১০১০ খ্রিস্টাব্দ। শিল্পকলার নিরিখে এই সালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৎসরেই তাঞ্জোরে তৈরী হয়েছিল রাজা রাজা চোলার বৃহদীশ্বর মন্দির আর এই বৎসরেই ফার্সি কবি ফিরদৌসী সমাপ্ত করলেন তাঁর শাহ নামা। ভবিষ্যতে চিত্রকলার ইতিহাসে এই দুই শিল্পকীর্তি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করবে।

১৫০১ সাল। ইরানে সাফাভি বংশের সূচনা হলো। ক্ষমতায় এলেন ইসমাইল শাহ। নতুন রাজধানী হলো তাব্রিজ(Tabriz, Presently in IRAN)।

১৫২২ সালে তাঁর আট বৎসরের পুত্র শাহ তাহমাস্পের হেরাত থেকে রাজধানী তাব্রিজে আসাকে স্মরণীয় করার উপলক্ষে একটি স্বচিত্রক শাহ নামা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিলেন। ২৩শে মে , ১৫২৪ সালে মৃত্যু হয় ইসমাইল শাহের। এর পর শাহ তাহমাস্পের রাজত্বকালেও চলবে এই কর্মযজ্ঞ। চলবে প্রায় দ্বাদশ বৎসর (১৫২২-১৫৩৭) ধরে Iএর পূর্বেও অনেক বাদশাহ শাহ নামা প্রস্তুত করিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই শাহ নামাটি শিল্প সৌন্দর্যের উৎকর্ষে ,অতীত ও ভবিষ্যতের সব শাহ নামাকেই অতিক্রম করবে।
তিরিশ হাজার কবিতার লাইনগুলো নাস্তালিক ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়েছিল । সবসুদ্ধ এই বইটিতে ২৫৮টি ছবি আঁকা হয়েছিল। পারস্যের পনেরো জন শিল্পী প্রায় বারো বৎসরেরও অধিক সময়কাল ধরে এই পুস্তকটি চিত্রিত করেছিলেন। এই পনেরো জন শিল্পীর মধ্যে নয়জন শিল্পী এই কাজে যুক্ত হওয়ার পূর্বেই বেশ স্বনামধন্য হয়ে উঠেছিলেন I
পারস্যের হেরাত ছিল অনুচিত্রের এক প্রখ্যাত কেন্দ্র। ইসমাইল শাহ হেরাত থেকে তাব্রিজে নিয়ে এসেছিলেন পারস্য শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ শিল্পী বেহেজাদকে। ১৫২২ সালে তাঁর প্রায় বাহাত্তর বছর বয়েস । কিন্তু এই কিংবদন্তির অনুপ্রেরণাই যে যথেষ্ট। স্রেফ তাঁর নামটাই যে তুলনার মানদন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হয় আপনি এই শিল্পীর সমালোচনা করবেন যেমন মোঘল বাদশা বাবর করেছিলেন না হয় প্রসংশা করবেন যেমন তুর্কি ঔপন্যাসিক ওরহান পামুক করেছিলেন – কিন্তু অবহেলা করতে পারবেন না। হেরাতের শিল্প শৈলী ও তাব্রিজের শিল্প শৈলীর মেলবন্ধন করেছিলেন তিনি।
শাহ তাহমাস্পের এই শিল্প -যজ্ঞে কে ছিলেন না ?
ছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর সুলতান মুহাম্মদ তাব্রিজি। নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে উনি এই তাব্রিজেরই বাসিন্দা ছিলেন। প্রাথমিক ভাবে এই কর্ম যজ্ঞের ভার সম্ভবত তারই উপর বর্তায়। বর্তমান পরিভাষায় বললে যাকে বলে একেবারে ‘প্রজেক্ট ডিরেক্টর ‘ I শিল্পী হিসাবে শুধু কাজই নয়, সব দিকেই যে তীক্ষ্ণ নজর থাকতে হবে।
ছিলেন দুই সৈয়দ বংশের শিল্পী – আকা মিরক ও মীর মুসাব্বির। হুমায়ুন যখন তাব্রিজের শিল্পকলায় মুগ্ধ, তখন তিনি এই মীর মুসাব্বিরকেই অগাধ পারিশ্রমিকের বদলে ভারতে আসতে অনুরোধ করেন। দিতে চেয়েছিলেন হাজার তুমেন। কিন্তু মীর মুসাব্বির রাজি হননি। রাজি হলেন তাঁর পুত্র মীর সৈয়দ আলী। মীর সৈয়দ আলী ভারতে এসেছিলেন ১৫৪৫ সালে। পরে তাঁর পিতা মীর মুসাব্বিরও এসে ছিলেন কিছুদিনের জন্যে। ১৫৪৮ সালে।
 
শিল্পী দোস্ত মুহাম্মদ শুধু তাঁর শৈল্পিক গুনের জন্যেই প্রসিদ্ধ ছিলেন এমন নয় তাঁর লেখা অতীত ও বর্তমান শিল্পীদের জীবন নিয়ে রচিত আলেখ্য এই শিল্পীদের পরিচয় আমাদেরকে অবহিত করায়।
 
এই সময়টা ছিল পারস্যের চিত্রকলার “High Renaissance” I এক গবেষকের মতে এই শাহ নামাটি ছিল ,
“ …..an Italian project of equivalent magnitude or significance would have to have been a national epic such as the Divine Comedy of Dante and to have included in one single, monumental and profusely illustrated volume the masterpieces of a host of Renaissance artists such as Leonardo, Bellini, Perugino, Michelangelo, Raphael, Giorgione, Titian, Correggio and more, and their pupils.”
 
আপনি মনে করুন যদি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি , রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো সবাই একসাথে মিলে একটা স্বচিত্রক পুস্তক প্রস্তুত করতেন তা হলে তার কি মূল্য হতো ? এক সঙ্গে অনেক স্বনামধন্য শিল্পী কাজ করেছিলেন শাহ তাহমাস্প এর শাহ নামাতে। আর তাব্রিজও অনুচিত্রের শিল্পকলার নিরিখে যে স্থানে পৌঁছেছিল তার পেছনেও আছে দীর্ঘ ইতিহাস।
পারস্যে ইসলাম আসে আরবদের হাত ধরে। আরব অনুচিত্রের প্রভাব পরে পারস্য চিত্রকলায়। চেঙ্গিজ খান পারস্য আক্রমণ করলে চীনের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হয়। এর ফলে চৈনিক শৈলীও প্রভাবিত করে পারস্য চিত্রকলাকে। সিরাজ , হেরাত – এই শহরগুলোতে গড়ে ওঠে এক একটি চিত্রকলার ঘরানা।
রাজপৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও এই শহরগুলি প্রাচীন রেশম পথের দ্বারা সংযুক্ত হওয়াতে ব্যাবসায়ীদের হাত ধরে ছবি শিল্পের একটা ‘Demand and Supply Chain ‘ গড়ে উঠেছিল I আগেই বলেছি সাফাভি বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইল প্রথম, হেরাত থেকে প্রখ্যাত শিল্পী বেহেজাদকে নিয়ে এলে হেরাত ঘরানার ছোঁয়া লাগে তাব্রিজি ঘরানায়। এভাবেই পারস্য চিত্রকলা ধীরে ধীরে এক চরম উৎকর্ষের জায়গায় পৌঁছায়।
ভারতের শিল্পকলাতেও ফিরদৌসির শাহ নামার যথেষ্ঠ প্রভাব দেখা যায়। দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই শাহ নামা ভারতে জনপ্রিয়। দাক্ষিণত্বের রাজারা যেমন শাহ নামার স্বচিত্রক পুস্তকাবলী প্রস্তুত করান তেমনই সাধারণ ধনী ব্যবসায়ীরাও বাদ যেতেন না। মুম্বাইয়ের ছত্রপতি বাস্তু সংগ্রহশালাতে রক্ষিত জৈন কল্পসূত্রের মার্জিনে শাহ নামার জনপ্রিয় দৃশ্য দেখে বোঝা যায় যে জৈন ব্যাবসায়ীরাও এর প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিলেন।
বিজাপুরের সম্রাট ইব্রাহিম দ্বিতীয় আদিল শাহ (১৫৮০-১৬২৭) এক অসাধারণ শাহ নামা প্রস্তুত করান। তবে ভারতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাহ নামা রাজ পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাতিরেকে প্রস্তুত হয়েছিল। এর কারণ বোধহয় পারস্যের সঙ্গে ব্যাবসায়িক যোগাযোগ ও শাহ নামার অসাধারণ কাহিনীগুলি । উইলিয়াম জোন্স তো ফিরদৌসীকে ‘প্রাচ্যের হোমার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আজও যে শাহ নামার নাম অবধি শোনেনি সেও লায়লা ও মজনুর নাম সম্পর্কে অবহিত। সোহরাব ও রুস্তমের কাহিনী আজও বেশ জনপ্রিয়। ফারহাদের ব্যার্থ প্রেমের কথা কেই বা জানেনা ?
আবার ভারতীয় কবিদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন পারস্যে। যেমন নিঃসন্দেহে বলা যায় আমির খুসরুর ‘খামসা’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকেই পারস্যের কবি নিজামীর খামসার থেকেও আমির খুসরুর ‘খামসা’ কে পরম উৎকৃষ্ট বলে মনে করতেন। তাই সাহিত্য বা শিল্পে এই আদান প্রদান ছিল দ্বিপাক্ষিক ও সমৃদ্ধকারী । রবি ঠাকুরের ভাষাতে যে বাঙময় হয়েছে সেই রূপটি :
‘পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে’—
শাহ তাহমাস্পের শাহ নামা সম্বন্ধে গবেষক ওয়েল্চের অন্বেষণ একটু দেখে নেওয়া যাক: Stuart Cary Welch and Martin Dickson concluded that of the fifteen, nine were major painters and five their assistants. Two additional paintings, on thicker paper, were finished sometime around 1540. Encased within its bejeweled, gilded leather binding, with a dedicatory rosette sans colophon, were 759 burnished folios (47 by 31.8 cm), of which 258 were full-page miniatures adorned by 30,000 poetic verses in rhythmic nasta‘liq calligraphy, with magnificent gold-flecked margins around a ruled area (26.9 by 17.7 cm). It was gifted by the second Safavid shah, Tahmasp I (r. 1524-76), to the eleventh Ottoman sultan, Selim ‘the Sot’ II (r. 1566-74) with a Qur’an reputedly penned by Ali, Muhammad’s cousin and fourth Caliph.
ইতিহাসে কি পরিণতি হয়েছিল এই শাহ নামার ? ১৫৬৮ সালে ১৬ই ফেব্রুয়ারী এই মূল্যবান গ্রন্থটি শাহ তাহমাস্প উপহার দেন অটোমান তুর্কি সম্রাট সুলতান সেলিম দ্বিতীয়কে (১৫৬৬-১৫৭৪) I দীর্ঘদিন এই শাহ নামা ছিল ইস্তানবুলের টোপকাপি প্যালেস লাইব্রেরিতে।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে এই শাহ নামাটি ধনকুবের এডমন্ড রথসচাইল্ডের, Baron Edmond de Rothschild (1845-1934),হাতে আসে। এরপর মার্কিন ধনকুবের আর্থার হাওটন (Arthur Houghton )১৯৫৯ সালে এই গ্রন্থটি ক্রয় করেন। সেই সময় এই বইটিতে ৭৫৯ পৃষ্ঠা ও ২৫৮ ছবি ছিল।
অধিক লাভের জন্যে আর্থার হাওটন বইটির বাঁধন ছিঁড়ে পৃষ্ঠা গুলোকে আলাদা আলাদা করে বিক্রি করতে থাকেন। কেমন দাম হতে পারে এই পৃষ্ঠা গুলির ? ক্রিস্টির ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে নিলামে সাতটি পৃষ্ঠার দাম উঠেছিল ৭,৯৩,৫০০ পাউন্ড I এই অসাধারণ পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে বিক্রি করার ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত চিত্রশিল্পের পুস্তকটি চিরকালের জন্যে নষ্ট হয়ে যায়। নিলামে আলাদা আলাদা করে বিক্রয় করার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায় এই অশেষ মূল্যবান গ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি। যদিও এই বইয়ের ৭৮টি ছবি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেট জাদুঘরে দান করেছিলেন। যে ধনকুবের শুধুমাত্র অর্থের লোভেই এই শাহ নামাটি ছিঁড়ে ফেলেন , তাঁর নামের দ্বারা অভিহিত করা হয় এই গ্রন্থটি। আজকে এই গ্রন্থের পরিচয় ‘The Houghton Shahnama’ নামে I
 
বুদ্ধের পিতা, দেবদত্ত ও তাঁর পুত্রকে এক পক্ষী শিকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি শিক্ষা দিয়েছিলেন ? ইতিহাস বোধহয় সেটা ভুলে গেছে আর ভুলে গেছে এই অসাধারণ চিত্রশিল্পীদের। যে শিল্পীগণ তুলির জাদুতে ফিরদৌসির কবিতার প্রাণ সঞ্চার করল তাঁদের পরিচয় আজ কোথায় ? আর ভারতের চিত্রকলার ইতিহাস ও বিবর্তনের সঙ্গে এদের অনেকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযোগ ছিল। আজ বিপণন যে সর্বব্যাপী আর শিল্প বা শিল্পী শুধুই সেই বৃহত্তর মার্কেট অর্থিনীতির এক দাবার ঘুঁটি। তাই এই শাহ নামা সম্পর্কে জানতে হলে গুগুলে খুঁজতে হয় সেই Houghton Shahnama লিখেই।
 
(Picture: The Court of Gayumars painting from Houghton Shahnameh. Picture Source: Wikipedia)