১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন তখন তিনি কোন বিরান ভূমি আবিষ্কার করেননি। নতুন এই মহাদেশে বহু বছর ধরেই সমৃদ্ধ স্থায়ী বসতের উপস্থিতি ছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাসই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার এই আবিষ্কার ছিল আমেরিকা আবিষ্কার অভিযানের শেষ যাত্রা। তার আগে আরও ৬ বার পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা এই মহাদেশ আবিষ্কার করেছিল। স্থল ও সমুদ্রপথে এই আবিষ্কার অভিযানগুলো সংঘটিত হয়েছিল। এই মহাদেশে আগমন ঘটেছিল নতুন জাতিসত্তার মানুষ, নতুন ভাষা, নতুন প্রযুক্তি। কেউ এখানে স্থায়ীভাবে থেকে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। কেউবা খানিক সময় পরে চলেও গেছে, পেছনে ফেলে গেছে তার আগমনের অকাট্য প্রমাণ। আমেরিকা আবিষ্কারের শেষ যাত্রা থেকে প্রথম যাত্রার ইতিহাসই আজকের নিবেদন।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযান (১৪৯২)
১৪৯২ সালে ইউরোপীয়রা সিল্ক রুট ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে এশিয়া মহাদেশে পৌঁছাতে পারতো। ইউরোপ থেকে পশ্চিমে যাওয়া তখনকার সময় অসম্ভব বলে মনে করা হতো। প্রাচীন গ্রিকরা নিখুঁতভাবে গণনা করে পৃথিবীর পরিধি বের করতে পেরেছিল। তাদের হিসেব অনুসারে পৃথিবীর পরিধি ছিল ৪০ হাজার কিলোমিটার। এতে এশিয়ার সাথে পশ্চিমের দূরত্ব যে অনেক বেশি তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু কলম্বাস পৃথিবীর পরিধি নির্ণয়ে ভুল করেন। তার ভুল হিসেবে তিনি পৃথিবীর পরিধি বের করেন ৩০ হাজার কিলোমিটার। এই ভুল হিসেব অনুসারে ইউরোপ থেকে জাপানের দূরত্ব দাঁড়ায় মাত্র ৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ থেকে জাপানের দূরত্ব ছিল ২০ হাজার কিলোমিটার। ফলে কলম্বাসের জাহাজ যথেষ্ট রসদ ছাড়াই প্রাচ্যের দিকে অভিযান শুরু করে। ভাগ্যক্রমে বা ভুলবশতই তিনি আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেন। নতুন এই অঞ্চলকে তিনি ইন্ডিয়ার পূর্ব উপকূল ভেবে এখানকার অধিবাসীদের নাম দেন ইন্ডোইওস বা ইন্ডিয়ান। তিনি তার এই ভুল বুঝতে পারার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিগো ভেসপুচি নামের এক নাবিক ১৫০৭ সালে বুঝতে পারেন যে এটি একটি নতুন ভূখণ্ড। আর এই নাবিকের সম্মানেই এই মহাদেশের নাম হয়ে যায় আমেরিকা।
পলিনেশিয়ান অভিযান (১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
২ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পলিনেশিয়ানরা (প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ) তাইওয়ান থেকে নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের জন্য অভিযান শুরু করে। তারা ফিলিপাইন হয়ে দক্ষিণে, মেলানেশিয়া হয়ে পূর্বে যাত্রা শুরু করে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করে। পলিনেশিয়ানরা ছিল নাবিক হিসেবে দক্ষ। তারা সমুদ্রের ঢেউ ও তারার গতিবিধি বুঝে মুক্ত সমুদ্রে মাইলের পর মাইল বিচরণ করতে পারতো। বড় ডিঙ্গি নৌকা ব্যবহার করে পলিনেশিয়ানরা পৌঁছে যায় সামোয়া, ফিজি, টোঙ্গা ও কুক দ্বীপপুঞ্জে। এর মধ্যে একটি অংশ দক্ষিণ হয়ে চলে যায় নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত। বাকিরা পূর্বে তাহিতি, ইস্টার দ্বীপ, হাওয়াইতে ঘাটি গাড়ে। সেখান থেকে তারা দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত চলে যায়। তারপর প্রশান্ত মহাসাগরের অধিকাংশ ভূখণ্ড আবিষ্কার করে এবং হঠাৎ করে তাদের অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয় এবং দক্ষিণ আমেরিকাকে বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু এই ঐতিহাসিক যাত্রার প্রমাণ রয়ে যায়। দক্ষিণ আমেরিকানরা পলিনেশিয়ানদের কাছ থেকে মুরগির মাংসের সাথে পরিচিত হয়, পলিনেশিয়ানরা পরিচিত হয় দক্ষিণ আমেরিকার মিষ্টি আলুর সাথে। পূর্বাঞ্চলের পলিনেশিয়ানরা নেটিভ আমেরিকানদের বিয়েও করেছিল।
নরসম্যানদের অভিযাত্রা ( ১০২১ সাল)
ভাইকিং বা নরসম্যান লোককথায় আছে, ৯৮০ সালের দিকে এরিক দ্য রেড নামের এক ভাইকিং ও ধূর্ত বিক্রেতা বরফ আবৃত একটি বিরান ভূমিকে গ্রীনল্যান্ড নাম দিয়ে সাধারণ মানুষকে সেখানে বসত গড়ে তুলতে প্রলুব্ধ করে। ৯৮৬ সালে গ্রীনল্যান্ডের একটি নৌকা কানাডার উপকূলে আবিষ্কার হয়। ১০২১ সালের দিকে এরিকের পুত্র লেইফ নিউফাউন্ডল্যান্ডে একটি নতুন বসতির পত্তন করে। বৈরি আবহাওয়া ও নেটিভ আমেরিকানদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভাইকিংরা গ্রীনল্যান্ডে ফিরে আসে। এতোদিন এই ঘটনা কিংবদন্তি হয়েই টিকে ছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা খননের মাধ্যমে নিউফাউন্ডল্যান্ডে ভাইকিং বসতির প্রমাণ পান।
ইনুইটদের অভিযান ( ৯০০ সাল)
আর্কটিক ও সাব আর্টিক অঞ্চলের বাসিন্দা ইনুইট বা এস্কিমোরা ভাইকিংদেরও আগে ছোট্ট নৌকায় করে সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কায় ভ্রমণ করেছিল। ইগলু ও ঘাসের তৈরি ছোট্ট কুটিরে থেকে তিমি ও সীল মাছ শিকার করতো তারা। আর্কটিক মহাসাগরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলেছিল ইনুইটরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের ডিনএ নেটিভ আলাস্কানদের প্রায় কাছাকাছি। যা এটা নির্দেশ করছে সম্ভবত ইনুইটদের পূর্বপুরুষ আলাস্কা থেকে এশিয়ায় গিয়ে উপনিবেশ কায়েম করেছিল এবং ফের আমেরিকা আবিষ্কার করতে আলাস্কায় আসে।
এস্কিমো এলিউটদের আবিষ্কার ( ২০০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
এস্কিমোদের তৃতীয় প্রজাতি হচ্ছে এলিউড এস্কিমো। কানাডা, গ্রীনল্যান্ড অরিজিনের ইনুইট, সাইবেরিয়ার ইউপিক এস্কিমো ও এলিউট এস্কিমো একটি সাধারণ এস্কিমো ভাষা পরিবারের সদস্য ছিল। এই ভাষা নেটিভ আমেরিকান অন্যান্য ভাষা থেকে স্বতন্ত্র ছিল এবং সম্ভবত ফিনিশ ও হাংগেরিয়ান ভাষার সাথে এর সাযুজ্য থাকতে পারে। ডিএনএ প্রমাণ সাক্ষ্য দিচ্ছে এস্কিমো এলিউটরা একটি স্বতন্ত্র মাইগ্রেশনের মাধ্যমে উদ্ভুত। বেরিং সাগর হয়ে আধুনিক রাশিয়া হয়ে তারা আলাস্কা এসেছিল ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগে। এদের একটি অংশ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং আরেকটি অংশ পূর্ববর্তী অভিবাসী ‘না ডেনে’ সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যায়। ফলে আমেরিকার সাথে তাদের পরিচয় ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত বলে মনে হয়।
না ডেনে ( ৩০০০-৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
না ডেনে নামের এই সম্প্রদায়ের আমেরিকায় আগমন ঘটেছিল ৫ হাজার বছর আগে। অনেকে মনে করেন ৫ হাজার নয়, ১০ হাজার বছর আগে বেরিং সাগর হয়ে আলাস্কায় প্রবেশ করেছিল তারা। ডিএনএ গবেষণার সূত্র বলছে, এরা এস্কিমো এলিউট উদ্ভূত নয় বরং ন্যাটিভ আমেরিকান না ডেনে ভাষা যেমন, নাভাজো, ডেনে ও এপাশে পরিবারের সদস্য।
ফার্স্ট আমেরিকান (১৬০০০-৩৫০০০ আগে)
অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকান উপজাতিগুলো একই ভাষায় কথা বলে। ফলে মনে করা হয়, তাদের ভাষাগুলো আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের কোন এক পূর্বপুরুষ উপজাতির ব্যবহৃত ভাষা থেকে যারা আমেরিকায় অনেক আগে প্রবেশ করেছিল। তাদের উত্তরপুরুষের নিম্নমানের জৈবিক বৈচিত্র্য দেখে বুঝা যায় এই উপজাতিটি সদস্যসংখ্যায় খুব বেশি ছিল না, নিদেনপক্ষে ৮০ জন বা তার কম।
কিন্ত তারা আমেরিকা পর্যন্ত এসেছিল কিভাবে? ১১,৭০০ বছর আগে শেষ বরফ যুগের সমাপ্তির আগে বিপুল পরিমাণ পানি হিমবাহে সঞ্চিত হয়েছিল। এর প্রভাবে বেরিং সাগরের তলদেশ প্রায় শুষ্ক হয়ে যায়, তৈরি হয় বেরিং ল্যান্ড সেতু৷ প্রথম আমেরিকানরা এই পথ দিয়েই রাশিয়া থেকে আলাস্কায় আসে। তবে তারা ঠিক কোন সময়ে এসেছিল তা সঠিক জানা যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিকরা একসময় মনে করতেন ১৩ হাজার বছর আগের উত্তর আমেরিকার ক্লোভিসরা আমেরিকার প্রথম অভিবাসী। কিন্তু বর্তমানে তারও আগের অভিবাসীদের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমেরিকার পূর্ব উপকূল, টেক্সাস, ওয়াশিংটন জুড়ে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করেছে ক্লোভিস জাতির আগেও এখানে মানুষ এসেছিল।
আবিষ্কারের সমাপ্তি
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সেই অভিযানই ছিল আমেরিকার শেষ অভিবাসন। ইতিহাসের বিভিন্ন জাতিসত্তার আগমন শেষে সাদা চামড়ার আধুনিক মানুষের দল শেষ পর্যন্ত আমেরিকায় আগমন করে ইউরোপীয় সংস্কৃতির আদলে গড়ে তুলে নতুন এক সভ্যতা। এই সভ্যতা নির্মাণের পেছনে করুণ ট্র্যাজেডিও সামনে চলে আসে। ন্যাটিভ আমেরিকানদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে পত্তন ঘটানো হয় গ্রেট আমেরিকান মহাদেশ।