আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক হুমকি ঠেকিয়ে দেয়ার এক প্রধান অস্ত্রে পরিণত হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তি বা গোয়েন্দাগিরি। পৃথিবীতে শাসনব্যবস্থার সূচনালগ্ন থেকেই গুপ্তচরবৃত্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও আধুনিক যুগে এসে এই ব্যবস্থা হয়ে উঠছে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি নিরাপত্তা এবং ভিনদেশী ষড়যন্ত্র ঠেকিয়ে দেয়ার এক ট্রাম্পকার্ড হিসেবে। হালের মোসাদ, সিআইএ, র’ ইত্যাদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের ক্ষেত্রে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে প্রায় অগোচরে। তবে আজ আমরা আলোচনা করব মুঘল আমলের গুপ্তচরপ্রথা নিয়ে যারা কিনা এই উপমহাদেশে গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
মুঘলদের অব্যবহিত পূর্বে দিল্লির সুলতানগণ গুপ্তচর বিভাগকে ব্যবহার করেছেন সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এই বিভাগকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খলজী। তার প্রতিষ্ঠিত দুটি নতুন পদ ভারতের ইতিহাসের গুপ্তচরবৃত্তিকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মুনিশ (গুপ্তচর) এবং হালালখোর (গৃহভৃত্য) এই দুটি পদের মাধ্যমে গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করে তুলেন। এরা ছিল খুব অনুগত এবং একই সাথে ধূর্ত। ফলে দেখা গেছে তথ্যবিভাগে রাতারাতি আমূল পরিবর্তন ধরা পড়ে। যেসব বিদ্রোহী আমিরগণ তলে তলে অসন্তোষ ছড়াতেন তারাও সোজা হয়ে যান। সে আমলে এসব গোয়েন্দা দিয়ে সাম্রাজ্যের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করা হত। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সংকেত লিপির মাধ্যমে দিল্লি-দৌলতাবাদ-দিল্লি তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করেন। এসব তথ্য খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর সুলতানের কাছে পৌঁছাতো। সুলতানদের অনুসৃত পথে মুঘলদের আমলে গোয়েন্দা বিভাগকে কার্যকর করে তুলা হয়। সম্রাট আকবর এই বিভাগের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পুনঃবিন্যস্ত করেন। সম্রাট আকবর ১৫৯৪ সালে পুরো মুঘল সাম্রাজ্যকে ১২ টি প্রদেশে ভাগ করেন। তিনি কেন্দ্রের অনুকরণে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে ওয়াকিনবিশ নামের গোয়েন্দা নিয়োগ দেন। এই প্রথা মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ নাগাদ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল৷ ওয়াকিনবিশ সরকারের রাজকীয় দফতের লেখক হিসেবে কাজ করতেন। সম্রাট আকবরের ১৪ জন বিশেষ ওয়াকিনবিশ ছিল। ওয়াকিনবিশ ছোট ছোট পরগণা থেকে তার নিযুক্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করতেন। প্রদেশের বিভিন্ন কর্মকর্তা তাদের দৈনন্দিন সংঘটিত কাজকর্মের বর্ণনা এসে ওয়াকিনবিশকে সরবরাহ করতেন। তার একটি নোট প্রস্তুত করতেন ওয়াকিনবিশ। সেই নোটের উপর আলোচনা করে তারপর সম্পাদিত একটি অংশ সম্রাট বরাবর পাঠিয়ে দেয়া হতো। সম্রাট ওয়াকিনবিশদের প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তিনি সরকারি কোন তথ্য কারো কাছে প্রকাশ করতে বাধ্য ছিলেন না। এমনকি প্রদেশের সুবাদারও তার কাছে কোন তথ্য চাইতে পারতেন না। একমাত্র সম্রাটের কাছেই ওয়াকিনবিশদের জবাবদিহি করতে হতো। ওয়াকিনবিশ সামরিক কাজেও গোয়েন্দাগিরি করতেন। ফলে এই পদটি ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তার হয় কাবুল থেকে চট্টগ্রাম এবং কান্দাহার থেকে গোলকুন্ডা পর্যন্ত । এ সময় সাম্রাজ্য ২০ টি প্রদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রশাসনিক কাজ নির্বাহের জন্য গড়ে উঠে বেশকিছু নতুন বিভাগ। প্রশাসনিক বিভাগ বাড়ার সাথে সাথে স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তার প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। ফলে গোয়েন্দাদের আবার ঢেলে সাজানো হয়। উপমহাদেশের সাম্রাজ্যে আসীন হলেও ভারতে মুঘলরা ছিল ক্ষুদ্র একটা সম্প্রদায়। আর যে ভারতীয় উপমহাদেশ তারা শাসন করছিল সেখানে সংখ্যাগুরু জনসংখ্যা ছিল অমুসলিম । ফলে এই দিক থেকে মুঘল শাসকগণ ছিলেন বেশ সজাগ। যেকোন সময় যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে হারাতে হবে মসনদ তারা সেটা টের পেতেন। ফলে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে মুঘলরা কার্পণ্য দেখাত না। পাশাপাশি বৈদেশিক হামলা ও হুমকির ব্যাপারেও তাদেরকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হত। সম্রাট আওরঙ্গজেব লিখিত এক পত্র থেকে যা আঁচ করা যায়, “এক মুহূর্তের অবহেলা অনেক বছরের জন্য বেদনা বয়ে আনতে পারে”।
মুঘলদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মীর বকশির অধীনে সামরিক বিভাগের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। এই তথ্য সংগ্রহে চার ধরণের লোকের উপস্থিতি ছিল। ওয়াকেয়ানবিস (বার্তা প্রেরক), সোয়ানিনিগার, খুফিয়া নিগার(গোপন পত্র প্রেরক) ও হরকরা (গোয়েন্দা) নামের এরা মৌখিক ও লিখিতভাবে সাম্রাজ্যের উচ্চপর্যায়ে নিজেদের তথ্য প্রেরণ করত। অনেক সময় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও গোয়েন্দার কাজ করতেন। গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে লেখক-রিপোর্টার নিয়োগ দেয়া হত এবং এরা প্রাদেশিক সদর দফতরে ওয়াকিনবিশের কাছে তথ্য প্রেরণ করত। ওয়াকিয়ানবিশ আবার মীর বকশির কাছে এসব তথ্য পাঠিয়ে দিতেন। মীর বকশি তথ্যের গুরুত্ব অনুযায়ী কখনো বার্তা প্রেরককে নিয়ে সম্রাটের কাছে হাজির হতেন আর কখনো সংবাদ যাচাই-বাছাই করে সম্রাট বরাবর পৌছে দিতেন। মুঘল আমলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তচর ছিল হরকরা। এরাই ছিল প্রকৃত গোয়েন্দা। এদেরকে খুফিয়ানবিসও বলা হতো। মৌখিকভাবে সংবাদ সংগ্রহ করা এই গুপ্তচরের দল সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করত এবং গোপন লিখিত পত্রও বহন করত। এদের দেয়া তথ্য খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হত এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হত। ১৬৯৩ সালে একবার ডাচ বণিকগোষ্ঠী সুরাট থেকে শস্য আমদানি করতে চাইলে মুতাসাদি সেই আবেদন প্রত্যাখান করে জানান, শস্য রফতানি না করতে তার কাছে গোপন নির্দেশ আছে এবং তিনি যদি সেই নির্দেশ লংঘন করেন তবে হরকরার গোপন রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলবে। ঐতিহাসিক আশ্বিন দাশ গুপ্ত ১৬৯৯ সালের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেন যেখানে দেখা যায়, এক হরকরা এক সুবাদারের সাথে প্রকাশ্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে সম্রাটের কাছে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার হুমকি দিচ্ছে। ঐতিহাসিক মির্জা মোহাম্মদ কাজিম আওরঙ্গজেবের আমলের গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কে নতুন তথ্য দিয়েছেন। সে সময় হরকরার সমান্তরালে গড়ে উঠেছিল সওয়ানিহ নিগার নামের আরো এক নতুন পদ যারা মূলত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং অসৎ কাজের দেখভাল করত। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব গোয়েন্দাদের ব্যবহার করতে জানতেন। একজন তীক্ষ্ণ শাসক হিসেবে তিনি সবদিকে নজরদারি চালাতেন। ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তার গোয়েন্দাদের ব্যবহার।১৭০৮-১৭০৯ সালের দিকে রাজকীয় কাজে প্রায় ৪০০ গোয়েন্দা নিয়োজিত ছিল। ভিনদেশে নিয়োজিত গোয়েন্দা আকবারনিস অনেক সময় ঠিকঠাকমতো গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারতেন না। তাই এর বিকল্প হিসেবে বণিকদের দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ চালিয়ে নেয়া হতো। ইরান, তুরস্ক, আরবে থাকা মুঘল ব্যবসায়ী ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা সাম্রাজ্যের বিদেশনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করত।
মুঘলদের নিরবচ্ছিন্ন শাসন চালানোর পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এসব গুপ্তচররা। সম্ভাব্য সব বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আগে থেকেই জানা যেত, ফলে কেউ আর বিদ্রোহ করার সাহস পেত না৷ পাশাপাশি বৈদেশিক হুমকি মোকাবেলায় এই গোয়েন্দারা হয়ে উঠেছিল মুঘলদের আস্থার অন্য নাম।