এছাড়া, কায় খসরুর পর লোহরাস্প সিংহাসনে বসেন এবং তার পুত্র গোশতাস্প বিয়ে করেন রোমের সিজারের মেয়েকে। যা ছিল বীর আলেকজান্ডারের পারস্য হামলার মূল কারণ। তার আমলেই পুত্র এসফানদিয়ার জরাথুস্ত্র নামে নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। রুস্তম এসফানদিয়ারকে হত্যা করেন। তারপর দারিউস ক্ষমতায় আসেন। দারিউসের পরে ইসকান্দারের ও আরদাশিরের গল্প বলা হয়েছে। এভাবে শাহনামাতে শাপুর, বাহরাম, খসরু এবং কোবাদের মতো ৫০ জন শাসকদের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার সংগ্রাম-লড়াই তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি একটি কাহিনি সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো।
জাবুলিস্তান নামের দেশের রাজা রুস্তম শিকার করতে গিয়েছিলেন প্রিয় ঘোড়া রক্ষকে নিয়ে। সারাদিন শিকার করে ক্লান্ত রুস্তম ঘুমিয়ে পড়লেন এক গাছের নীচে। সেসময় ঘোড়াটি ঘাস খাচ্ছিল আর সমাঙ্গন রাজ্যের কিছু সেনা সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রক্ষকে দেখে বন্দী করল। রুস্তম ঘুম থেকে উঠে দেখেন রক্ষ নেই। পরে সমাঙ্গন রাজপ্রাসাদে গিয়ে রক্ষকে ফেরত চাইলে, রুস্তমকে রাজকীয় আতিথ্য গ্রহন করার অনুরোধ করলেন রাজা। রুস্তম রাজী হয়ে গেলেন। সেখানে রাজকন্যা তহমিনাকে এক নজর দেখামাত্রই খুব পছন্দ হয়ে গেলো রুস্তমের। পরদিন সকালে তিনি রাজার কাছে বিবাহের প্রস্তাব দিলে রাজা খুব খুশি হন এবং তাদের বিয়ে দেন। বেশ কিছু দিন খুব আনন্দে কাটালেন রুস্তম। কিন্তু রুস্তম তার রাজ্যে ফিরে আসলেন স্ত্রীকে রেখেই। তাহমিনা সন্তান সম্ভবা হলেন। তাদের একটি ফুটফুটে ছেলে হয়, যার নাম রাখা হলো সোহরাব। এই ছেলেও বাবার মত শক্তিশালী সুপুরুষ হয়। কিন্তু সোহরাব তার বাবা রুস্তমকে কোনদিন দেখেনি। এদিকে ইরানের সাথে তুরানের যুদ্ধ শুরু হলে সোহরাব ও রুস্তমের বাহিনী মুখোমুখি হয়। একসময় বাবা ও ছেলের মধ্যেও সংঘর্ষ বাঁধে। সোহরাবের মনে এক ক্ষীণ আশা ছিল যে তাঁর পিতা রুস্তমের সাথে তাঁর নিশ্চয়ই দেখা হবে। বাবা রুস্তমের সম্পর্কে কোনো খবর জোগাড় করতে না পেরে সোহরাব অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। দুইজন মহাবীরই সামনাসামনি যুদ্ধ শুরু করলেন, প্রথমে বর্শা এবং তলোয়ার নিয়ে তারপরে মুগুর আর তীরধনুক নিয়ে। এদিকে পুত্রের মনে সন্দেহ হয় ইনিই তাঁর বাবা রুস্তম, নন তো? রুস্তম যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং কিছু পরে জয়ী হয়ে সোহরাবের বুকে চেপে বসলেন। আর সময় নষ্ট না করে তিনি এক তীক্ষ্ণ ছুরি সোহরাবের বুকে গেঁথে দিলেন। সোহরাব আহত হওয়ার থেকেও বেশী আশ্চর্য হলেন। তিনি বললেন, তাঁকে মারা যেতে হবে বাবার মুখ না দেখেই। এই কথা শুনে রুস্তম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সোহরাব তাঁর বর্ম ছিঁড়ে ফেলে বাহুর উপরের সেই রত্নটি দেখালেন। এই সেই রত্ন যা রুস্তম তাঁর স্ত্রী তহমিনাকে দিয়েছিলেন অনাগত সন্তানকে দেওয়ার জন্য। রত্নটি দেখার পর রুস্তম তাঁর ছেলের মাথা কোলে নিয়ে দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। তিনি যখন অনুভব করলেন তিনি নিজের হাতে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছেন তখন তাঁর অনুতাপের সীমা রইলো না। সোহরাব শেষ নিঃশ্বাসগুলি গুনছেন। মৃত্যুর সময়েও তিনি খুশি, কারণ অবশেষে তাঁর বাবার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছে। তিনি রুস্তমকে নিজের শেষ ইচ্ছে জানালেন, তাঁর মৃত্যুর খবর যেন তিনিই তার মা তাহমিনাকে দেন। সোহরাব মারা গেল। রুস্তম তাঁর সন্তানের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে ইরানের শিবিরের দিকে রওয়ানা দিলেন। ইরানীয় শিবির এই ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
বিশ্ববিখ্যাত মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য শাহনামা মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত সমাদৃত ও জনপ্রিয় মহাকাব্য। অমুসলিম বিশ্বেও এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। শুধু গল্পে থেমে থাকেনি, এটির সুন্দর চিত্রসম্বলিত পান্ডুলিপিও তৈরি হয়েছে যুগে যুগে। যেসব আজ বিশ্বের বিখ্যাত জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও চিত্রশালাগুলিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। যেমন – ব্রিাটশ মিউজিয়াম, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, চেস্টার বীট লাইব্রেরি, স্টেট মিউজিয়াম বার্লিন, তুরস্কের তোপকাপি সেরাই জাদুঘর আর আমেরিকার মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম ইত্যাদিতে।
ভারত উপমহাদেশেও সুলতানি আমলে ও মোঘল দরবারে অনেক চিত্রসম্বলিত শাহনামার পাণ্ডুলিপি অংকিত হয়েছিল। বাংলাতেও তার উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার মত বাংলা ভাষায় শাহনামার অনুবাদ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর চিত্রায়নও হয়েছে এই বাংলায়। জানা যায় যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত জাতীয় জাদুঘরে শাহনামার চিত্রিত কিছু পান্ডুলিপি বই সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলো আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। হয়তো আরো কিছু এরকম ঐতিহ্য আামাদের অন্যান্য জাদুঘর ও সংগ্রহশালাতে রয়েছে অবহেলায়–অযত্নে। এবিষয়ে আমাদের আরো অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। তাই শাহনামা আমাদের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ভান্ডার। ইরান তার চুরি হয়ে যাওয়া শাহানামার একশো’র বেশি নয়নাভিরাম চিত্রিত বইয়ের পাতা তাদের গুলিস্তান জাদুঘরে ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে। আমাদেরকেও আমাদের হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রত্নবস্তু ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।