ধর্ম নিরপেক্ষতা সম্রাট আকবরের গুণ ছিল। ব্রিটিশরাও এই কথাটি মানত। তাই কার্জন হল তৈরির সময় আকবরের স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে তা প্রমাণও রাখলো।প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত ঢাকার যে কয়টি স্থাপত্যকর্ম এখনও টিকে আছে, কার্জন হল তার মধ্যে অন্যতম। কার্জন হল তৈরী হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির ১৭ বছর আগে, ১৯০৪ সালে।
১৮৯৯ সালে লর্ড কার্জন ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি পূর্ববাংলা ও আসামের সমন্বয়ে একটি প্রদেশ তৈরির উদ্যোগ নেন এবং ঢাকাকে করেন এর রাজধানী। সেই জন্যেই বর্তমান হাইকোর্ট এলাকার আশেপাশে বিভিন্ন সরকারি অফিস – আদালত, হাসপাতাল তৈরী করার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। এর আগে লর্ড নর্থব্রুকের ঢাকা সফর স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ঢাকার নওয়াব খাজা আব্দুল গনি ২,৫০,০০০ টাকা দান করেছিলেন এবং টাকা দিয়ে নর্থব্রুক হল তৈরী করা হয়। তাই এইবার লর্ড কার্জনের সফর স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ভাওয়ালের রাজকুমার নরেন্দ্র নারায়ণ ১,৫০,০০০ টাকা দান করেন এই কার্জন হল তৈরির উদ্দেশ্যে।
এই ভবনটি তৈরির জন্যে কেন এই এলাকা বেছে নেয়া হয়েছিল? বলা যায়, এই এলাকাটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে মোঘল আমলের ঐতিহ্য ও স্মৃতি। মোঘল সুবেদার ইসলাম খান, যিনি ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন, তার আবাস এলাকা মহল্লা – ই – চিশতিয়ানে তৈরী করা হয় গভর্নর হাউস। এর কাছেই ছিল বারো ভূইয়াঁ প্রধান ঈসা খানের ছেলে মুসা খানের আবাস এলাকা বাগ – ই – মুসা। বিশপ হেবার বলেছিলেন, তখনকার ঢাকার সব থেকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম মীর আশরাফ আলীর কবরের পাশেই নির্মাণ করা হয় কার্জন হল। সমস্ত পূর্ব পরিকল্পনার পর ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখনো অক্ষত অবস্থায় এই কার্জন হল সকলের প্রিয় ইমারত হিসেবে সদর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ড. আহমদ হাসান দানীর মতে, কার্জন হল মূলত তৈরী করা হয়েছিল টাউন হল হিসেবে। পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গ রদের পর, এটি ঢাকা কলেজের গ্রন্থাগার ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও কার্জন হলকে পাবলিক হল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কার্জন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে। এরপর থেকে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ভবনের নির্মাণশৈলী দেখে একটা ব্যাপার বোঝা যায় যে, এটি কিছুটা এংলো ইন্ডিয়ান ও কিছুটা ইসলামী রীতির মিশ্রনে গড়ে তোলা হয়েছে। এর গম্বুজ বা খিলানের শিল্পকর্মগুলো বাদশাহ আকবরের নগরদূর্গ ফতেহপুর সিক্রির দিওয়ান – ই – খাসের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশরা বাদশাহ আকবরকেই সব থেকে বেশি যোগ্য, বুদ্ধিমান ও ধর্ম নিরপেক্ষ শাসক হিসেবে মানত। সেই কারণেই এই কার্জন হল সৃষ্টির সময় তারা আকবরের নির্মাণশৈলী মাথায় রেখেই এই অভিনব নকশার করেন। এই ভবনটি তৈরী করতে মোঘল আমলের লাল বেলে পাথরের জায়গায় লাল রং ব্যবহার করা হয়েছে শুধু মাত্র সাদৃশ্য আনার জন্যে। গথিক রীতির এই স্থাপত্যকর্মের জন্যেই নৃতত্ত্ববিদ লেডি ট্রস কার্জন হলকে অক্সফোর্ডের সাথে তুলনা করেছিলেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” বলা হয়।
একশ বছরের পুরনো এই স্থাপত্যকর্মটি শুধুমাত্র একটি ভবন নয়, বরং যুগে যুগে অনেক উত্থান – পতন, ঘাত – প্রতিঘাত, অনেক সংগ্রাম, মিটিং – মিছিলের সাক্ষী। এমনকি আমাদের ভাষা আন্দোলের ইতিহাসের সাথেও রয়েছে এর গভীর সম্পর্ক। এটি এখন প্রত্নতত্ত্বের তালিকায় পরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, কয়েকশো বছরের ইতিহাসের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবনটি অনেকটা অবহেলায়ই রয়েছে। আমাদের সকলের উচিত এই প্রত্নসম্পদকে রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার, যাতে আমাদের আগামী প্রজন্মও এই কার্জন হলকে দেখে এর ইতিহাস জানে।