রাখাইন রাজ্য। ক্লান্ত-শ্রান্ত অনুভূতিহীনভাবে হেঁটে চলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে আসা মাত্র আট বছর বয়সের ছেলেটি। অবশ্য হেঁটে চলেছে বললে ভুল হবে। ছেলেটির হাত দুটো বাঁধা। তার বাঁধনের সাথে আবার যুক্ত রয়েছে আরও অগণিত মানুষ। এক সারিতে বাঁধা সেই অগণিত মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন বণিক। তবে অগণিত এই জনস্রোতকে ঠিক ‘মানুষ’ বললেও ভীষণ ভুল হয়ে যাবে। কেননা এরা তো আসলে ‘পণ্য’। মানুষের তো অনুভূতি থাকে; ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, আশা-ভরসা, অধিকার –এই সব কিছুই তো মানুষের প্রাপ্য; মানুষকে তো আর অর্থের বিনিময়ে কেনা বা বেচা যায় না। সুতরাং এদের ক্ষেত্রে ‘পণ্য’ শব্দের ব্যবহারই উপযুক্ত। জনস্রোতের সাথে উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেলো ছেলেটি। ভয়ার্ত চোখে পেছনে নিজের বাবার দিকে একবার তাকালো সে। বাবার চোখে-মুখে কোনো অনুভূতির দেখা সে পেলো না। তবে তার মায়ের চেহারায় অবশ্য দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ বেশ কিছু মানুষের ভীড় দেখতে পেলো ছেলেটি। বণিকদের সাথে দর কষাকষি করছে তারা। একজন একজন করে কমতে শুরু করলো বাঁধন থেকে। বণিকদের হাতে বিজ্ঞাপনের কাগজও রয়েছে। সেখানে প্রতিটি পণ্যের উপযোগিতার বর্ণনা আছে। ক্রেতারা অনেকেই বিজ্ঞাপনের কাগজ দেখে বেছে বেছে কিনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের পছন্দের পণ্য। এক পর্যায়ে এলো ছেলেটির বাবার পালা। ছেলেটি দেখলো, তার বাবা কাচুমাচু হয়ে বণিকদের অনুরোধ করছে যেনো তার পরিবারকে তার সাথেই বিক্রি করা হয়। প্রথমে একজন বণিক প্রচন্ড রেগে চড় বসিয়ে দিলো ছেলেটির বাবার গালে। ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটি। তবে আরেকজন বণিক সৌভাগ্যবশত রাজি হয়ে গেলো তাদেরকে একসাথে বিক্রি করতে। সে বাকিদেরকেও বুঝিয়ে রাজি করালো। ক্রেতাও পেয়ে গেলো তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনপ্রতি ১২ গিল্ডার্স দরে বিক্রি হয়ে গেলো এক পরিবারের তিন সদস্য। নিজের পরিবারের সাথে থাকতে পারা তুলনামূলক সৌভাগ্যবান আট বছরের ছেলেটি অচেনা মনিবের সাথে পাড়ি জমালো অন্ধকারাচ্ছন্ন অজানা গন্তব্যের পথে।
১৬০২ সাল। এই তো মাত্র কিছুকাল আগেই স্বাধীনতা লাভ করেছে নেদারল্যান্ডবাসী বা হল্যান্ডবাসী, যারা ‘ডাচ’ বা ‘ওলন্দাজ’ নামেই পরিচিত। স্বাধীনতা লাভ করার পর এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য নিজেদের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করে তোলা। এশিয়া এবং এর ভারতীয় উপমহাদেশ নিঃসন্দেহে ব্যবসার জন্য প্রচন্ড সমৃদ্ধ ও উপযোগী জায়গা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রাখাইন (বর্তমান মায়ানমার) ও পর্তুগীজদের আধিপত্য কমাতে পারে নি ওলন্দাজরা। তবে এবার যেনো পর্তুগীজরা নিজ থেকেই সুযোগ করে দিয়েছে হল্যান্ডবাসীকে। কিছু সময় ধরে এমনিতেই নিজেদের উপনিবেশে পণ্য সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে পর্তুগীজরা, তার উপর শুরু হলো স্পেনের সাথে দ্বন্দ্ব। ফলাফল পর্তুগীজ ব্যবসায় লালবাতি। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায়ই বসে ছিলো ওলন্দাজরা। পর্তুগীজদের দুর্বল মুহূর্তে কয়েকজন ওলন্দাজ বণিক মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বা ডাচ ভাষায় ‘ভেরিনিজদে অস্ট-ইন্ডিশ্চ কোম্প্যাইনি (ভিওসি)’। নেদারল্যান্ডসের সব বড় বড় ব্যবসায়িক কোম্পানি একত্রে এই কোম্পানি গঠনে কাজ করেছিলো। তাই এটিকে ‘ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-ও বলা হয়।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিলো বিশ্বের প্রথম মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। বর্তমানকালের সবচেয়ে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধনকে একত্র করলেও তা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের সমান হবে না। নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামেই পৃথিবীর প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ গঠিত হয় এবং আমস্টারডাম পরিণত হয় পৃথিবীর বাণিজ্যিক রাজধানীতে। প্রায় টানা ২১ বছর ডাচরা মশলার একচেটিয়া ব্যবসা করে গেছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে এই কোম্পানির হাত ধরে ভারতবর্ষে ওলন্দাজদের ব্যবসার যাত্রা শুরু হলেও এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলো আরো অনেক আগে। ১৫৯৮ সালের দিকে জ্যাকব ভ্যান নেক নামের একজন ওলন্দাজ ব্যবসায়ীর জাহাজ সর্বপ্রথম ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কায় পৌঁছায় এবং প্রায় ৪০০ গুণ মুনাফা নিয়ে সেটি ফিরে যায়। সেই থেকেই এশিয়ার বাণিজ্য ডাচদেরকে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ করে।
এশিয়ায় ডাচদের প্রথম বাণিজ্যঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম জাভার বান্টেনে। তারা এশিয়ার সবগুলো ঘাঁটি মিলিয়ে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। আর এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্র ছিলো ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়া বা বর্তমান জাকার্তা। ১৬৫২ সালে কেপ অফ গুড হোপে ডাচরা তাদের মিলিটারি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং পথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেয়ায় একটি সুবিধাজনক স্থান হওয়ার কারণে এখানে তারা তাদের একটি উপনিবেশ গড়ে তোলে, যার নাম দেয়া হয় ‘কেপ কলোনি’।
বার্মিজ মগ ও পর্তুগীজদের সময় থেকেই উপমহাদেশে দস্যুবৃত্তি ভীষণ প্রাধান্য বিস্তার করে। মগ ও পর্তুগীজ দস্যুরা তীরবর্তী এলাকা থেকে বিভিন্ন ধর্মের নারী, পুরুষ ও শিশু অপহরণ করে বিক্রি করা শুরু করে। এভাবেই দাসপ্রথা বিস্তার লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশে। দাস ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনা ডাচদেরকেও প্রলুব্ধ করেছিলো। ডাচরা বাটাভিয়ার কর্মী হিসেবে কেপ কলোনিতে বসবাসরত খোইখোইদেরকে (দক্ষিণ আফ্রিকার একটি যাযাবর জনগোষ্ঠীকে ‘খোইখোই’ বলা হয়) জোরপূর্বক নিযুক্ত করা শুরু করে। খোইখোইরা প্রথমে ডাচদের উপস্থিতি মেনে নিলেও পরবর্তীতে যখন আশঙ্কাজনকভাবে তাদের সংখ্যা কমতে শুরু করলো, তখন তারা বিদ্রোহ করে বসলো। তার উপর গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে গণহারে মারা যেতে থাকলো খোইখোইরা। এদিকে পর্যাপ্ত দাসের অভাবে বিপদে পড়লো বাটাভিয়ার ব্যবসায়ীরা। তাই শুরু হলো অন্য জায়গা থেকে দাস কিনে আনার ব্যবস্থা।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষকে অপহরণ করে এনে দাস হিসেবে কেনা ও বেচা শুরু হলো। এরই মধ্যে ডাচরা ব্যবসার সুবাদে বাংলায় পৌঁছেছিলো ১৬০৭ সালে। তবে ১৬৩৫ সালে তৎকালীন মুঘল সুবাদারের ফরমান পাওয়ার পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ব্যবসা শুরু করতে পেরেছিলো বাংলায়। ফরমান লাভের পর হুগলিতে তারা একটি বাণিজ্যঘাঁটি গড়ে তোলে এবং বাংলায় একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের ডাচ গভর্নর কিছু লোক পাঠায়। কিন্তু এরই মধ্যে পর্তুগীজদের মতো ডাচরাও দস্যুবৃত্তি ও দাসবাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিলো। তাই বাংলায় ব্যবসা করতে আসা ডাচদের জন্য দাসবাণিজ্যের নতুন এক দুয়ার খুলে গেলো। ১৬২০ সাল থেকে প্রকাশ্যেই শুরু হলো বাংলার তীরবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে মানুষ কেনাবেচা।
১৬৩৬ সালে প্রথমবার ডাচদের ছয় জনের একটি দল ঢাকায় আসে, কিন্তু ঢাকার এই যাত্রা তাদের জন্য তেমন সুখকর ছিলো না। তারা ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই হুগলির স্থানীয় লোকেরা তাদের আটক করে ও হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়। হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় ঢাকায় পৌঁছানোর পর তাদেরকে মারধোরও করা হয় এবং নিজেদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ ও যাতায়াত ভাড়াও তাদেরকেই দিতে হয়। এমনকি নবাবের জন্য মূল্যবান উপহারও কিনতে হয় তাদের। পরিস্থিতির প্রতিকূলতার জন্য বাধ্য হয়ে তাদেরকে হুগলিতে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি নৌকাও কিনতে হয় এবং সেই সাথে নৌকার মাঝিকেও পারিশ্রমিক দিতে হয়। এসব কিছুর জন্য তাদের প্রায় এক হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়, যা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনো কম মূল্য ছিলো না।
তবে এতো কিছুর পরও তাদের একটাই প্রাপ্তি ছিলো, আর তা হলো ঢাকায় ব্যবসা করার জন্য নবাবের কাছ থেকে পাওয়া বাণিজ্যচুক্তি, যদিও পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা ভেবে ঢাকায় তেমন জোরালোভাবে ব্যবসা করার সাহস তারা অনেক দিন করতে পারে নি। কিন্তু ১৬৬০ সাল থেকে ধীরে ধীরে বাণিজ্যকুঠি, অফিস, ফ্যাক্টরি, উদ্যান ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকায় তাদের যোগাযোগ সচল হতে থাকে। ১৬৬৬ সালে ডাচরা ঢাকায় তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল যেখানে অবস্থিত, সেখানেই ছিলো ডাচদের ফ্যাক্টরি। ইংরেজি ভূতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ মেজর জেমস রেনেলের মানচিত্র থেকে সেই সময়ের বাংলার একটি স্পষ্ট ছবি আমরা দেখতে পাই। ডাচরা ঢাকার ফার্মগেটে একটি বাগান তৈরী করেছিলো, যেটি বর্তমান আনন্দ সিনেমা হল ও তেজতুরি বাজার এলাকার মাঝামাঝি অবস্থিত ছিলো। ফ্রান্সিস বার্নিয়ারের মতে, ডাচরা কাপড় ও গানপাউডার তৈরীর প্রধান উপকরণ সোরা বা নাইটার বা সল্টপিটারের একচেটিয়া ব্যবসা করে গেছে ঢাকায়। ট্যাভার্নিয়ার ঢাকায় ডাচদের একটি চমৎকার গুদামঘরের বর্ণনা দিয়েছেন।
অপহৃত দাসদেরকে সাধারণত নিলামে তোলা হতো আরাকানে। ডাচরা প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারত, আরাকান ও বাংলা থেকেই মানুষ অপহরণ করে নিয়ে আসতো, কেউ কেউ অবশ্য দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে নিজেরাই এসে বিক্রি হয়ে যেতো। তবে আরাকানে দাসদের নিলাম শুরু করবার জন্য আরাকানের রাজার সাথে ডাচদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, আরাকানের স্থানীয় কোনো মানুষকে দাস বানানো থেকে ডাচদের বিরত থাকতে হবে এবং এ জন্য পার্শ্ববর্তী বাংলা থেকে দাস সরবরাহে সবরকম সহায়তা আরাকানের পক্ষ থেকে ডাচরা লাভ করবে। জাহাজভর্তি করে দাসদেরকে নিয়ে আসতো মগরা আরাকানে। এভাবে বাংলায় দাসবাণিজ্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেলো। রীতিমতো বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দাসদের বিশেষত্বের বর্ণনা দিয়ে দাস বিক্রি করা শুরু হলো, ঠিক যেভাবে কোনো পণ্য বিক্রি করা হয়।।
প্রচুর পরিমাণে বাংলার মানুষকে দাস বানিয়েছে এই ওলন্দাজরা। এরই মধ্যে একজন হলেন ফিল্যান্ডার ভ্যান বেঙ্গালেন, যাকে আমরা এক সময় আমস্টারডামের জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত এবং বর্তমানে ডোকুমের টাউনহলে রক্ষিত ১৬৯৭ সালে আঁকা একটি পেইন্টিং এর মধ্যে দেখতে পাই। সেই ছবিটিতে দেখা যায়, একটি খাবারভর্তি টেবিলের সামনে বেশ কিছু দামী পোশাক পরিহিত ওলন্দাজ নারী ও পুরুষ বসে খাবার গ্রহণ করছে এবং আশেপাশে কয়েকজন কম দামী পোশাকের পরিচারক-পরিচারিকা ট্রে হাতে তাদেরকে সার্ভ করছে। ছবিটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো কালো চুলের এশীয় চেহারার একটি ১০ বছরের ছেলে, যে ট্রে হাতে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে। এই ১০ বছরের ছেলেটিই ফিল্যান্ডার ভ্যান বেঙ্গালেন। পেছন দিকে আরেকটি ট্রে হাতে এশীয় চেহারার একজন পরিচারিকাকে দেখা যায়, যাকে ধারণা করা হয় ফিল্যান্ডারের মা রোজেট।
মারিয়া হলট্রপ বলেন, ফিল্যান্ডার বাংলাদেশ থেকে আসা একজন দাস। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ফিল্যান্ডারের নাম এবং তার ধর্মের বিষয়ে। এর জবাবে মারিয়া বলেন, খুব কম সংখ্যক দাসই আছেন, যাদের আসল নাম এবং আসল পরিচয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে; কারণ বিক্রি হয়ে যাওয়া দাসকে ভীষণ অমানবিকভাবে তার মনিব নিজেদের পছন্দমতো নামকরণ করতো ও নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করতো। মারিয়ার গবেষণা থেকে জানা যায় একটি লগ বই সম্পর্কে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে আমস্টারডামে আসা দাসদের পরিবর্তিত নামের তালিকা ও তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার তারিখ লিখিত আছে। সেই লগ বই থেকেই জানা যায় ম্যাগডালেনা নামের কোনো মেয়ে দাসের নেদারল্যান্ডসে আসার পর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার তারিখ সম্পর্কে, যেখানে তার বাবার নাম ব্যারন (সম্ভবত বাংলা নাম ‘বরুণ’ এর পরিবর্তিত রূপ) ভ্যান বেঙ্গালেন ও মায়ের নাম রোজেট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাবার নামের পাশে তার ধর্ম খ্রিস্টান পাওয়া গিয়েছে।
আসলে ব্যারন ভ্যান বেঙ্গালেন তার স্ত্রী রোজেট, মেয়ে ম্যাগডালেন ও ছেলে ফিল্যান্ডারের সাথে বিক্রি হন। তাদেরকে প্রথমে বাটাভিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাটাভিয়ায় থাকা অবস্থায়ই ব্যারনকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এরপর কেপ কলোনি হয়ে তাদেরকে নেদারল্যান্ডসে নিয়ে যাওয়ার পর বাকিদেরকে খ্রিস্টান বানানো হয়। তারা ফ্রিজল্যান্ড প্রদেশের দাস হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ধারণা করা হয়, বাংলা থেকে আসা দাসের পরিচয় বুঝাতেই ‘ভ্যান বেঙ্গালেন’ উপাধিটি নামের শেষে ব্যবহার করা হতো। ‘বেঙ্গালেন’ শব্দটি ‘বেঙ্গল’ শব্দেরই পরিবর্তিত রূপ। আরও জানা যায়, দাসত্বের অভিশপ্ত পর্ব শেষ হবার পর ফিল্যান্ডার ডোকুমের পুলিশ-প্রধান নিযুক্ত হন এবং ফ্রিজল্যান্ডের একজন মেয়েকে বিয়ে করেন ও পাঁচ সন্তানের বাবা হন।
১৭৮৮ সালের আরেকটি পেইন্টিং থেকে অগাস্টাস ভ্যান বেঙ্গালেন নামের আরেকজন বাংলাদেশী দাসের মুখাবয়ব দেখা যায়। ছবিটিতে অগাস্টাস তার মনিব হেনড্রিক ক্লোয়েটের পাইপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হেনড্রিক ক্লোয়েট একজন বিশিষ্ট ওলন্দাজ নাগরিক।
বাংলায় ডাচদের দস্যুবৃত্তি ও দাসবাণিজ্য এক পর্যায়ে চরম আকার ধারণ করে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ডাচদের উৎপাত ভীষণ বেড়ে যায়। বাংলায় বাণিজ্যের জন্য অনুমতি প্রদানকারী মুঘলরাই এক সময় তাদের কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর এমন সময় ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা। মুঘল সৈয়দ বংশের একজন নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ডাচরা। সেই ঘটনার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন মুঘলরা এবং তখন থেকেই ঢাকার বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারা।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠা ব্রিটিশদের সাথে ১৭৮০ সালে সংঘটিত চতুর্থ অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় ডাচদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, ভুল বাণিজ্যনীতি, শেয়ারহোল্ডারদেরকে আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ প্রদান, কর্মচারীদেরকে বেতন দিতে না পারা এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অবশেষে এক সময় ২০০ বছর দাপিয়ে বেড়ানো সবচেয়ে বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধ্বংস হয়ে যায়, আর তার সাথেই শেষ হয় ডাচ দাস-বাণিজ্যের কালো অধ্যায়।
দাসত্বের ইতিহাসের কথা উঠলেই সাধারণত আমাদের মনে আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষদের দাসে পরিণত হওয়ার করুণ চিত্রই ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশের, বিশেষ করে আমাদের এই বাংলার অজস্র মানুষের দাসে পরিণত হওয়ার হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কথা ইতিহাসের কোথাও গুরুত্বসহকারে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। আর এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব মানুষদের আদিম আত্মত্যাগের করুণ কাহিনী।
প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক মানবজমিন