লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত পাল যুগের অগ্নি মূর্তি ও দূর্গা মূর্তি সহ বহু ভারতীয় জিনিস সংগ্রহ হয়েছিল চার্লস স্টুয়ার্টের কাছ থেকে। অনেকর মতে, ভারতীয় সংগ্রহের ৭০% ই স্টুয়ার্টের। আসলে এটা কি সংগ্রহ ? নাকি লুট করেছিলে এই বাংলা থেকে? প্রশ্ন জাগে, কে এই চার্লস স্টুয়ার্ট ?
১৭৭৭ সালে কোম্পানির সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে বাংলায় আসেন চার্লস স্টুয়ার্ট। তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। পরবর্তীতে, তিনি মেজর জেনারেলও হয়েছিলেন। তিনি বেতনের একটা অংশ নিজের এক অদ্ভুত শখের পেছনে খরচ করতেন। সারা ভারত থেকে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তিসহ ভারতীয় পুরাতত্বের নানা নিদর্শন এনে জড়ো করতেন নিজের বাসায়। তবে শুধু মাত্র সংগ্রাহক দৃষ্টি দিয়ে এই কর্মকান্ডকে দেখলে ভুল হবে। এই কাজ করতে তিনি “হিন্দু”ও হয়েছিলেন!! হ্যাঁ, তিনি পুরোদমে ‘জয় সীতারামজি’ বলতেন, পূজাঁ করতেন। ইংরেজরা তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে সব রকম প্রচেষ্টায় চালিয়েছিল। সেসময় অনেকে তাকে “হিন্দু স্টুয়ার্ট” বলেও ডাকতেন। আজ আমরা সেই গল্প আলোচনা করবো।
সেই সময় তারা এদেশে এসে দেশিয় রীতি-রেওয়াজ আপন করে নিতেন। ফলে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি তো হতোই, তার সাথে সাথে পদ মর্যাদাতেও লাভ হতো প্রচুর। এই প্রবণতা বিশেষ করে নিচের কর্মীদের মধ্যে দেখা যেত। আবার কেউ কেউ হিন্দু ধর্মও গ্রহন করেছিলেন। জব চার্ণকের মতো অনেকেই ভারতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলেন। কোম্পানির বড় সাহেবেরা কলকাতার দেশীয় বড়লোকদের বাড়িতে নিয়মিত বিভিন্ন পূজা পার্বনে হাজির হতেন । স্যার উইলিয়াম জোনসও ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিশেষ করে ১৭৯০ থেকে ১৮২০ সালের সময় তারা হিন্দুধর্মকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মিশনারিদের ঘৃণাও করতেন। এরকমই কিছু চিন্তা ভাবনা করতেন চার্লস স্টুয়ার্ট এবং এসব বিষয়ে তিনি অনেক লেখাও লিখেছিলেন। দারুন উদ্দীপনার সাথে চার্লস স্টুয়ার্ট গঙ্গা স্নান, পূঁজা অর্চনার মতো আচরণ পালন করেই থেমে থাকেননি। একই সাথে মিশনারিদের কাজকর্মের ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন। নিজের খরচে একটি পুস্তিকা লিখে ছাপিয়ে ছিলেন, বইটির নাম “A Vindication of the Hindoos”। এখানে তিনি ভারতে মিশনারিদের কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন – “মনে হয় খ্রিষ্ট ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্ম অনেক নতুন পথের নির্দেশ দিতে পারে। সভ্য সমাজের সব নৈতিক আদর্শ ও আচরণ বিধির জ্ঞান হিন্দু ধর্ম তার অনুসরণকারীদের খুব ভালো ভাবেই দিতে সক্ষম। ” সমালোচকদের জবাব দিতে তিনি লিখেছিলেন যে “হিন্দু ধর্মের পুরাণগুলির প্রতীকী অর্থ না বুঝলে, সেগুলির সঠিক মর্ম বোঝা যাবে না। আমার মনে হয় যে, পৃথিবীর সব থেকে জটিল নৈতিক রূপক ব্যবস্থা বোধহয় হিন্দু মুনি ঋষিরাই তৈরী করে গিয়েছেন।”
শুধু জ্ঞান বিদ্যায় নয়, স্টুয়ার্ট আচার আচরণেও হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু। ধুতি পরা থেকে শুরু করে তিনি পান খাওয়া, কপালে তিলক দেওয়া, পূজা আহ্নিক করা ইত্যাদি করতেন। কিন্ত অবাক হতে হয় যখন তিনি একবার বিলেত গেলেন তখন নিজের সংগৃহিত দেব মূর্তিগুলিও সাথে করে নিয়ে গেলেন। এখান থেকেই শুরু হলো লুটের কাহিনী।
নিজের সেনাবাহিনীর পরিচয় কাজে লাগিয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বহু মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্ন সামগ্রী। ভারতীয় বিভিন্ন দেব দেবীর অসংখ্য মূর্তি সংগ্রহের কারণে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটাররা তাকে বলেছেন “visual encyclopedia”!! কিন্তু আমরা কি বলবো?
তবে, চার্লস স্টুয়ার্টের জীবন নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বিশিষ্ট লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পেল তার “White Mughals” বইতে হিন্দু স্টুয়ার্ট সম্পর্কে কিছুটা লিখেছেন। তার মতে স্টুয়ার্ট বিয়ে করেছিলেন এদেশীয়ে এক হিন্দু মহিলাকে।
অন্যদিকে, তার মৃত্যুর পর ১৪৩টি বাক্স বোঝাই স্টুয়ার্টের কালেকশন বিলেত পাড়ি দিলো। ১৮২৮ সালে তার সম্পত্তি জাহাজ যাত্রার সময় বিমা করা হয়েছিল প্রায় তিরিশ হাজার টাকা মূল্যে !! চার্লস স্টুয়ার্টের এই ১৪৩ টি বাক্স ভর্তি প্রত্নসামগ্রী কিভাবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পৌছুলো, সেটা আরেক গল্প।
জানা যায়, ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যোগ দিলেন অগাস্টাস ফ্রাঙ্ক। তার উৎসাহেই ফুলে-ফেঁপে উঠলো ভারতীয় পুরাতাত্বিক সংগ্রহের ভান্ডার। এই সময়ে ভারত সম্পর্কে বাইরের বিশ্বে আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন জ্ঞানের শাখা সম্পর্কে জানতে উৎসুক হচ্ছে বাকি বিশ্ব। তার সাথে যুক্ত হলো রোম্যান্টিক আন্দোলনের ফলে দুনিয়াকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, শিল্পকে পরখ করার নতুন মাপদণ্ড। উনি কাজে যোগ দিয়েই পুরাতাত্বিক সংগ্রহের দিকে নজর দিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে পুরোনো এংলো-স্যাক্সন সংস্কৃতি অন্য দেশের পুরোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে তার ঝোঁক ছিল। স্টুয়ার্টের কলকাতার নিজের উড স্ট্রিটের বাড়িতে মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা তৈরি করে, তার সংগ্রহের মূর্তি ছাড়াও প্রাচীন পুঁথি, অস্ত্র, অলংকারগুলি সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছিল। কেউ উৎসাহী হয়ে দেখতে চাইলে তিনি খুব যত্ন নিয়ে সেগুলি ঘুরিয়ে দেখাতেন। এমনকি তাঁর অনুপস্থিতিতে কোনো দর্শনার্থী এলে তাদের ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য বাড়ির কাজের লোকেদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি । স্টুয়ার্ট মারা যাওয়ার পর তার সমস্ত সম্পত্তি বিলেত এলো আর ১৮৩০-এ নিলাম হয়ে গেল সেই সব বহুমূল্য সামগ্রী। এই নিলামে সংগ্রহের একটা বড় অংশ কিনে নিলেন জন ব্রিজ। যিনি “রান্ডেল ব্রিজ এন্ড রান্ডেল” নামক বিখ্যাত অলংকার ব্যবসায়ী সংস্থার অংশীদার ছিলেন। কিছু অংশ যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব সংগ্রহশালা “ইন্ডিয়া মিউজিয়াম”-এ। পরবর্তীতে সেইসব সংগ্রহ ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সংগ্রহে যুক্ত হয় । আজ বৃটিশ মিউজিয়ামে ভারতীয় পুরাতাত্বিক নিদর্শন হিসাবে যা কিছু প্রদর্শিত হয়, তার সর্বাধিক সংগ্রাহক এই চার্লস স্টুয়ার্ট।
আর তার নিথর দেহ পড়ে রয়েছে আত্বীয়-স্বজন থেকে সাত সমুদ্র দূরে কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিটের সিমেট্রিতে, সেখানে হিন্দু মন্দিরের আদলে তৈরি তার সমাধিটি আরেকটি ব্যতিক্রম। তাই তিনি হিন্দু স্টুয়ার্ট নামেই সবার কাছে পরিচিত। এমনকি সমাধির এপিটাফে- `Hindoo Stuart’ লেখা আছে।
তথ্য সূত্রঃ
White Mughals, William Dalrymple.
Sculpture from India by Michael D. Willis.
কলিকাতা: সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়.
উইকিপিডিয়া।