আনারকলি। ইতিহাসের এক রহস্যজনক চরিত্র। ভারতের “মুঘল-ই-আজম” সিনেমাতে আকবরপুত্র সেলিম ও মোঘল দরবারের নর্তকী আনারকলির সাথে গভীর প্রণয় দেখানো হয়েছে, যেই ভালোবাসার অপরাধে আকবর আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করেছিলেন। কিন্তু এই যে ঘটনাটি দেখানো হয়েছিল তার সত্যতা কতটুকু? সত্যিই কি আনারকলিকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল? নাকি আনারকলি বলে ইতিহাসে কোনো চরিত্রই ছিল না? নাকি সব কিছুই কেবল লোকে মুখে ছড়িয়ে পড়া একটি গল্প? আসুন জেনে নেয়া যাক।
গল্পটির সত্যতা খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে লাহোরে, ষোলোশো শতাব্দীতে । শহরের মাঝখানে একটি বাজার আছে যার নাম আনারকলি বাজার। সেই বাজারের পাশেই রয়েছে এক বিস্ময়কর সমাধিসৌধ। সবাই একে আনারকলির সমাধি বলেই জানে। সমাধির গায়ের এপিটাফ থেকে জানা যায়, যিনি এখানে শায়িত আছেন তার মৃত্যুর সময়কাল ছিল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ। যা পরবর্তীতে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পুনঃসস্কার করা হয়। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর মার্বেল পাথর দিয়ে খচিত এই সমাধির গায়ে ফার্সি ভাষায় লেখা আছে একটি কবিতা-
“আমি যদি আমার প্রিয়তমার মুখটি আবার দু’হাতে ছুঁতে পারতাম, তবে কেয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম।”
এতো সুন্দর কবিতা শুধুমাত্র একজন প্রেমিকই তার প্রিয়তমার জন্যই লিখতে পারে। কবির নামও অবশ্য সমাধির নিচেই উল্লেখ করা ছিল। হ্যা, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আকবরপুত্র সেলিম।
তুর্কমেনের বংশোদ্ভূত আনারকলির আসল নাম ছিল নাদিরা বেগম বা শার্ফ-উন-নিসা। বলা হয়ে থাকে, এক বণিক দলের সাথে ইরান থেকে লাহোর আসে নাদিরা বানু। সেখান থেকে মোঘল সম্রাটের হারেমে। নাদিরা বানু হারেমের একজন কানিজ ছিলেন। তার গায়ের রং ডালিম বা আনারের ফুলের মতো সুন্দর ছিল বলে সম্রাট আকবর নিজেই তার নাম দিয়েছিলেন “আনারকলি”। আর তার এই অসাধারণ রূপের কারণে আকবরপুত্র সেলিম আনারকলির প্রেমে পড়েন। তাদের এই সম্পর্ক সম্রাট আকবর কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাই ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ার অপরাধে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল আনারকলিকে। কিন্তু কোথায় সেই সমাধি তা আমরা কেউ জানি না।
ইতিহাস ঘেটে আমরা জানতে পারি, মোঘলরা তাদের আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিল। “আকবরনামা” -র লেখক আবুল ফজল আকবরের শাসনামলের বড় ঘটনা থেকে শুরু করে ছোটোখাটো ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। এমনকি সম্রাট জাহাঙ্গীর যে হিংসায় বশবর্তী হয়ে আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন, সে ঘটনাটিও জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী “তুজুক -ই -জাহাঙ্গীর” -এ উল্লেখ ছিল। “আকবরনামা” তে যদিও বা না থাকুক, কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর তার প্রিয়তমা আনারকলির প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ নিজের আত্মজীবনীতে লিখে যাবেন না, এটাও ঠিক মেনে নেয়া যায় না। আসলে সেই সময়ের কোনো ইতিহাসে, কোনো আত্মজীবনীতে আনারকলি নামের কোনো নারীর নাম উল্লেখ নেই। তাহলে যুগে যুগে যে প্রেম কাহিনী আমরা শুনে আসছি বা দেখে আসছি সেই ঘটনার ভিত্তি কি?
শাহজাদা একজন কানিজকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, সেই সময় এটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না, যেখানে সম্রাটের হারেমে হাজার হাজার কানিজ ছিল। “আকবরনামা” -র অনুবাদক এইচ বেভারিজের বক্তব্য মতে, আকবরনামায় উল্লেখ আছে শাহজাদা সেলিম জায়েন খানের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট আকবর এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। কারণ শাহজাদা সেলিম ইতিমধ্যে জায়েন খানের ভাগ্নির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেই কথা বিবেচনা করলে, জায়েন খানের মেয়ে ছিল সম্পর্কে আকবরের বোন। তাই অসম বিয়েতে আকবরের মত ছিল না যদিও পরবর্তীতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে শাহজাদা সেলিমের দুই স্ত্রীর কারও মৃত্যুর তারিখ জানা যায় নি।
যে জায়গাটিতে আনারকলি বাজারের উল্লেখ আছে সেখানে শাহজাদা দারা শিকো যেতেন তার পীরের কাছে দীক্ষা নিতে। তার বিভিন্ন লেখায় সেই জায়গাটির বর্ণনা আছে। কিন্তু আনারকলি নামে কারও সমাধি যদি থাকতো তবে দারা শিকো সেই বর্ণনা কেন করেননি? তার মানে, যে কিংবদন্তি গল্প মানুষের মুখে ছড়িয়েছে সত্যিকার অর্থে সেই রকম কোন ঘটনা কখনো ঘটেইনি।
এবার আমাদের যেতে হবে আঠারো শতকে। লাহোরের দুইজন ঐতিহাসিক আব্দুল্লাহ সাগতি এবং মুহাম্মদ বাকির আনারকলির সমাধি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তারা বলেছেন, আনারকলি বাজারে অনেক আগেই একটি অজানা সমাধি ছিল। তখন কেউ জানতো না সমাধিটি কার। কিন্তু ধীরে ধীরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থানীয় লোকে-মুখেই আনারকলির গল্প ছড়িয়ে পরে। যেই গল্পের প্রকৃতঅর্থে কোন ভিত্তিই ছিল না।
আরেকটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের আরও এক শতক পেছনে যেতে হবে। উর্দু ভাষায় পারদর্শী একজন ফরাসি ঐতিহাসিক এলাইন ডিসোউলিরেস তার গবেষণা পত্র “Historical Fiction and Style: The case of Anarkali” -তে বলেছেন, আনারকলি ঘটনার জন্ম হয় মূলত ইংরেজ পর্যটকদের মাধ্যমে। পর্যটকেরা ছিলেন উইলিয়াম ফেঞ্চ, এডওয়ার্ড হেরি এবং বিশপ হার্বার্ট। সতের শতকের দিকে তারা লাহোর ঘুরতে আসলে সেখানকার লোকমুখে আনারকলিকে নিয়ে নানা গল্প শোনেন। পরবর্তীতে উইলিয়াম ফেঞ্চ তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছিলেন, সেই সমাধিটি ছিল আকবরের একজন স্ত্রীর ও তার তৃতীয় পুত্র ড্যানিয়েলের মায়ের। তাকেই সেখানে জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল তারই সৎপুত্র সেলিমের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অপরাধে। যদিও ফেঞ্চ-এর এই ঘটনায় কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। কারণ, ড্যানিয়েলের মায়ের মৃত্যু হয়েছিল আরও আগে ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে। আর অজানা সমাধির ব্যাক্তিটি মারা গিয়েছেন ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে এলাইন ডিসোউলিরেস বলেছেন, আনারকলির এই গল্পটি মূলত ছড়িয়েছিলো ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ব্রিটিশরা মোঘলদের বিরুদ্ধে এই ধরণের মিথ্যা গল্প ছড়িয়েছিলো কারণ তারা বোঝাতে চেয়েছিলো মোগলরা কতটা নিষ্ঠুর আর ব্রিটিশরা অনেক দয়ালু।
ভিক্টোরিয়ান যুগে ইংরেজরা সবসময় চেয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের সব অন্যায়, অত্যাচার, অপকর্মগুলোকে ঢেকে রাখতে। তারা এই উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন অন্যদের অন্যায়গুলো মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে। তাই তারা তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মোগলদের বেছে নেয়। মোগলদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার তারা চালাতে থাকে। তারা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে মোঘলরা আসলে ন্যায় শাসক নয়। ভালো মানুষির আড়ালে তারাও নানা অমানুষিক অত্যাচার করেছে। আনারকলির গল্পটিও মোঘলদের বিরুদ্ধে এমনই একটি অপপ্রচার। ইংরেজরা মোঘলদের ঘাড়ে পা রেখে রাজ্য শাসন করতে চেয়েছিলো। হিন্দুদের সাথে মুসলমাদের দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছিলো। তারা যে তাদের এই অন্যায় পরিকল্পনায় সফল হয়নি তা নয়। কিন্তু তাদেরকে একদিন এই উপমহাদেশ থেকেও বিদায় নিতে হয়েছিল। কারণ মানুষ তখন সত্য মিথ্যা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল এবং একসময় তাদেরকে এই উপমহাদেশের মাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিল।
এবার চলুন যাওয়া যাক বিংশ শতাব্দীতে। লাহোর। ১৯২২ সালে ইমতিয়াজ আলী “আনারকলি” নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন, যার বিষয়বস্তু ছিল, গরিব ঘরের একটি সুন্দরী মেয়ে এক বড়লোক ঘরের ছেলেকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু তাদের এই ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি। ইমতিয়াজ আলী লাহোরেই বড় হয়েছিলেন বলে, আনারকলিকে নিয়ে সেই সব লোকগল্প তার অজানা ছিল না। তাই তিনি ভেবেছিলেন, ইতিহাসভিত্তিক নাটকের জন্য এই বিষয়বস্তুটি উপুযুক্ত। এবং তার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে “আনারকলি” নাটকটি খুব জনপ্রিয় হয়। নাটকের সফলতার পরপরই ইমতিয়াজ আলী সিদ্ধান্ত নেয় এই গল্প দিয়েই তিনি সিনেমা বানাবেন। ১৯২৮ সালে তার সিনেমাটি মুক্তি পায়, যেখানে অভিনয় করেছিলেন দু’জন বাঙালি অভিনয়শিল্পী প্রফুল্ল রায় ও চারু রায়। এই সিনেমাটিই যেনো আনারকলির গল্পকে একটি জীবন দিয়ে দিলো। লোকে মুখে বলা একটি কিংবদন্তি মানুষ ধীরে ধীরে সত্যি বলে মেনে নিতে শুরু করলো।
মানুষের এই বিশ্বাসকে আরও পাকাপোক্ত করে ভারতের কালজয়ী সিনেমা “মুঘল-ই-আজম।” দিলীপ কুমার আর মধুবালার অসাধারণ অভিনয়ে মানুষের মনে আনারকলি আর সেলিমের জন্য ভালোবাসা জমতে থাকে। এই সিনেমাটিতে আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা দেখানো হয়নি। সেখানে আনারকলি দেয়ালের লুকানো গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। কারণ আকবর ছিলেন একজন যোগ্য শাসক। শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক লোক সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে তাকে অসম্মান করার কোনো উপায় ছিল না।
আনারকলি নামে আসলে কেউ ছিলই না কোনোদিন। যুগ যুগ ধরে মুখে মুখে বানানো একটি গল্প কি করে আজ সকল মানুষের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়, আনারকলি তার একটি জলজ্যান্ত প্রমান। মানুষ রোমাঞ্চকর বিষয় পছন্দ করে। এই যে আজ আমরা এতো তথ্য প্রমান সহ বিষয়টি ব্যাখ্যা করলাম সেটাও হয়তো অনেকের পছন্দ হবে না। কিন্তু সত্যি এটাই যে আনারকলি একটি জীবন্ত কিংবদন্তি, যা থেকে শুরু হয়েছিল সব ভ্রান্ত ধারণা। বাস্তবে আনারকলি নামের কোন নারীর অস্তিত্ব নেই।