১৬৭০ সালে, নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিং পাঞ্জাব থেকে ঢাকায় এসে গুরুদুয়ারা নানকশাহী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। যা সুজাতপুর শিখ সঙ্গত নামে পরিচিত ছিল। সূত্রাপুর শিখ সঙ্গতে তার একটি তৈলচিত্রও সংগৃহিত আছে। তিনি শিখ গুরু নানকের শিক্ষা ও জ্ঞান প্রচারের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করার পরে, কয়েকটি স্থানেই শিখ মন্দির গড়ে তোলেন। ঢাকা ছিল শিখ গুরু নানকের স্মৃতি বিজড়িত এলাকা।

কিন্তু, এই শান্তির গুরু তেগ বাহাদুরের সাথে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরোধ বেধেঁছিল; যার ফলে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তেগ বাহাদুরের এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আজও শিখ ও মুসলিমদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে। কে এই তেগ বাহাদুর? কে এই আওরঙ্গজেব? কেন এই যুদ্ধ? জানা যায়, তেগ বাহাদুর শিখ ধর্মের নবম গুরু। তিনি ১৬২১ সালে ভারতের অমৃতসরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি গুরু `গ্রন্থসাহেব’ রচনার জন্য বিখ্যাত। আর আওরঙ্গজেবকে তো সবাই চেনেন। তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশের ৬ষ্ঠ মুঘল সম্রাট বাদশাহ আলমগীর। মোঘলদের সাথে শিখদের কিন্তু শুরু থেকে একটা ভালো সম্পর্কই ছিল। সম্রাট বাবরের সাথে গুরু নানকের সাক্ষাতের পরে, বাবর অমৃতসরে মন্দির বানাবার জন্য তাকে ্জায়গা দান করেন। এছাড়াও সম্রাট আকবরের সাথেও শিখ গুরু অমর দাসের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কিন্তু পরবর্তীতে তেগ বাহাদুর মুঘল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও লড়াই করেন। পাঞ্জাব এলাকায় তার বিপুল সংখ্যক অনুসারী তৈরি হয়। তিনি জবরদস্তি ও চাঁদাবাজির পথ অবলম্বন করে হিন্দু – মুসলমান উভয়ের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতেন। এই ঘটনাগুলো মোঘল শাসনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দমন করতে অভিযান পাঠান এবং তিনি মোঘল সেনার হাতে ধরা পড়েন। ১৬৭৫ সালে তাকে আওরঙ্গজেবের আদেশে দিল্লিতে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। দিল্লীতে তার সমাধিটি রয়েছে।
এতো গেলো দিল্লীর কথা। বাংলাদেশের ঢাকার সাথেও তার স্মৃতির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকার গুরুদুয়ারায় একটি কাচের বাক্সের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে তার ব্যবহার করা একজোড়া খড়ম। এই গুরুদুয়ারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত। ১৬ শতকে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক অল্প সময়ের জন্য এই স্থানে অবস্থান করেছিলেন।
 
 
তবে অনেকের মতে, ৬ষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং-এর সময়কালে আলমাস্ত এই জায়গায় এসে গুরুদুয়ারাটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। আধুনিক ভবনটি ১৮৩০ সালে তৈরি হয়। এখানে একটি কূপ, শান বাঁধানো পুকুর, ও ভক্তদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর ছিল। তাছাড়া একটি বড় ঘরের মাঝে কাঠের তৈরি বেদির ওপর শিখদের ধর্মীয় বই ‘গ্রন্থসাহেব’রক্ষিত আছে; যা পুরোহিত পাঠ করেন। এটা সকলের জন্য উন্মুক্ত।
আমরা বলতেই পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। কারণ এখানে মুসা খানের মসজিদ, গ্রীক সমাধি সৌধ, কিছু দূর হাটলেই কালী মন্দির, শিব মন্দির ও গুরুদুয়ারা সবগুলো পাশাপাশি অবস্থান করছে সেই মোঘল আমল থেকেই। বাংলার মানুষ জোড় গলায় বলতে পারে, বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সম্প্রীতির জায়গা এবং এই ভ্রাতৃত্ব সকলকেই বজায় রাখতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলামের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকার ইতিহাস’ বই ও উইকিপিডিয়া