ইতালীতে প্যাড্রে নামে এক সাধুর বাস ছিল।তাকে ঘিরে অদ্ভুত ঘটনাবলী তাকে সংবাদ শিরোনাম করে তুললো ।এই সাধুটিকে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে একই সময়ে দুই স্থানে দেখা যেত।
১৯১৭ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে র্জামানীর কাছে স্লোভেনিয়াতে ইতালীয় বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ইতালীয় বাহিনী প্রধান লুইগী ক্যাডোর্না হতাশায় ও লজ্জায় একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন।
একদিন তিনি নিজের তাবুতে বসে নিজের রিভলভার নিয়ে আত্মহননের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।ঠিক এমনি সময় হঠাৎ এক সন্ন্যাসী তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে তাকে তিরস্কার করলেন।‘অমন গাধার মত কাজ করোনা’।এ কথা বলে সন্ন্যাসী যেমন হঠাৎ এসেছিলেন ঠিক তেমন ভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর অতীত হয়ে গেল।উপরোক্ত জেনারেল মধ্য ইতালীয় ফোগিয়াতে অবস্থিত স্যান গিওভান্নি রটন্ডো গীর্জা পরিদর্শন করতে যান। ঐ গীর্জাতে একজন পাদ্রীর দেখা মিললো,যাকে তিনি কয়েক বছর আগে তার তাবুতে উপস্থিত হতে দেখেছিলেন।সন্ন্যাসীকে দেখে তার চিনতে কিছু মাত্র অসুবিধা হয়নি।কারণ এর তিরস্কারেই একদিন আত্মহত্যা করার মত দুর্বুদ্ধি তার দূরীভূত হয়েছিল।সন্ন্যাসী যখন সৈন্যাধ্যক্ষর পাশে দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে সম্বোধন করে বললেন ,খুব বাঁচা বেঁচে গেছ-তোমার সৌভাগ্য বটে!
সন্ন্যাসী পুরো নাম প্যাড্রে পিও।দরিদ্র চাষী পিতা মাতার সন্তান।বিনয়ী এবং ভদ্র।পরবর্তী পর্যায়ে তিনি অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে ওঠেন।অতিন্দ্রীয় বিষয়ের দর্শক হিসাবেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে নিন্দুকের নিন্দাবাদ ও জোটে প্রচুর।১৯৬৮ খৃষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সাধু শ্রেণীভুক্ত করা বিপুল বিতর্ক ও মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় মহাসমর চলাকালিন,সাধু প্যাড্রে পিও একদিনের জন্যও তার ফগিয়ার মঠ ছেড়ে বাইরে যাননি।আর সমর নায়ক লুইগী ক্যাডোর্নার মনে এই ঘটনা এক বিস্ময়ের সঞ্চার করে। একই সময়ে দুই জায়গায় কিভাবে তার উপস্থিতি ঘটতে পারে-একথা ভেবে তিনি কোন কুল কিনারাই খুঁজে পেলেন না।
১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে বেনিভেন্টের নিকটবর্তী পিয়েট্রিলসিন নামে এক গ্রামে তার জন্ম ।মাত্র পনের বছর বয়সে প্যান্ড্রে পিও ক্যাপুচিন মাঠে যোগদান করেন ।অন্যান্য সঙ্গী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিরবে বহু বৎসর গভীর সাধনার সাথে বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন। বিদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কর্তব্য কর্মও তিনি সঙ্গী সন্ন্যাসীদের পাশা পাশি সুচারুরুপে সম্পন্ন করতেন।
তারপর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নিজের হাত পা ও দেহের ডানপাশে তিনি যন্ত্রণার অনুভূতি ব্যক্ত করেন।অভিজ্ঞ ডাক্তাররা তাকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করেও ও তাঁর এই যন্ত্রণা বা বেদনার উৎস খুঁজে বের করতে পারলেননা। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে সেপ্টেম্বর প্যান্ড্রে যখন ফেবিয়ার গীর্জার বেদিতে বসে প্রার্থনা করেছিলেন, সেই সময় হঠাৎ দুঃসহ যন্ত্রণায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।সঙ্গী সাধুরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে এগিয়ে এলেন।সাধুদের বিস্ময় সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেল যখন তারা দেখতে পেলেন প্যান্ড্রের হাত পা ও দেহের পাশ থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে-ঠিক যেমনটি হয়েছিল যীশুর বেলায়।ক্রশের উপর দেহের যে সব জায়গায় যীশুকে পেরেক বিদ্ধ করা হয়েছিল ঠিক সেই সেই জায়গা গুলোতে তার যন্ত্রনা হচ্ছিল।সেই সব জায়গা দিয়ে রক্তের ধারাও প্রবাহিত হচ্ছিল।প্যান্ড্রে পিওকে ডাক্তাররা পরীক্ষা করলেন।কিন্তু কেউই এই ক্ষত গুলোর সঠিক বা সন্তোষজনক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেননা।
যীশুর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা নিজেদের দেহে এই ধরণের ক্ষত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তৈরী করতেন। সে গুলো ষ্টিগম্যাটা নামে পরিচিত।ঐ আঘাত চিহ্নগুলোকে খৃষ্টধর্ম অনুরাগীরা পবিত্র জ্ঞানে সন্মান করতেন।হাত,পা,ডান কিংবা বামদিকের রক্তক্ষরণই হলএই ষ্টিগম্যাটার সাধারণ অভিব্যাক্তি। কাঁধের ক্ষত চিহ্ন ক্রশবহন জনিত যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, কপাল ও ভুরুর রক্ত-কাঁটার মুকুট পরানোর কারণে তৈরি-ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষত চিহ্ন খৃষ্টের অনুসারীরা নিজেদের দেহে তৈরি করতেন।আরও বিভিন্ন ধরণের ষ্টিগম্যাটা দেখা যেত।যীশুকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধার ফলে উৎপন্ন ক্ষত চিহ্ন, চামড়ার দড়ির তৈরি চাবুকের ভয়ঙ্কর আঘাত সমূহের চিহ্ন ইত্যাদি মানুষের দেহে যেত।এই সব চিহ্ন মানুষের মনে ভীতির উদ্রেক করতো।
ডাক্তারী ব্যাখ্যাঃ
দৈহিক কারণে ষ্টিগম্যাটার উদ্ভব হয় এ কথা ডাক্তাররা বহু আগেই নাচক করে দিয়ে ছিলেন।ডাক্তার এবং অন্যান্য ধর্ম তত্ববিদ্গণ লক্ষ্য করেন যে বেশীর ভাগ ষ্টিগম্যাটইক্স্ এর উদ্ভব তাদের দেহেই হয়,যারা যীশুর উপর অমানুষিক অত্যাচারের কারণে তার অপরিসীম যন্ত্রণার কথা স্মরণ করে সর্বদা আক্ষেপ করেন ও নিজের জীবনকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করেন।প্রকৃত ব্যাখ্যাই হল নিজের ওপর এ ধরণের অত্যাচারের কল্পনা করা।
রোমান ক্যাথলিক গীর্জা এই ষ্টিগম্যাটার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ বর্ণনা করেছে।কারো কারো মতে এটি একটি স্বর্গীয় বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বাসীদের সন্দেহের উদ্রেক করার জন্য ক্রুর হস্তক্ষেপ ,অথবা অচেতন বা সচেতন মতামত-কিন্তু কোনটিই প্রমানিত হয়নি।প্যান্ড্রে পিওর ব্যাপারটা যে কারণেই ঘটে থাকুক না কেন তিনি তার কর্তব্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।নিজের কাজগুলো তিনি সচেতন ভাবেও যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতেন।খৃষ্ট ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে তিনি একজন সহৃদয় ভদ্র ও নিজ ধর্মের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও বিশ্বাসপরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন।
প্যান্ড্রের প্রচার বিমুখতাঃ
প্যান্ড্রে তার এই ষ্টিগমেটার ওপর ভিত্তি করে কোন ফায়দা লুটবার প্রয়াস পাননি। তিনি সব সময় প্রচার বিমুখ ছিলেন।এমন কি, এই অবস্থাকে মূলধন করে কোনরুপ প্রসিদ্ধি লাভেরও চেষ্টা করেননি। পাছে তার হাতের ক্ষত কারুর চোখে পড়ে সেই ভয়ে তার হাত সর্বদা আচ্ছাদিত রাখতেন।তথাপি সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর ও তাঁর মঠের জন্য অঢেল আর্থিক অনুদান আসতো। ১৯৫৬ খৃষ্টাব্দে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যায়ে ফগিয়া নামক স্থানে একটি হাসপাতাল নির্মিত হয়। এই হাসপাতালের ব্যয়ভারের সকল অর্থ আসে এই সাহায্য বা অনুদানের টাকায়।
প্যাড্রে পিওর জন্ম স্থান পিয়েটিল্ সিনা গ্রামটিতে অগণিত তীর্থ যাত্রীর আগমনে গ্রামটিও পরে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে।
ভ্যাটিকান প্রাসাদ কর্তৃপক্ষ দুবার প্যাড্রে পিওকে তার কর্তব্য থেকে অপসারিত করেন।প্যাড্রের খ্যাতি,-বিশেষ করে তাঁর জন্য প্রেরিত অর্থ প্রাচুর্য ভ্যাটিকানকে হতবুদ্ধি করে দেয়।সে জন্যই হয়তো তার প্রতি ছিল এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ।কালক্রমে প্যাড্রে যে দারিদ্র্যকে শপথ করে গ্রহণ করেছিলেন, সেই দারিদ্রের মধ্যে ডুবে গেলেন।কারণ তার নিকট প্রেরিত অর্থ তিনি উইল করে ‘হোলি সি’ চার্চ কে দান করে দেন।ইতি মধ্যে প্যাড্রের সুনাম,অতিন্দ্রিয় ক্ষমতা এবং অন্যান্য শক্তির সংবাদ সমগ্র বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পরলো।
১৯৩৬ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তিনজন লোক ঐ মঠ পরিদর্শনে যান।প্যাড্রে তাদের অনুরোধ করেন-আমার সঙ্গে এমন একটি আত্মার জন্য আপনারা প্রার্থনায় মিলিত হউন, যিনি অচিরেই ঈশ্বরের বিচারালয়ে বিচারের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।
আগন্তুক তিনজন তার অনুরোধে প্রার্থনায় অংশ গ্রহণ করলো। পুরোহিত প্যাড্রে তাদের জানালেন যে তারা ইংল্যান্ডের সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্য প্রার্থনা করলেন। তারা যখন প্রার্থনায় রত-সেই সময়ই সম্রাট মৃত্যু বরণ করেন।
১৯২০ খৃষ্টাব্দে উরুগুয়ের স্যাল্টে অঞ্চলের মন্ সিগনর ড্যামিয়ানি নামে এক ভদ্রলোক প্যাড্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ড্যামিয়ানি তাঁর প্রতি এতই আকৃষ্ট ও অভিভূত হন যে, তিনি প্যাড্রের নিকট নিজের অন্তিম অভিলাষ জ্ঞাপন করেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে তার নিজের মৃত্যুর সময় তিনি প্যাড্রের উপস্থিতি কামনা করেন।প্যাড্রে তাকে জানান যে ড্যামিয়ানি তার নিজের দেশে মৃত্যুবরণ করবেন। তিনি তাকে আশ্বস্থ করে বলেন যে,ড্যামিয়ানি যেন মোটেই ভয় না পান।তার এই আশ্বস্থ বাক্যে-ড্যেমিয়ানি নিশ্চিত হয়ে দেশে ফিরে যান।
১৯৪২ খৃষ্টাব্দে মন্টি ভিডিওর আক’বিশপকে একজন সন্ন্যাসী গভীর রাত্রে জাগিয়ে তোলেন।সন্নাসী তাকে ড্যামিয়ানীর শয্যাপার্শ্বে যাবার জন্য অনুরোধ করেন। আর্কবিশপ ড্যামিয়ানীর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়ে দেখেন যে ড্যামিয়ানীর মৃত্যু হয়েছে।আর আশ্চর্যের বিষয় এই যে ড্যামিয়ানীর শয্যাপার্শ্বে একটি চিরকুট দখতে পেয়ে সেটি তুলে দেখেন, তাতে লেখা রয়েছে প্যাড্রে পিও এসে ছিল।
১৯৪৯ সনের পূর্বে আর্কবিশপের সঙ্গে প্যাড্রের আর দেখা হ্যনি.১৯৪৯ সনে আর্কবিশপ যখন প্যাড্রেপিওর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেলেন,তখন দেখলেন প্যাড্রে আর কেউ নন, যে সন্ন্যাসী গভীর রাতে তাকে জাগিয়ে ড্যামিয়ানির শয্যাপাশে নিয়ে গিয়েছিলেন, ইনি সেই সন্ন্যাসী।
১৯৬৮ সনের ২৮শে সেপ্টেম্বর যখন প্যাড্রে পিও মারা যান তখন তার অনুসারীরা প্যাড্রেকে সাধু শ্রেণী ভূক্ত করার দাবী তোলেন।কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের সেই দাবি কিন্তু গ্রাহ্য হয়নি।