৌজা আন্দরকিল্লা’ নামে চিহ্নিত করা হয়। মোগলদের চট্টগ্রাম অভিযানের সময় তাদের সাথে চট্টগ্রাম আগমনকারী ঐতিহাসিক শিহাবউদ্দিন তালিশ ঐ দুর্গকে আলেকজান্ডারের দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য বলেছেন এবং তা কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত বলেছেন। ‘চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মগদের তৈরি কিল্লার ভিতরে ছিল’। ১ ‘টেম্পেস্ট হিলের উত্তর টেলিগ্রাফ অফিসের দক্ষিণে যে পাহাড়ের মত দেখা যায়, তা কৃত্রিম বাঁধ। সেরূপ রংমহালের পাহাড় ও জুমা মসজিদের মধ্যে আর একটি বাঁধ ছিল–এর মধ্যেই অবস্থিত ছিল মগদের প্রধান কিল্লা, যাকে বলা হত ‘চাট্‌গছা’র কিল্লা। মুসলমানদের অধিকারের পর চট্টগ্রামকে ইসলামাবাদ এবং এই কিল্লাকে বলা হত আন্দরকিল্লা। ফিরিঙ্গিবাজারের দুটি নদীর মোহনায় ছিল ‘বাহিরকিল্লা’।
 
আলকরণ: প্রাচীনকালে চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চলের জঙ্গলে বিপুল সংখ্যক গণ্ডার পাওয়া যেত। এসব গণ্ডারের শিং সংগ্রহ করে আলকরণ এলাকায় গুদামজাত করে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি করা হত। ‘আলকরণ’ অর্থ গণ্ডারের শিং। তা থেকে অনুমান করা যায় যে আমাদের নৌবাণিজ্য যুগে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে শহর চট্টগ্রামের আলকরণ এলাকায় গণ্ডারের শিংয়ের আড়ত ছিল। তারই স্মারকস্বরূপ পরবর্তীকালে এলাকাটি আলকরণ নামে খ্যাত হয়।’
 
আসকার দিঘি:

আসকার দিঘির বর্তমান অবস্থা

চট্টগ্রামের দ্বিতীয় মোগল শাসনকর্তা আসকর খাঁ (১৬৬৯–১৬৭১) এই দিঘিটি খনন করেন। তার নামানুসারেই জামালখান এলাকায় অবস্থিত এই দিঘির নাম হয় আসকার দিঘি। জনশ্রুতি আছে, কোট বিল্ডিংস্থ পরীর পাহাড়ের পরীরা একসময় এই দিঘিতে স্নান করত। তাই এই দিঘিকে অনেকে পরীর দিঘিও বলেন। দিঘিটির এখন আর সেই সুদিন নেই। দিঘির চার পাড়ই এখন বেদখলে চলে গেছে।
 
ওয়ার সিমেট্রি:

ওয়ার সিমেট্রী

মহানগরীর চারুকলা কলেজ রোডে (বর্তমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউট) পাহাড়ের কোলে অবস্থান করছে ওয়ার সিমেট্রি–দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেইভস কমিশন। মনোরম পরিবেশে এ স্থানে অন্তিম শয়ানে শায়িত আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে বার্মা ফ্রন্ট অবধি নিহত ৭৫০ জন বীর সৈনিক। এসব সৈন্যের মধ্যে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, আফ্রিকা, বার্মা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অধিবাসী রয়েছেন।
 
কৈবল্যধাম: চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী এলাকায় ১৮ একর পাহাড়ি জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত শতাব্দী প্রাচীন হিন্দুতীর্থ কৈবল্যধাম মন্দির। ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী জাতিস্মর শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর ১৮৩১ সালে এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাম ঠাকুর সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, বাল্যকালে তিনি কবি নবীন চন্দ্র সেনের রন্ধনশালার পাচক থাকাকালে কবি একদিন দূর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে গেলে রাম ঠাকুর তার সাথে যাওয়ার আবদার করে। কিন্তু কবি তাকে ধমক দিয়ে না করেন। অথচ কবি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেন, রাম ঠাকুর সেখানে পূর্বেই উপস্থিত হয়ে আছেন। এর পর তিনি নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরলে রাম ঠাকুরকে পূর্ববৎ আগের অবস্থানে দেখতে পান, যা তাকে আরো বিস্মিত করে।

কৈবল্যধাম

কৈবল্যধামের দক্ষিণ–পূর্বকোণে পাহাড়ের নিম্নভাগে একটি ছোট অগভীর জলাশয় আছে, এতে নাকি গভীর রাতে দেব–দেবীরা স্নান করত। রাম ঠাকুর কৈবল্য ধামে একটি বটবৃক্ষের (কৈবল্য শক্তি) নিচে তিন দিন তিন রাত ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এই সময় স্থানটি তার পছন্দ হলে তিনি এখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে এই এলাকা কৈবল্যধাম নামে পরিচিতি লাভ করে।
 
কমলদহ দিঘি: কমলদহ দিঘির উৎপত্তি সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটি এরূপ : রাজারামের চারপুত্র ছিল। যুথরায়, দুর্গারায়, শ্যামরায় ও চাঁদরায়। এদের মধ্যে যুথরায় ও শ্যামরায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। একদিন চট্টগ্রামের মোগল শাসনকর্তা অলিবেগ খাঁ রাজারামের বাড়ি পরিদর্শনে গেলে তিনি শ্যামরায়ের ক্ষমতা, যশ ও খ্যাতির কথা জানতে পারেন। তখন নবাব অলিবেগ শ্যামরায়ের যশ ও ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য শ্যামরায়কে এক রাতের মধ্যেই নবাবের বাসস্থানের সামনে একটি দিঘি খনন করে সেখানে কমল বা পদ্ম দেখাতে বলেন। সে অনুযায়ী শ্যামরায় ঐ রাতেই দিঘি খনন করে দিঘির পাশ দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদী থেকে পানি এনে তা পূর্ণ করেন এবং কমল ফুল সংগ্রহ করে তা দিঘিতে ভাসিয়ে দেন। পরদিন প্রভাতে নবাব অবাক বিষ্ময়ে দেখেন তার বাস্থানের পাশেই একটি বিশাল দিঘি, সেখানে ভাসছে কমল ফুল। এভাবেই শ্যামরায় নবাবের কাছে ক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
 
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, নবাব অলিবেগ খাঁ (১৭১৩–১৭১৮) চকবাজারে তার নির্মিত অলি খাঁ জামে মসজিদের মুসল্লিদের ওজু করার সুবিধার জন্য মসজিদ সম্মুখে কমলদহ দিঘি খনন করেন। তখন এতে কমল ফুটত বলে দিঘিটির নামকরণ হয় কমলদহ দিঘি। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ঐতিহ্যবাহী দিঘিটি এখন আর নেই। দিঘিটি ভরাট করে ‘আনিকা কমিউনিটি সেন্টার’সহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
 
কাটগড়: পতেঙ্গার কাটগড়ের নামকরণ হয় সম্ভবত শাহ সুজার নামধারণকারী ‘সুজা কাটগড়’ থেকে। জনশ্রুতি আছে, শাহ সুজার অবস্থানকালের এখানে একটি সেনানিবাস ছিল। ‘চট্টগ্রামের সুজা আসিয়াছিলেন বলিয়া একটি জনপ্রবাদ অনেকদিন যাবৎ প্রচলিত আছে এবং শহরের বুকের উপর সুজা কাটগড় নামে একটি মৌজা ও দৃষ্ট হয়।
 
কাতালগঞ্জ: কাতালগঞ্জ এলাকাটি একসময় চট্টগ্রামে ইংরেজদের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত। মীর কাসিম ১৭৬০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কোম্পানির সাথে সন্ধির শর্তানুসারে চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিলে ১৭৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি কোম্পানির কর্মকর্তা হ্যারি ভেরলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করে একে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন কাতালগঞ্জের পর্তুগীজ বিল্ডিং ও ভাঙ্গনঘুটায় স্থাপন করা হয় তাদের প্রথম প্রশাসনিক সদর দপ্তর।
চট্টগ্রামের প্রথম ছাপাখানা (মুদ্রণযন্ত্র) বা প্রেসটিও স্থাপিত হয় কাতালগঞ্জের ভাঙ্গনঘুটায়। রাজদূত বলে খ্যাত রায় বাহাদুর শ্রী শরৎচন্দ্র দাস ও তাঁর ভাই কবি গুণাকর নবীনচন্দ্র দাস চট্টগ্রাম থেকে একটি সংবাদপত্র বের করার লক্ষ্যে প্রেসটি স্থাপন করেন। অবশ্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল কি–না জানা যায়নি। কথিত আছে, হযরত কাতাল পীরের নাম অনুসারেই এলাকাটির নাম হয় কাতালগঞ্জ। পাঁচলাইশ থানার সম্মুখে মুরাদপুরগামী হাটহাজারী রোডের পাশে তাঁর মাজার রয়েছে।
 
ঘাটফরহাদবেগ: নবাব ফরহাদ খাঁ ১৬৭৮–১৬৭৯ সময়ে ঘাটফরহাদবেগে জনবসতি গড়ে ওঠে। ফরহাদ বেগের সাথে ঘাট যুক্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে উক্ত এলাকার পূর্ব পাদদেশ ঘেষে কর্ণফুলী নদী প্রবাহিত ছিল এবং এলাকার জনগণ পানি ব্যবহারের জন্য ঘাট দিয়েছে কর্ণফুলীতে। তাই ফরহাদবেগ নামের সাথে ঘাট যুক্ত হয়ে ঘাটফরহাদবেগ নাম হয়। ঘাটফরহাদবেগ নামটি আজো ফরহাদ খাঁ’র স্মৃতি বহন করছে।
 
চকবাজার: অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল ছিল চকবাজার। অভিজাত লোকের বসতি ছিল এখানে। জনশ্রুতি আছে এই শহর ধীরে ধীরে উত্তর দিকে সমপ্রসারিত হয়। ওয়ালী বেগ খাঁ চকবাজারের ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করে। যা ওয়ালী বেগ খাঁ মসজিদ নামে পরিচিত।
 
চেরাগি পাহাড়: চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান ও মোমিন রোডের সংযোগ স্থলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মারকস্তম্ভ। ৫৪ ফুট উঁচু এবং নিচের দিকে ৪৬ মিটার ব্যাসের এই স্মারকস্তম্ভটি ১৬টি পিলারের উপর দণ্ডায়মান। স্তম্ভটির শীর্ষে মিনার, নিচে বাগান এবং ভেতরে সিঁড়ি রয়েছে। অনেকটা চেরাগ আকৃতির এই স্তম্ভটিকে বলা হয় ‘চেরাগি পাহাড়’ এই পাহাড়টি অতীতে বর্তমান আকৃতির ছিল না। এটি প্রাচীনকালে ডিসি হিলেরই অংশ ছিল। এর সাথে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামবাসীর আবেগ। চট্টগ্রামের পরিচয়বাহী এ স্থানটি একটি দর্শনীয় স্থানও বটে।
কিংবদন্তি আছে, আজ থেকে ৬৫০ বছর আগে হযরত বদর পীর ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে সুদূর আরব দেশ থেকে চট্টগ্রাম আসেন। জনশ্রুতি আছে, তখন তিনি একটি পাথরের উপর আসীন হয়ে পাথরঘাটা এলে পাথরটি থেমে যায়। তখন তিনি পাথর থেকে নেমে একটি চেরাগ হাতে গভীর বন জঙ্গলে ভরা জ্বিন–পরীর আবাসস্থলের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে এই এলাকার জ্বিন–পরীরা তাঁকে বাধা দেয় এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলেন। তিনি ঐ এলাকায় থাকতে চাইলে তারা তাকে সামান্য জায়গাও ছেড়ে দিতে অপারগতা জানায়। অবশেষে দীর্ঘ বাক–বিতণ্ডার পর একটি চাটি বা চেরাগ রাখার মতো জায়গায় ইবাদতের সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে। সমঝোতা অনুযায়ী, তিনি চেরাগ জ্বালিয়ে আজান দিতে শুরু করলে চেরাগের রোশনাই ও আজানের ধ্বনিতে জ্বিন–পরীরা পালাতে শুরু করে। চেরাগিপাহাড় থেকেই তাঁর আধ্যাত্মিক বিজয়ের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে বদর শাহের চেরাগ রাখার এই পাহাড়টি ‘চেরাগিপাহাড়’ নামে খ্যাত হয়।
অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, চেরাগি পাহাড় নামটি আরাকানী ‘চারেগ্রীটং’ নামের অপভ্রংশ। আরাকানী ভাষায় ‘চারেগ্রী’ অর্থ প্রধান হিসাবরক্ষক এবং ‘টং’ অর্থ পাহাড়। সে হিসেবে চারেগ্রীটং অর্থ প্রধান হিসাবরক্ষকের পাহাড়। ধারণা করা হয়, মগ আমলে এ পাহাড়ে চারেগ্রী’র বাসস্থান ছিল।
জেটি তালাও–আগ্রাবাদ ডেবা : আগ্রাবাদ বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের পেছনে বিশাল জলরাশি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে একটি দিঘি। একসময়ের ‘জেটি তালাও’ নামে পরিচিত এ দিঘিটি সাধারণ্যে ‘আগ্রাবাদ ডেবা’ নামে পরিচিত। ৬৪ একরের বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে এ দিঘিটি খনন করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। বর্তমানে এর পানিপূর্ণ এলাকার পরিমাণ ১৯ দশমিক ৭৮ একর। সেই সময় চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বন্দর পর্যন্ত রেললাইন সমপ্রসারণ করতে গিয়ে মাটির প্রয়োজন হলে মাটি সংগ্রহের জন্য আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের উদ্যোগে খুঁড়ে ফেলা হয় এ এলাকাটি। তখন এ এলাকাটি একটি বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়। পরবর্তীকালের এটি থেকে পানি সরবরাহ করা হত রেলের স্টিম ইঞ্জিনে, জেটিতে এবং আবাসিক এলাকায়। ডেবাটিকে অনায়াসে পর্যটনের আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা যায়।
 
টাইগারপাস:

টাইগারপাস

টাইগার এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এখানে মামা ভাগ্নে’র পীর নামে দু’জন সাধক বাস করতেন। তারা সার্বক্ষণিক সাধনায় রত থাকতেন। দুটি বাঘ তাদের পাহারা দিত। কিন্তু মানুষের কোন ক্ষতি করত না। পরবর্তীকালে পীরদ্বয় মারা গেলে বাঘগুলো ঐ এলাকার পাস দিয়ে চলে যায়। পরবর্তীকালে অনুসন্ধানে জানা যায় সাধক পুরুষদ্বয়ের নাম শাহ জামাল ও শাহ কামাল। সম্পর্কে মামা–ভাগ্নে। তারা ৩৬০ জনের সঙ্গে সফরসঙ্গী হয়ে সুদূর আরব থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। বাঘ চলাচল করতো বলে অনেকে এলাকাটির নাম দিয়েছেন টাইগারপাস।
 
ডবলমুরিং: ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মাণ করেন বন্দর সংলগ্ন এলাকায়। ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশরা বন্দরটি বাড়ানোর লক্ষ্যে একে পোর্ট কমিশনার আইন প্রণয়ন করলে ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল তা কার্যকর হয়। এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি স্থায়ী মুড়িং নির্মাণ করা হয়। তখন থেকে এলাকাটির নাম ডবলমুরিং।
 
নাসিরাবাদ : ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯৪৫ সালে নাসিরাবাদের কাঁহারপাড়ায় সংঘটিত ঘটনার জের হিসেবে ‘সেনাজুলুম বিরোধী সংগ্রাম’ কালে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ–মিছিল হয়েছিল। সুলতানি আমলে ১৪৩৩ সালে গণেশ বংশীয় সুলতান জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ মৃত্যুমুখে পতিত হলে তৎপুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ সিংহাসনে বসে ২–৩ বছর রাজত্ব করেন। এই সময় তার দুই ক্রীতদাস সিংহাসন দখল করার লক্ষ্যে তাকে হত্যা করে পারস্পরিক ক্ষমতা প্রতিযোগিতা শুরু করে। এ সময় আমির–ওমরাহরা ত্যক্ত–বিরক্ত হয়ে সিংহাসনে বসানোর জন্য ইলিয়াস শাহী বংশের লোকদের খুঁজছিলেন।
 
রাজা গণেশ কর্তৃক ইলিয়াছ শাহী বংশের উৎখাতের ফলে ঐ বংশের অনেকে গণেশের অত্যাচার–নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পালিয়ে গিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেন। এই সময় খুব সম্ভবত নাসির উদ্দিন রাজধানী থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় আশ্রয় নিয়ে নির্বাসন জীবন শুরু করেন। রাজ–অমাত্যরা তাকে ১৪৩৬–৩৭ সালের দিকে এই এলাকা থেকে খুঁজে বের করে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। সিংহাসনে বসে তিনি নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ নাম ধারণ করেন এবং প্রায় সিকি–শতাব্দীকাল (১৪৩৭–১৪৫৯) রাজত্ব করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর নামেই নাসিরাবাদ এলাকার নামকরণ।
 
পতেঙ্গা : সাগর বিধৌত একটি প্রাচীন গ্রাম পতেঙ্গা। তার পাশেই রয়েছে কর্ণফুলীর মোহনা। এখন পতেঙ্গা গ্রাম নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছে পর্যটন এরিয়া ও বিমানবন্দরের জন্য। জনশ্রুতি আছে, সমুদ্র তীরবর্তী এ এলাকাটিতে প্রাচীনকালে আরব বণিকদের সাথে পর্তুগীজদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

পড়ন্ত বিকেলে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত

এই যুদ্ধে আরব বণিকরা জয়লাভ করলে তারা তৎকালীন ঐ গ্রাম্য এলাকাটির নাম দেন ‘ফতেহ্‌ গাঁ’। আরবি ‘ফতেহ’ অর্থ বিজয়; আর ‘গাঁ’ অর্থ গ্রাম। তাদের বিজিত এই গ্রামটি কালের বিবর্তনে পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘পতেঙ্গা’।
 
পাঠানটুলী: পাঠানদের আগমন ও এ অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের কারণে এলাকাটির নাম পাঠানটুলী। মূলত: প্রাচীনকালে মুসলমানদের চট্টগ্রাম বিজয়কালে পাঠানদের আগমন ঘটে। ১৫৩৮ সালে সম্রাট শেরশাহের সময়ে এ ধারা আরো বেগবান হয়। ১৩৩৮ সালে মূলত: পাঠানরা প্রথম চট্টগ্রাম আসেন। পাঠানরা স্বাধীনচেতা। ইংরেজরা পাঠানদের সহ্য করতে পারতেন না। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৮৬০ সালে পাঠানটুলী এলাকায় পাঠানদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবে বলে গণহত্যা চালায়। স্থানটি ছিল লালদীঘি মাঠ সংলগ্ন। এই গণহত্যায় নারী শিশুরা পর্যন্ত রেহায় পায়নি।
 
ফয়’স লেক: চট্টগ্রামে এটি একটি মানুষের তৈরি কৃত্রিম লেক। ১৮৫০ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ইংরেজ প্রকৌশলী মি. ফয়– এর উদ্যোগে রেলওয়ে কারখানা স্টেশন সহ বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের মাঝে বাঁধ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। পরবর্তী কালে তাঁর নামানুসারে লেকটির নামকরণ করা হয় ফয়’স লেক।

ফয়েজ হ্রদ

পর্যটন এরিয়া হিসেবে এটি চট্টগ্রামে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এলাকা। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী এলাকায় ৮৩০ একর জায়গা জুড়ে এটি অবস্থিত। বর্তমানে এখানে চিড়িয়াখানা ও পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে।
 
বদরপাতি : বদর পীরের নামানুসারে বদরপাতি স্থানের নামকরণ করা হয়। বদরপাতি (বদর পীর) উক্ত স্থানে আজও শায়িত আছেন।

বদর আউলিয়ার মাজার

‘চট্টগ্রামের বদরপাতিস্থ বদরশাহের সমাধি ভবন পরীক্ষা করে আমাদের মনে হয়, বদরশাহ চট্টগ্রামেই সমাহিত আছেন, বদরপাতিস্থ মাজার নেহায়েৎ জওয়াব বা কৃত্রিম সমাধি নয়’।
 
বহদ্দারহাট : প্রাচীনকালে সমুদ্রের অংশ ছিল বহদ্দারহাট। ক্রমে এতে চর জাগতে শুরু করে এবং লোকালয় গড়ে ওঠে। পঞ্চাদশ শতাব্দীতে এই এলাকায় ধর্ম প্রচার করতে ওমান থেকে সমুদ্র পথে আসেন ‘রৌশন’ ও ‘সানচিন’ নামে দুই সহোদর ভাই। তারা এলাকায় এসে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে বলে তারা পরিচিত হন বহদ্দার হিসেবে। আরবীতে ‘বহর’ অর্থ সমুদ্র ‘দার’ অর্থ মালিক। তারা বহদ্দার বাজারে খাজনা আদায় করতেন।
 
বক্সিরহাট: বাংলাদেশের ওয়ার্ল্ডস্ট্রিট খ্যাত খাতুনগঞ্জের ৩৫ নং ওয়ার্ডের নাম বঙিরহাট। মোগল আমলে পদস্থ অফিসার মীর বক্‌শি আবদুল হামিদ এর নামে ওয়ার্ডের নামকরণ করা হয় বঙিরহাট। পরবর্তীকালে সমুদ্র দক্ষিণ দিকে সরে গেলে ক্রমে খাতুনগঞ্জ, পাথরঘাটা ও চাক্তাইসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জেগে ওঠে। এলাকাটি জনবহুল এবং চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা। কারণ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ এলাকা থেকে বাণিজ্য করা হতো। এই এলাকা এখনো জমজমাট।
 
বাকলিয়া: আরবি বাকিল্লাহ থেকে বাকলিয়া নামের উদ্ভব। বাকিল্লা মানে সবজিক্ষেত। প্রাচীনকালে শুলকবহর আরবদের নৌপোতাশ্রয়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ অংশে কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে চর জাগলে স্থানীয় লোকেরা সেখানে সব্‌জি বা তরি–তরকারির ক্ষেত করতেন।
 
বাটালি হিল জিলেপির পাহাড়: টাইগারপাস এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রামের ‘সিংহদুয়ার’ নামে পরিচিত বাটালি হিল চট্টগ্রাম শহরের নয়নাভিরাম উঁচু পাহাড়গুলোর একটি। দেওয়ানহাট ব্রিজের যেকোনো পয়েন্ট থেকে ৫০০ ফুট উঁচু এ পাহাড়টি সহজেই সবার চোখে পড়ে।

বাটালী হিল

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের এ পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করা হয়েছিল বিমানবিধ্বংসী কামান। পাহাড়টির চূড়া থেকে কর্ণফুলীর মোহনা, বঙ্গোপসাগরসহ চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা দেখা যায় বলে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী এখানে ভিড় জমায়। জনশ্রুতি আছে, ‘প্রাচীনকালে জোয়ারের সময় বাটালি হিলের গোড়ায় বসে কর্ণফুলী থেকে সোন্দরা বাইলা ও পাঙ্গাস মাছ ধরা হত। তখন আগ্রাবাদ প্রভৃতি এলাকা ছিল ডুবন্তচর।
 
বায়েজিদ বোস্তামির পুকুর ও দরগাহ: জনশ্রুতি আছে, হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) তার পীরের আদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য পূর্ব ইরানের সুদূর বোস্তাম শহর থেকে সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম এলে নাসিরাবাদের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের চূড়ায় আস্তানা গড়ে তোলেন এবং এবাদত বন্দেগিতে মশগুল হন। এ সময় কিছু সংখ্যক দুষ্ট প্রকৃতির জ্বিন তার এবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে তিনি তাদের গজারী (গজাল মাছ) এবং মাদারীতে (কাছিম জাতীয় প্রাণী) পরিণত করে পাহাড়ের পাদদেশের জলাধারে বেঁধে রাখেন।

পুকুরসহ বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার

এ জলাধারটিই হযরত বায়েজিদ বোস্তামির পুকুর নামে প্রসিদ্ধ। এ পুকুরে এখনো মাদারীর (কচ্ছপের) বংশ বিদ্যমান, যদিও সেখানে গজারীর বংশ বিরল। পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি মসজিদ, যা সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বুজুর্গ উমেদ খাঁর মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়। পাহাড় শীর্ষে হযরত বায়েজিদ বোস্তামির এবাদতের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে একটি স্মারক দরগাহ।
 
ভেলুয়ার দিঘি : গৌড়ের সুলতান নসরত শাহের আমলে যমুনা তীরে চাঁদ সওদাগর নামে এক ধনী ব্যবসায়ী বাস করতেন। তার পুত্র আমির সওদাগরের স্ত্রীর নাম ছিল ভেলুয়া সুন্দরী। ভেলুয়া অপরূপ সুন্দরী ছিল যে, তাকে যে কেউ দেখলে হুঁশ হারা হয়ে যেতেন। চট্টগ্রামের এক সওদাগর সেখানে বাণিজ্য করতে গেলে ভেলুয়া সুন্দরীর চমৎকার রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে যান এবং তাকে চুরি করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন।

ভেলুয়ার দীঘি

স্ত্রী–হারা আমির সওদাগর স্ত্রী শোকে পাগল হয়ে চট্টগ্রামের সওদাগরের সাথে লড়াই করতে উদ্যত হয়। বিষয়টি নসরত শাহ অবগত হলে তিনি চোর সওদাগরের বিচারের ব্যবস্থা করেন। বিচারে তার শিরশ্ছেদের আদেশ হয় এবং স্থাবর–অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। এই সময় সুলতান নসরত শাহের আদেশে চট্টগ্রামী ঐ সওদাগরের বাজেয়াপ্ত বাড়িতে একটি দিঘি খনন করে দিঘিটির নাম দেয়া হয় ‘ভেলুয়ার দিঘি’।
 
ষোলশহর : আরবি ‘সাহলে শহর’ থেকে ষোলশহর নামের উৎপত্তি। ‘সাহলে শহর’ মানে নদী তীরবর্তী শহর। প্রাচীনকালে ষোলশহরের পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদী প্রবাহিত ছিল, (আরবেরা যাকে ‘গঙ্গা’ মনে করতেন)। তখন বণিকরা এই এলাকায় পণ্য বেচাকেনা করতেন।
 
হালিশহর : হালিশহর নামটি এসেছে ‘হাওয়ালে’ শহর থেকে। ‘হাওয়ালে’ আরবি শব্দ, এর অর্থ ‘উপকণ্ঠ। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাচীনকালে আরব, চীনা, তুর্র্কি, সিংহলী বণিকরা চট্টগ্রাম এলে এই এলাকায় স্বল্প সময়ের জন্য আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং এই এলাকাকে ‘হাওয়ালে শহর’ নামে অভিহিত করতেন। তা–ই পরবর্তীকালে বিবর্তিত হয়ে হালিশহর নামের উদ্ভব ঘটায়।
 
চট্টগ্রাম শহরের মোট ২৭টি স্থানের ঐতিহাসিক বর্ণনা আমরা দিয়েছি। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে আরো অনেক স্থান রয়েছে যা ইতিহাস সমৃদ্ধ। আমরা মনে করি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য জানতে হলে চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি স্থানের ইতিহাস জানা দরকার। কারণ প্রত্যেকটি স্থানের নামকরণের সাথে রয়েছে একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার বলে আমরা মনে করি।
উল্লেখপঞ্জি
১। সৈয়দ মর্তুজা আলী, বাংলাদেশের স্থানীয় নামের ইতিহাস, প্রকাশক– ম্যাগনাম ওপাস, ঢাকা।
২। চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববম্মা, চট্টগ্রামের ইতিহাস, পৃ – ৬০।
৩। আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। মে, ১৯৮৮। পৃ– ২০০)
৪। চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববম্মা, চট্টগ্রামের ইতিহাস, পৃ–৪৭
৫। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ইসলামাবাদ, সম্পাদনা সৈয়দ মুর্তাজা আলী, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৬৪ ঢাকা। পৃ–৮২
৬। ওহিদুল আলম, চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল, ১৯৮২, পৃ–৪২
৭। আব্দুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলামি ঐতিহ্য, জ্ঞানলোক প্রকাশনী, ২০০২, পৃ–৫
৮। শরীফ রাজা, দেশ দেশান্তর, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫।
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১। চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববম্মা, চট্টগ্রামের ইতিহাস (অখণ্ড), ১৯২০ গতি ধারা পুন:প্রকাশ ২০০৪
২। আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। মে, ১৯৮৮
৩। হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা। নভেম্বর ১৯৯৫
৪। আহমদ শরীফ, চট্টগ্রামের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০০১
৫। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ইসলামাবাদ, ১৯৬৪
৬। কালধারা (শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন), ডিসেম্বর, ১৯৯৭
৭। মোহাম্মদ নুরুল হক এম. এ, বৃহত্তর চট্টল, ১৯৯৭
৮। আবদুল হাফিজ, বাংলাদেশের লৌকিক ঐতিহ্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৫
৯। মিসবাহ উদ্দিন খান, চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস, ৩য় মুদ্রণ–মে ২০০২
১০। তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম : অতীত ও ঐতিহ্য, শৈলী প্রকাশন, মার্চ ২০০৬।
 
লেখক : ড. উদিতি দাশ সহযোগী অধ্যাপক, ইন্সটিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।