অটোমান সাম্রাজ্য ছিল আভিজাত্য, শিল্প আর সৌন্দর্যের এক বিস্ময়কর প্রতীক। তাদের জীবনে শুধু প্রাসাদ, গহনা বা শিল্পকর্ম নয়—নিত্যদিনের ব্যবহার্য সামগ্রীতেও থাকত সূক্ষ্ম নকশা আর সৃজনশীলতার ছাপ। উনবিংশ শতকে অটোমান নারীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হাম্মাম বা গণস্নানাগার। সেখানে ব্যবহৃত হতো এক বিশেষ ধরনের কাঠের স্যান্ডেল, যার নাম নালিন।
নালিন ছিল না কোনো সাধারণ স্যান্ডেল। মুক্তোঝিনুক, রুপার ফিলিগ্রি, হাতির দাঁত কিংবা কচ্ছপের খোলসে খচিত নকশা এটিকে পরিণত করত আভিজাত্যের প্রতীকে। হাম্মামে একত্রিত হলে নারীরা শুধু স্নানই করতেন না—আড্ডা, সৌন্দর্যচর্চা ও গল্পগুজবের মধ্যেই নালিন হয়ে উঠত আলোচনার বিষয়। গয়না কিংবা পোশাকের মতোই একে অপরের নালিনের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেন তারা।

১৬ শতকের সুলতান আমির আহমদ বাথহাউস (হাম্মাম) মধ্যে কাশান, ইরান। এর একটি অংশ এখন একটি হিসাবে ব্যবহৃত হয় চাহাউস © wikipedia
প্রথমত, নালিনের ব্যবহারিক দিক ছিল ভেজা মার্বেল মেঝেতে পা ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এর উঁচু কাঠের তলা পরে হাঁটলে যেন রাজকীয় ভঙ্গিমায় ভেসে যেতেন নারীরা। আখরোট, বিচ বা আবনুস কাঠ দিয়ে তৈরি এসব স্যান্ডেলের তলায় থাকত সূক্ষ্ম জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশা, যা মোমবাতির আলোয় ঝলমল করত। ফিতাগুলো বানানো হতো সিল্ক বা ভেলভেট দিয়ে, তাতে জড়ানো থাকত সোনালি-রুপালি সূতা, রত্ন আর পুঁতি। কিছু নালিনে ঝোলানো থাকত ছোট ছোট ঘণ্টা—হাঁটার সময় যার টুংটাং শব্দ স্নানাগারের নীরবতা ভেঙে তুলত এক মায়াবী আবেশে।
নালিন শুধু স্নানাগারের সঙ্গী ছিল না, বরং সামাজিক মর্যাদারও প্রতীক। ধনী পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে পণ হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীগুলোর একটি ছিল এই নালিন। এটিকে সৌন্দর্য, পবিত্রতা আর শুভ সংসার জীবনের প্রতীক মনে করা হতো। কখনো সুলতান নিজেও বিলাসবহুল নালিন উপহার দিতেন প্রিয় নারীদের। অনেক পরিবারে এগুলো হয়ে উঠত উত্তরাধিকার, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যেত গৌরবের নিদর্শন হয়ে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে আধুনিক স্থাপনা আর সহজ-সরল জুতোর প্রচলনে নালিন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। বিশ শতকের শুরুতে তা আর ছিল না মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আজ সেগুলো কেবল ইতিহাসের অংশ হয়ে টিকে আছে—ইস্তাম্বুলের টপকাপি প্রাসাদ থেকে শুরু করে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের কাচঘেরা তাকগুলোয়।

জিন-এটিন লিওটার্ড (১৭০২-১৭৮৯): হামামে তার ক্রীতদাসের সাথে তুর্কি মহিলা। © wikipedia
আজ নালিন আর হাম্মামের অপরিহার্য সঙ্গী নয়, তবু এটি অটোমান ঐতিহ্য আর শিল্পকুশলতার উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে। মনে হয়, যদি মন দিয়ে শোনা যায়, তবে এখনও পাওয়া যাবে সেই ঠকঠক শব্দ আর ঘণ্টার টুংটাং ধ্বনি—যেন ভেসে আসছে দূর অতীতের হাম্মাম থেকে, নারীদের হাসি আর আড্ডার সঙ্গে মিশে থাকা এক অমলিন প্রতিধ্বনি হয়ে।