আপনারা কি কেউ ‘ঠগিদের’ র নাম শুনেছেন? ঠগি হলো এমন একটা দল, যারা ভারতবর্ষের এক সময় রাজত্ব করেছিল। কিসের রাজত্ব? আসুন জেনে নেই ঠগিদের সম্বন্ধে ছোট্ট ইতিহাস।
ইংরেজিতে ‘থাগ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ঠগি’ থেকে। ১০ শতকে প্রথম দার্শনিক ‘ভাসারভাজান’ এর লেখা থেকে ঠগিদের সম্বন্ধে জানা যায়। এছাড়া মাদ্রাজ গেজেটও ঠগি সম্পর্কে ব্রিটিশদের বিবরণ পাওয়া যায়। ঠগিরা ছিল ভারতবর্ষের এক বিশেষ খুনির দল যারা পথিকের গলায় রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতো। ১০ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বাংলাসহ উত্তর ভারতের নানা জায়গায় তারা সাধারণ মানুষের মনে আতংক ছড়িয়ে রেখেছিলো। তারা এতো মানুষ হত্যা করেছে যে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
কথিত আছে, বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানীর লেখা ‘ফিরোজ শাহের ইতিহাস’ বইটি থেকে ঠগিদের সম্বন্ধে জানা যায়। ১২৯০ সালে সুলতানি আমলে হাজার খানেকের মতো ঠগি ধরা পরে। কিন্তু সুলতান তাদেরকে কোনো শাস্তি না দিয়ে নৌকায় করে ভাটির দেশ মানে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। আর শর্ত দেন দিল্লিতে কোনোদিন ফিরে আসা যাবে না।এর পর থেকেই বাংলার সব জায়গায় এই ঠগিদের দল ছড়িয়ে পরে।
ঠগিরা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করতো এবং ভ্রমণের সময় তারা পথিকের সাথে ভাল ব্যবহার করে, বন্ধুত্ব তৈরী করে তাদের সাথে মিশে যেত এবং সুযোগ বুঝে তাদের হত্যা করতো।তারা নিজেদের মধ্যে ‘রামসী’ নামক সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতো । কেউ পালিয়ে গেলে ঠগিদের অগ্রবর্তী দল তাদেরকে হত্যা করতো । পথিকের সব সম্পদ লুট করে তারা কালী দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতো।
ঠগিরা হত্যাকান্ডের জন্য হলুদ রঙের একটি রুমাল ব্যবহার করতো, যা দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে দৈর্ঘ্যে মাত্র ৩০ ইঞ্চি হতো । রুমালের ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট থাকতো, তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বেঁধে বিশেষ কায়দায় হত্যা করা হতো । হত্যা করার সময় একজন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি নিয়োজিত হতো, এদের একজন মাথা ঠেসে ধরতো, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যক্তির গলায় পেচিয়ে ধরতো এবং অরেকজন পা চেপে ধরে থাকতো । ঠগিরা তাদের দেবীর উদ্দেশ্যে রক্তপাত করতে চাইতো না বলে এই পদ্ধতিতে হত্যা করতো।
কেন এতো বছর ধরে ঠগিরা সকলের নাগালের বাইরে ছিল? কারণ, হত্যা করার পর সেই লাশ তারা ফেলে রাখতো না। শরীরের অভ্যন্তরীন অংশ দ্রুত পচে যায় বলে, তারা শরীর থেকে সেইসব অংশ আলাদা করে ফেলতো, তারপর মাটি চাপা দিতো। এতে করে লাশ থেকে কোনো দুর্গন্ধ ছড়াতো না।
সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসতো ঠগিদের অমৃতের ভোজ । ভোজ এমন আহামরি কিছু নয়, ছিল গুড়ের ভোজ । একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতো । তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগি হয়ে যাবে । ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিলো।তাদের এই হত্যা প্রক্রিয়া বংশ পরম্পরায় চলতো। সাধারণত ১৮ বছর পূর্ণ হলেই একজন ঠগি বালক হত্যার অনুমতি পেতো। কিন্তু ঠগীরা শিল্পী, ভিক্ষুক, কুষ্ঠরোগী, বিকলাঙ্গ ও নারীদের হত্যা করতো না।
শুরুতে পথিকেরা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াকে ব্রিটিশ সরকার তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু যখন ব্রিটিশরাও নিখোঁজ হতে থাকে তখন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক, উইলিয়াম হেনরি শ্লিম্যানকে ১৮৩০ সালে ঠগি নির্মূল করার নির্দেশ দেন।
উইলিয়াম হেনরি শ্লিম্যান ছিলেন বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি দেখলেন যে, অন্যান্য অপরাধীদের মতো ঠগিদের আলাদা করা যাচ্ছে না, তখন তিনি বিশেষ পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে ঠগিদের অপরাধস্থলের আশেপাশে নজর রাখতে লাগলো। গুপ্তচরদের দক্ষতায় দলে দলে ঠগি ধরা পড়তে থাকে। ১৮৩০ – ১৮৩১ সালের মধ্যে শ্লিম্যান প্রায় ৩৭০০ ঠগি ধরতে সক্ষম হন।
ধরা পড়ার পর একজন ঠগি তার জবানবন্দিতে ৯৩১ টি হত্যার কথা স্বীকার করে এবং আরও শ’দেড়েক হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা জানায়। সে ছিল ঠগিদের রাজা, ঠগি বেহারাম। ঠগিদের মধ্যে সর্বশেষ ও সবথেকে ভয়ঙ্কর খুনি। ১৮৪০ সালে ঠগি বেহারামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
কিন্তু ইতিহাসবিদ কিম ওয়াগনার যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ঠগের কাজটি আসলে বর্ণ ভিত্তিক নয়, বরং জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যম ছিল। তাদের এই পেশাটা ছিল ঋতুভিত্তিক। শরৎকালের দিকে তারা গ্রাম থেকে চলে যেতো আবার বর্ষাকালের দিকে ফিরে আসতো । এই সময়ে তাদের যে লুট করা সম্পদ, তার প্রায় পুরোটাই চলে যায় জমিদার বা মহাজনদের কাছে ঋণ শোধ করতে ।
বিঃ দ্রঃ তাদের সাংকেতিক ভাষাগুলো আমরাও কিন্তু শিখে নিতে পারি। যেমন – ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক অনুচরকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিতো । ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো । এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায় ।