রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্য সম্পর্কঃ হোরিয়া পিপারটারিয়া হলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে অবস্থিত এক বিশাল ভবন। হোরিয়া শব্দের অর্থ ওয়্যারহাউজ বা গুদামঘর আর পিপারটারিয়া শব্দটি পিপার বা গোলমরিচ থেকে এসেছে। সুতরাং আমরা ধারনা করতে পারি যে, এই হোরিয়া পিপারটারিয়া ছিলো গোলমরিচ রাখার একটি বিশাল গুদামঘর। ১৯৩৩ সাল , রোম নগরে হঠাৎ করেই এই হোরিয়া পিপারটারিয়া ভবনটি খুঁজে পাওয়া যায় । ভবনটির প্রবেশপথের খিলানের নিচের দিকে পুরো জায়গা জুড়ে রয়েছে গোলমরিচের আকৃতির নকশা । শুরু হয় গবেষণা, উদঘাটিত হয় সত্য l এটি প্রমাণিত হয়, হ্যাঁ, এটি একটি গোলমরিচ রাখারই গুদামঘর l প্রাচীনকালে ভারতের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের যে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো তার এক নতুন ইতিহাস উঠে আসে এর মাধ্যমে। আমরা সকলেই রোমের সাথে ভারতীয় উপমহাদশের বানিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে কমবেশি অবগত, তার প্রমাণও এবার পাওয়া গেলো l ঐ সময় গোলমরিচগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে যেতো। তাই, হয়তো বাংলাও এ বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিলো । সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল এক বাণিজ্যিক নগর l গোলমরিচ ছাড়াও ভারত সারাবিশ্বের সাথে মুক্তা, অলংকার, বস্ত্রশিল্প ও স্পাইসিস বা মশলাসমূহের বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর সোনা উপার্জন করতো।
বানিজ্যিক হিসাব দিতে গিয়ে রোল ম্যকগুলিন বলেন, ঐ সময় ভারত থেকে মোট ৫ হাজার টন গোলমরিচ রোমে যায়, যার বিনিময়ে সমপরিমান বাজারদর মূল্য ১৫ হাজার টন সোনা ভারত আয় করে।
গ্রীক ভূগোলবিদ স্ট্রাবো তার বইয়ে বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১২০ টি রোমান বাণিজ্য জাহাজ বাণিজ্যের উদ্দেশে কয়েক মাসের পথ পারি দিয়ে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে পৌঁছাতো। সেপ্টেম্বরে যেতো এবং তিন সপ্তাহ পর ফিরতি যাত্রা করতো। আর ডিসেম্বরে মরুভূমির মধ্য দিয়ে ঐ মশলা জাতীয় পণ্যের বাণিজ্যকাফেলা মিশরের নীল নদীতে এসে পৌঁছাতো । মিশর তখন রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হওয়াতে বাণিজ্য করা আরও সহজ হয়। এই বিশাল বাণিজ্য সেসময় ভারতকে আরও সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করেছিলো। মিশরের নীল নদীর কাছেই ছিলো আলেক্সজান্দ্রিয়া বন্দর। আলেক্সজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে লোহিত সাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে আসা পথ আরও সহজ হয়ে যায়।
স্পেসিফিক, স্পেশাল ও স্পাইসিস শব্দ তিনটিই একই ল্যাটিন শব্দ স্পিশিস থেকে ইংরেজিতে এসেছে। স্পিশিস শব্দটি স্পাইসির সাথে জড়িত, এই স্পাইসগুলো ভারত থেকে রোমে যেতো , বিনিময়ে সোনা ও ব্রোঞ্জের পাহাড় গড়ে তোলে ভারত। ৫ম শতকে আলেক্সজান্দ্রিয়া বন্দরে কত ধরনের পণ্য সারা বিশ্ব থেকে আমদানী করা হতো তার একটি বিশাল তালিকা করা হয়েছিলো। দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ৫৪ টি পণ্যই ভারত থেকে আমদানি করা হয় l এর মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের গোলমরিচ, দারুচিনি, আদা, লবঙ্গ, এলাচদানা, সুগন্ধি তেল, হাতির শিংয়ের অলংকার, কচ্ছপের শেল, বিভিন্ন মণি-মুক্তা, রত্ন, সিংহ, চিতাবাঘ ইত্যাদি। প্রফেসর স্কট লেভির মতে, বস্ত্রশিল্প, মশলা ও ভারতের অন্যান্য কৃষিপণ্য এবং শিল্প সামগ্রীর বিনিময়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বণিকদের কাছ থেকে ভারত যেসব মুদ্রা আয় করতো তা হলো- দীনার, তংকা, দুকাত, সোনার গিল্ড, রিয়াল, ফ্রাংক, রিথলার ও অন্যান্য মূল্যবান মুদ্রাসমূহ। যেগুলো পরবর্তীতে ভারতীয় রূপিতে রূপান্তরিত করে ভারত এক শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলেছিলো l
রোল ম্যকগুলিন বলেন, বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে রোমান সাম্রাজ্যের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রাজস্ব আয় হতো শুধুমাত্র ভারতীয় পণ্য আমদানীর খাত থেকে। রোম থেকে ভারতে যেতো সোনা ভর্তি জাহাজ নিয়ে আর ফেরৎ আসতো বিভিন্ন মনোহরী উপদান নিয়েl আসলে মজা করেই বলা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যের সকল পথ শেষ হতো ভারত উপমহাদেশে এসে; ১২০০ বছর পরেও ঘটনার কোনো পরিবর্তন হয় নি। ১৭ শতকে ফ্রান্সের পর্যটক বার্নিয়ের বলেন, সারা পৃথিবীর সোনা ও ব্রোঞ্জের একটি অদ্বিতীয় ভান্ডার হলো ভারত। বার্নিয়ের অনেক কয়েক বছর ভারতেই বসবাস করেন। তার অভিজ্ঞতা গুলো বই আকারে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন বলেই মসলিন আমাদের কতখানি গর্বের তা আমরা জানতে পারি l