![কালাপাহাড়](https://bangla.staycurioussis.com/wp-content/uploads/2021/07/কালাপাহাড়.jpg)
কালাপাহাড়ের হাতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য হিন্দু দেবালয়, বাংলা ও ওড়িশার বহু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেছিলেন তিনি। কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ, বিষ্ণু পূজারী। কীভাবে একজন ধর্মভক্ত মানুষ নিজ ধর্মের প্রতি হয়ে উঠলেন এতোটা প্রতিশোধ পরায়ন?
আসেন আমরা সেই ইতিহাস জেনে আসি।
কালাপাহাড়ের আসল নাম রাজীবলোচন রায়, ডাকনাম ছিলে রাজু। জন্ম হয় রাজশাহীর নওগাঁতে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি ছিলেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, বাবা নয়ানচাঁদ রায় গৌড় রাজার ফৌজদার ছিলেন।তিনি নিয়মিত বিষ্ণু পূজা করতেন, আর তখন থেকেই তাকে কালাপাহাড় নামে ডাকা হতো।নামের সাথে চেহারা ও শরীরের বেশ মিল ছিলো।
কালাপাহাড় ছিলেন একজন বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান মানুষ।
১৫৬৪-১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষমতায় ছিলেন কররানী সুলতানি বংশ। সে সময় ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাজিত হন সুলেইমান কররানী। হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ রাজীবলোচনকে দেখে তিনি আকৃষ্ট হন এবং তাকে গৌড়ের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেন। কালাপাহাড় সেখানে দক্ষতার সাথে তার পারদর্শীতা প্রমান করেন।
একদিন কররানী তাকে নিজের প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে কররানীর মেয়ে ‘ দুলারি বিবি’ কে দেখে তিনি প্রেমে পড়েন । এরপর কালাপাহাড় কররানীর মেয়ে ‘দুলারি বিবি’কে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে কররানী তাকে প্রধান সেনাপতির পদে নিয়োগ করেন। এই বিয়ের ফলে কালাপাহাড়ের পরিবারকে হিন্দুরা একঘরে করে রাখে। তখনও তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন নি। আগেই বলেছি কালাপাহাড় ছিলেন ‘বিষ্ণু’ পূজারী। বিয়ের পর মায়ের কথায় তিনি বাংলার হিন্দু ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের জন্য গেলে, তারা তাকে কোন বিধান দিতে রাজি হলেন না।
তারপর যখন পুরীর জগন্নাথ দেব মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন পুরোহিতরা তাকে মন্দিরেও ঢুকতে দিলোনা। এতে করে কালাপাহাড় ভিষন মর্মাহত হন এবং ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আর সেই কারণেই প্রতিশোধস্পৃহায় তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ নাম নেন, এবং হয়ে উঠেন হিন্দু বিদ্বেষী। আর তখন থেকেই তিনি কালাপাহাড় নামে প্রসিদ্ধ হন। ক্ষোভে অন্ধ মানুষটার তখন একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু ধর্ম, হিন্দু ধর্মের দেবালয় ও বিগ্রহের ক্ষতিসাধন করা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই কাজই করে গেছেন। ১৫৬৮ সালে তিনি পুরীর শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করেন, এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন।
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহ’র সঙ্গে সন্ধি করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে সপ্তগ্রাম বন্দর দখলে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় সুলায়মান খান কররানী উড়িষ্যা আক্রমণ করলে মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় নেন। সুলায়মান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জে অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান। এইসময় মুকুন্দদেব তারই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন।সে সময় সেই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করলে তারা দুজনই কালাপাহাড়ের কাছে পরাজিত ও নিহত হন।
উড়িষ্যা অভিযানকালে তিনি উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান। ১৫৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালাপাহাড় উড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুঠ করেন। কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলী নদীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।
উড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। তার আক্রমণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোণার্কের সূর্যমন্দির।বলা হয়ে থাকে মন্দিরের শীর্ষে ছিল ভারী চুম্বক এবং মাটিতেও ছিল চুম্বক। প্রতিটা পাথরের দুপাশে ছিলো লোহার পাত। এই ব্যবস্থার কারনে মন্দিরের মূল বিগ্রহ ভাসমান অবস্থায় থাকতো।যদিও কে এই চুম্বক-লুঠ করেছে, তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে কোন কোন ও ঐতিহাসিক মনে করেন‚ কালাপাহাড় এগুলি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান।
কালাপাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘণ্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করতেন। সেই তীব্র অনুরণনে প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে তিনি প্রতিমা উপড়ে ফেলে দিতেন।
তিনি মন্দির ধ্বংস করার পরে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাট করতেন। মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালাপাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। এইসময় একজন নারী গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের ছাউনিতে আসেন, তিনি সৈন্যদের মাঝে বিষ মিশানো দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করেন। পরদিন সকালে বেশির ভাগ সৈন্য খাবারের বিষক্রিয়ায় মারা গেলে তিনি বাদবাকি সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান, হিন্দুরা মনে করে দেবী সম্বলেস্বরী গোয়ালিনি ছদ্মবেশে এসে এইকাজ করেছেন।
মন্দির ধ্বংসের ঘটনা উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কররাণীদের কোচবিহার আক্রমণের সময় কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। এই সময় তাকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে কুচবিহারের রাজার ছেলে শুক্লধ্বজ,তবে তিনি পরাজিত ও মৃত্যুবরন করেন কালাপাহাড়ের হাতে।
কালাপাহাড় তাম্রলীপ্তের বর্গভীমা মন্দির ধ্বংস করতে এসে মন্দির ও দেব বিগ্রহের সৌন্দর্য দেখে তিনি কেন জানি ধ্বংস করতে পারেন নি, উল্টে মন্দিরের প্রশস্তি করেছিলেন। তিনি কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান (কথিত আছে তার নামেই চালের নামকরণ হয় দাদখানি চাল) কররাণীর আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।
![](https://bn.mtnews24.com/uploads/1517245628.jpg)
কালাপাহাড়, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত
১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পর তাকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি কালাপাহাড়ের সহযোদ্ধাদের, একদল উগ্রবাদী হিন্দুদের আক্রোশে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
তথ্যসূত্র —- উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট