নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথ প্রদর্শক। তিনি শুধুমাত্র নিজের অদম্য ইচ্ছার কারণে শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল।
তাঁর জন্ম ১৮৩৪ সালে। তিনি একাধারে ছিলেন জমিদার, নারীশিক্ষার প্রবর্তক, সমাজসেবক ও কবি। কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে এক জমিদার বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদ আলী চৌধুরী ছিলেন হোমনাবাদ পরগনার পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার, মা-আরাফান্নেসা চৌধুরাণী। মুসলমানদের কঠিন পর্দাপ্রথার মধ্যে থেকেও ফয়জুন্নেসা আরবি, ফারসি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায়ও পারদর্শী হয়ে উঠেন।
বাবা-মায়ের প্রথম কন্যা, তার উপর বাবা ছিলেন জমিদার, সেই হিসাবে অবাধ স্নেহ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকেই তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা তার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে তিনি খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটি ভাষা শিখে ফেলেন- বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত।
১৮৬০ সালে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, যিনি ছিলেন পাশের অঞ্চলের জমিদার মুহম্মদ গাজীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তবে তিনি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তাদের দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। এক পর্যায়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর, তিনি তার বিয়ের কাবিনের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে পশ্চিমগাঁও তে সাড়ে তিন একর জমিতে একটা বাড়ি তৈরি করেন। বাড়িটি তৈরি করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল। ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন। ফয়জুন্নেসা ছিলেন হোমনাবাদ পরগনার জমিদার। জমিদারি পরিচালনায় তার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতা দিয়ে তিনি অনেকদুর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কাজে কর্মে তিনি ছিলেন সেই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলেন, তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছিলেন।
সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি তিনি জোর দেন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’, হাসপাতালটি ছিলো শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা, দিঘি-পুকুর কাটানো প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
আসলে ফয়জুন্নেসা জমিদারি পাওয়ার আগে থেকেই সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ এবং গরীবদের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি নারীশিক্ষার জন্য কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির মধ্যে অন্যতম। পরে এটি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং এর নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ। সড়ক তৈরি করে তিনি সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজের মসজিদ তৈরি করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি ‘মুসাফিরখানাও’ তৈরি করেন। তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চলছিল। নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারী জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন।
রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসার নাম চিরস্মরণীয়। কলকাতার ঠাকুরবাড়ির ‘সখী সমিতি’র সদস্যা ছিলেন তিনি। তাই সাহিত্যিক হিসেবেও ফয়জুন্নেসার একটা পরিচিতি আছে।তার লেখা গদ্যে-পদ্যে রচিত ‘রূপজালাল’ (১৮৭৬) বইটি রূপকের আশ্রয়ে একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে তাঁর বিড়ম্বিত দাম্পত্য জীবনের করুণ কাহিনী স্থান পেয়েছে। এছাড়া সঙ্গীতসার ও সঙ্গীতলহরী নামে তাঁর দুখানি কাব্যের কথাও জানা যায়। উল্লেখ্য যে, নবাব ফয়জুন্নেসা এমন এক সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন যখন অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে এই ভাষা সাধারণত ব্যবহৃত হতো না। ‘রূপজালাল’ ছাড়াও তার আরো দু’খানি বইয়ের নাম পাওয়া যায় ‘সঙ্গীত লহরী’ ও ‘সঙ্গীত সার’। বইগুলি প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য। একথা বললে খুব একটা ভুল হবেনা যে, সাহিত্য সাধনায় ফয়জুন্নেসার পথ ধরে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব হয়েছে। কাজেই বাংলা সাহিত্যে নারী হিসাবে নওয়াব ফয়জুন্নেসার অবদান সবার আগে। বৃটিশ শাষনামলে মুসলিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বসবাস করেও তিনি সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। সেই সময় তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বান্ধব, ঢাকা প্রকাশ, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর এবং ইসলাম প্রচারক বাংলা পত্রপত্রিকাকে আর্থিক সহায়তাও দিতেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনহিতকর কাজে অবদানের জন্য ফয়জুন্নেসাকে পুরষ্কারস্বরুপ মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রথমে বেগম এবং পরে নওয়াব উপাধি দেন। ১৮৮৯ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নির্দেশে ফয়জুন্নেসাকে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নওয়াব’ উপাধি দেয়া হয়। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি জমিদারির এক বিশাল অংশ ওয়াকফ করে যান, যা থেকে এলাকার গরীব ও মেধাবী ছাত্ররা আজও অর্থসাহায্য পেয়ে থাকে।
১৯০৩ সালে নিজ গ্রামে তার মৃত্যু হয় এবং তাদের পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান দুই কন্যা আরশাদুন্নেসা এবং বদরুন্নেসা। ২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
তথ্যঋণ— বাংলা পিডিয়া, উইকিপিডিয়া ইমেজ – গুগুল