A photo from 1951.

একদিন ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ী ছিলো এই শাহাবাগ। ১৯৫০খ্রিঃ এখানেই নির্মিত হয়েছিলো স্হানীয় সম্রান্ত নাগরিক, বড় ব্যবসায়ী, লোকাল এলিট এবং বিদেশী তথা ইংরেজদের জন্য আন্তর্জাতিক মান সম্মত প্রথম আবাসিক হোটেল। ইতিহাসের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ইংল্যান্ডের নাগরিক এডোয়ার্ড হিক এবং রোনাল্ড ম্যাককনেল এই হোটেল স্হাপনাটির আর্কিটেক্ট ছিলেন। এখন যেখানে পুবালী ব্যাংকটি সেখানেই ছিলো সেদিনের শাহাবাগ হোটেল। আজকের পুবালী ব্যাংকের বিল্ডিংএ ছিলো নবাবদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ অফিসটিও।

A post card from 1960s

১৯০৫খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা হোয়ে গেলো পূর্ববঙ্গের রাজধানী। ফলে এখানে নির্মিত হোতে লাগলো অনেক সুন্দর সুন্দর ইমারত। সেই সাথে নির্মিত হলো অভিজাত শ্রেণির মনোরঞ্জন ও চিত্তবিনোদনের জন্য পানশালা ও এবং এখানে অনুষ্ঠিত হতো বাঙ্গালুরুর নামকরা পিয়ারী বাঈ, হীরা বাঈ, ওয়াম্মু ও আবেদী বাঈসহ তৎকালিন ভারতের নামকরা বাঈজীদের সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান। এ রকম একটি ভবনের নাম ছিলো ইসরাত মঞ্জিল। ইসরাত মনজিলে সম্মানিত অতিথি হোয়ে এসেছেন ইন্ডিয়ার ভাইসরয় লর্ড ডুফিরিন, বেঙ্গলের গভর্ণর লর্ড কারমাইকেল, লেফটন্যান্ট গভর্নর স্যার ষ্টুয়ার্ট বেইলি, লেফন্যান্ট গভর্ণর স্যার আলফ্রেড ইলিয়ট এবং লেফটন্যান্ট গভর্নর স্যার উডবার্ণ প্রমুখ। এই ইসরাত মঞ্জিলই পরবর্তিতে শাহবাগ হোটেল হয়ে উঠেছিলো যা ছিলো দেশী বিদেশী পর্যটকদের মূল আকর্শন। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যানটিনটিও ছিলো নবাবদের আনন্দ ফুর্তির রংমহল, তখন সেটির নাম ছিলো জলসাঘর। এই জলসা ঘরের সম্মানিত মেহমান হয়ে আসতেন প্রিন্সলি ষ্টেটগুলোর রাজা এবং রাজপুত্ররা। শাহাবাগের আর একটি ঐতিহাসিক ভবনের নাম ছিলো সুজাতপুর প্রাসাদ। পাকিস্হানী আমলে এটি ছিলো পূর্ববঙ্গের গভর্ণর হাউস, পরে বাংলা একাডেমি। এরই কিছু অংশে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের টিএসসি। কবিগুরু রবীন্দনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে ঢাকায় এলে এখানেই উঠেছিলেন।

Inside Hotel Shahbag

১৯৬৬ খ্রিঃ পাকিস্হান সময়ে শাহাবাগ হোটেলের সামনে নির্মিত হয় আরো উন্নতমানের একটি ফাইভ ষ্টার হোটেল যার প্রথম নাম ছিলো ইন্টারকন্টিনেন্টাল, পরে শেরাটন এবং তারপরে রুপসী বাংলা।

Image source: Google

১৯০৫খ্রিঃ ১৬ অক্টোবর চুড়ান্ত আইনীরুপ পেলো বঙ্গভঙ্গ আইন। কোচবিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মালদহ, জলপাইগুড়ি সহ ২টি দেশীয় রাজ্য ও ১৪টি জেলা নিয়ে পূর্ববঙ্গের রাজধানী হলো ঢাকা যার আয়তন ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল , লোকসংখ্যা ১ কোটি ১৮ লক্ষ মুসলমান এবং ১ কোটি ১২ লক্ষ হিন্দু। অপরদিকে যশোর ও কুষ্টিয়াসহ ১,৪১, ০০০ বর্গমাইলের ৫ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের পশ্চিমবঙ্গের তথা গোটা ভারতবর্ষের রাজধানী থেকে গেলো কোলকাতা। এ বিভাজন কোলকাতার বাবুদের পছন্দ ছিলো না। কারণ তাদের জমিদারিগুলো ছিলো পূর্ববঙ্গে। ঢাকায় নুতন হাইকোর্ট হওয়ায় কোলকাতার আইনজীবীরা মক্কেল হারাতে লাগলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় ছাত্ররা আর কোলকাতায় যেতে চাইলো না, সংবাদপত্রের কাটতি কমলো আর চট্টগ্রাম বন্দর সচল হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চিন্তায় পড়লো। শুরু হলো তুমুল আন্দোলন; বঙ্গভঙ্গ রদ করতেই হবে। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠায় কোলকাতায় যুগান্তর এবং ঢাকায় অণুশীলন গোষ্টী গুপ্তহত্যায় নেমে পড়লো। সেই সাথে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন সন্ত্রাসে রুপ নিয়েছিলো।

Shahbag. Image source: Google

১৯০৬খ্রিঃ ১৪ ও ১৫ এপ্রিলের নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন থেকে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে নবাবদের এই বাগানবাড়িতে জন্ম হলো মুসলিম লীগের। ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর চারদিনের এই সম্মেলনে সারা ভারতের চার হাজার ডেলিগেট অংশগ্রহন করেন। এই সম্মেলনে নবাব সলিমুল্লাহ খান“অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ” নামের একটি রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করলেন। এ সম্মেলনে নেতৃস্হানীয় যারা উপস্হিত ছিলেন তারা হোলেন নবাব ওয়াকার উল মুলক, নবাব মুহাসান উল মুলক, হাকিম আজমল খান, মৌলানা মোহাম্মদ জওহার, জাফর আলী খান, সৈয়দ নবীউল্লাহ, সৈয়দ জহুর আহমদ প্রমূখ। অসহযোগ আন্দোলনের তোড়ে রদ হয়ে গেলো বঙ্গভঙ্গ ১৯১১ সালে। কিন্তু আন্দোলন বুমেরাং হলো। উড়িষ্যা ও বিহার নিয়ে গঠিত হলো নুতন প্রদেশ পাটনা। কেটে ছেটে পশ্চিমবঙ্গের আয়তন হলো মাত্র ৩০ হাজার বর্গমাইল। আর রাজধানীও চলে গেলো কোলকাতা থেকে দিল্লি, সেই সাথে কোলকাতার বাবুদের নেতৃত্ব চলে গেলো নওরোজী, তায়েবজী, গোখলে, তিলক মেহতা, রানাডে লসপত আর সাভারকারদের হাতে। রাজধানীর হাজারো সুবিধা হারিয়ে কোলকাতা পেলো একটি প্রদেশের সম্মান। অন্যদিকে ঢাকায় জন্ম নেয়া মুসলিম লীগও চলে গেলো নবাব সলিমুল্লাহর হাত থেকে জিন্নাহ গং দের দখলে, যে শোকে তিনিও মারা গেলেন। ১৯৪৭ এর পরে সেই পূর্ববঙ্গ হলো পূর্ব পাকিস্হান এবং একাত্তরে পরে আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বহুবিধ ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত, ব্যপক সমাদৃত বাংলাদেশ। ১৯৬৫ খ্রিঃ পাকিস্হান সরকার শাহাবাগ হোটেলকে Institute of Post Graduate Medicine and Research (IPGMR).সংক্ষেপে পিজি হাসপাতালে রুপান্তর করেন এবং বর্তমানে এটির নামকরণ করা হয়Bangabandhu Medical University – BSMMU । ঢাকার শাহাবাগ হোটেলটি দিয়ে শুরু করেছিলাম ছোট্ট কিছু স্মৃতিকথা। এই হোটেলটির কোন চিহ্ন বাস্তবে না থাকলেও আছে একটি সিনেমায় যা আমার প্রজন্মের অনেকে দেখেছেন। ঢাকা চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ও অভিনেতা অভিনেত্রীরা ছিলেন রহমান, শবনম, গোলাম মোস্তফা, সুবাস দত্ত ও হাটখোলার দামাল ছেলে আজিম প্রমূখ। রাজধানীর বুকে, তালাশ, চান্দা, নতুন সুর এসব সিনেমাতে অভিনয় করে রহমান তখন খ্যাতির তুঙ্গে। “প্রীত না জানে রীত” নামের একটি সিনেমার সুটিং করতে সিলেটে গিয়ে পা হারিয়ে পঙ্গু হোয়ে যান রহমান। এই পঙ্গুত্ব নিয়েই তিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে মিলন নামে একটি উর্দ্দু সিনেমা নির্মাণ করেন যার নব্বইভাগ চিত্রধারণ করা হোয়েছিলো এই শাহাবাগ হোটেলে এবং হোটেলের কাউন্টারে। সে সময় পাকিস্তানী নায়িকা দিবা ও কোকিলকন্ঠী গায়িকা নূরজাহান মিলন সিনেমায় কাজ করে দিয়েছেন মাত্র এক টাকা পারিশ্রমিকে। পাকিস্তানী প্রথম সারির অবিবাহিত নায়িকা দিবা এই ঢাকা শহরেই খুঁজে পেয়েছিলেন অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া তার মাকে। পাকিস্তানের খুবই গরিব ঘরের মেয়ে দিবা তখনকার দিনের পাকিস্তানের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াহেদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী, দর্পন এদের বিপরীতে নায়িকার অভিনয় করে গ্লামারাস হোয়ে উঠেছিলেন। সবাই তাকে ডাকতো মোনালিসা। অনেক বড় বড় ধনী ও উচু খানদানের ছেলেরা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো অথচ তিনি খুব সামান্য বেতনের একজন ফটোগ্রাফারকে বিয়ে করে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে সংসারে ফিরে গিয়েছিলেন। আর ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের টগবগে তরুন এক ছাত্র আব্দুর রহমান ঢাকার সিনেমায় নায়ক হওয়ার আগে এই শাহবাগ হোটেলেই জুটিয়ে নিয়েছিলেন হোটেল রিসেপসনিস্ট এর একটি চাকুরি। সে সময়ের ঢাকার ফুটবল খেলার মাঠে মার মার কাট কাট মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, উয়ারী, দিলকুশা এসব দলের খেলার দূর্দান্ত রেফারি ছিলেন ননী বসাক। ঢাকার বংশালের এহতেশাম তখন নতুন পরিচালক ঠিকই চিনলেন ঝর্ণাকে। হারানো দিন সিনেমায় ঝর্ণা বসাক নায়িকা শবনম হোয়ে ডুবে গেলেন আর এক খাস ঢাকাইয়া সংগীত পরিচালক রবীন ঘোষের প্রেমে। এসব কথা যখন লিখছি তখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে শাহবাগ হোটেলের ভেতরে লম্বা রাবান্দা দিয়ে নায়িকা দিবার দৌড়ের দৃশ্যটি, আর কানে বেজে উঠছে পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক আহমেদ রুসদীর কন্ঠে রহমানের লিপসিং “তুম ছালামত রহ, মুসকুরা ওহাসো, মায় তোমহারা লিয়ে গীত গা তা রাহা হুঁ”। এখন সেই শাহবাগ হোটেল নেই, নেই রহমানের মিলন সিনেমা কিংবা গানটি, আছে কিছুটা দিন আমার মতো কিছু মানুষের স্মৃতির আর্কাইভে। রেজাউল করিম মুকুল, ২৯ নভেম্বর ২০২০খ্রিঃ।