মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জগতে আগমন চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত হওয়া পুরোটাই ছিল এক আকস্মিক ঘটনা। তাঁর নিজের ভাষায় ‘ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’, পরে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের উপলব্ধি ‘চলচ্চিত্র ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ’ বইতে অকপট স্বীকারোক্তি করেছেন, “আমি একজন সিনেমার কারবারি, আমার ডাইনে-বাঁয়ে, ওপর-নীচে, আশপাশে সর্বত্র সিনেমা। সিনেমায় জড়িয়ে আছি আষ্টেপৃষ্ঠে।” চলচ্চিত্র নামক ফেনোমেনন আর্টফর্মের প্রতি এক তীব্র আসক্তি, অসম্ভব ভালোবাসা তাঁকে বাংলা তথা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের এক মহীরুহতে পরিণত করে। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের তিন প্রবাদপ্রতিম ‘সত্যজিৎ – ঋত্বিক – মৃণাল’ প্রায় সমসাময়িক কিন্তু সেলুলয়েডে তিনজনেই যে ছবি আঁকতেন তা ছিল অনন্য, নিজগুণে অতুলনীয়। ধ্রুপদী সাহিত্য নির্ভর লিনিয়ার আঁটোসাঁটো ছবি আঁকতেন সত্যজিৎ, সিনেমা আর বিপ্লবকে হাত ধরাধরি করে নিয়ে চলতেন ঋত্বিক আর সমকালীনতাকে ধারণ করেছিলেন মৃণাল। সত্যজিৎ ছিলেন শান্ত, পরিপাটি, সহিষ্ণু, উদ্যমী, ঋত্বিক ছিলেন দামাল, বেপরোয়া, অসহিষ্ণু, বিশৃঙ্খল আর মৃণাল ছিলেন সাহসী, ক্ষুব্ধ, স্পষ্ট, প্রথাবিরোধী।
পরাধীন ভারতের ফরিদপুরে (অধুনা বাংলাদেশে) জন্মেছিলেন মৃণাল সেন। দেখেছেন ঔপনিবেশিকতা, তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয় পারিবারিক আবহাওয়ায়। স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য মফস্বল শহর ফরিদপুর থেকে কলকাতা চলে আসেন ১৯৪০ সাল নাগাদ। কলকাতা ছিল তাঁর স্বপ্নের শহর তাঁর ‘এল ডোরাডো’। ব্যস্ত কলকাতা, অস্থির কলকাতা তাঁকে চিনিয়েছিল সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেখিয়েছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্য-শোষণ, উদ্বাস্তু মানুষের ঢল, মধ্যবিত্তের রোজনামচা, উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রতিবাদ আন্দোলনে।
স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক ও রাজাবাজার কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেন। ছাত্রাবস্থায় যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্যের সাথে। ভারতীয় গণনাট্যে যুক্ত থাকাকালীন পরিচয় হয় ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, হৃষিকেশ মুখার্জির মতো গুণী মানুষদের সাথে। স্নাতকোত্তর পাঠের পর মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে চাকরী জীবন শুরু করেন। চাকরী সূত্রে কলকাতার অলিগলি চষে ফেললেন, শহরটাকে আবারও নতুন করে চিনলেন, বলা যায় নতুন করে প্রেমে পড়লেন এই শহরের। একদিন দৈবাৎ ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে হাতে এল রুডলফ আর্নহেইমের ‘ফিল্ম’ নামক বইটি। চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতার ওপর লিখিত বইটি পড়ে এক অদ্ভুত আসক্তি আর ভালোবাসা তৈরী হল এই শিল্প মাধ্যমটির প্রতি। কলকাতায় আসার আগে মাত্র তিনটি ছবি দেখেছিলেন, তার মধ্যে একটি চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’। ১৯৫২ সালে কলকাতায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেশ বিদেশের নানা ছবি দেখে নতুন এক মননের জন্ম নিল। তার পরিণতি নিজের আত্মজীবনীতে বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত সিনেমার জগতেই চলে এলাম।”
ইতিমধ্যে সারা পশ্চিমবঙ্গ গণ আন্দোলনের জোয়ারে তখন ফুঁসছে। গণ-আন্দোলনকে থামাতে মরিয়া সরকার। পুলিশের গুলি চলে কাকদ্বীপে, মারা যায় এক কৃষক মহিলা অহল্যা। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী ঠিক করলেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কাকদ্বীপে যাবেন সিনেমা তৈরী করবেন এই ঘটনার উপর। ‘জমির লড়াই’ নাম দিয়ে একটি চিত্রনাট্য লিখলেন মৃণাল সেন। ঠিক হল পরিচালনা করবেন ঋত্বিক ঘটক, সঙ্গীত দেবেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন তুলবেন ছবি। যদিও এঁরা কেউই তখনও প্রত্যক্ষভাবে সিনেমার সাথে যুক্ত নন। মৃণাল জানতেন না কীভাবে চিত্রনাট্য লিখতে হয়, কীভাবে তাতে পরিবর্তন করতে হয়। ঋত্বিক ঘটক তখনও থিয়েটারের সাথেই যুক্ত, তাপস সেন ছিলেন স্টিল ফটোগ্রাফার, একমাত্র হৃষিকেশ মুখার্জি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন সিনেমার সাথে। হৃষিকেশ মুখার্জি জোগাড় করলেন ক্যামেরা। ঠিক হল এই ছবি তৈরি করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেখাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাকদ্বীপে যাওয়া হয়নি। তবে ছবি তৈরির অদম্য এক বাসনা প্রোথিত হয় মৃণাল সেনের মনে। অবশেষে বিরক্তিকর চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে অরোরা স্টুডিওতে সাউণ্ড টেকনিশিয়ানের কাজে যুক্ত হলেন।
১৯৫৫ সালে তৈরী করলেন প্রথম সিনেমা ‘রাত ভোর’। মুখ্য ভূমিকায় উত্তম কুমার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, বক্স অফিসে ভরাডুবি হল এই সিনেমার। ঠিক একই সময়ে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’। ১৯৫৮-র ‘নীল আকাশের নীচে’, কালি ব্যানার্জীর ‘ওয়াংলু’ আর মঞ্জু দের ‘সিস্টার বাসন্তী’ দর্শকের মন জয় করল, হেমন্ত মুখার্জী ছিলেন ছবির প্রযোজক। তিন বছর পর ভারত চীন সম্পর্কের অবনতির জন্য এ ছবি ব্যান হয়, অবশ্য দুমাস পরে তা উঠে যায়। এই কারণে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার ৩ বছর পর আবার চর্চায় আসে। ছবিটি মোটামুটি চললেও মৃণাল সেনের শিল্পী মন পর্দায় যে ছবি আঁকতে চায়, সে ছবি এটা নয়। তিনি খুঁজে চলেছেন চলচ্চিত্রে তাঁর নিজস্ব ভাষা আঙ্গিক শৈলী। এই অতৃপ্তি নিয়েই পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’। ছবির নামকরণ নিয়ে শুরুতেই একটা বিতর্ক তৈরি হলেও মৃণাল সেন ছিলেন অবিচলিত। ছবির বিষয় ও নির্মাণশৈলী আগের ছবির তুলনায় অনেক আলাদা এবং অনন্য; যে আঙ্গিক, শৈলী ও ভাষার খোঁজ তিনি করছিলেন তার আভাস পাওয়া গেল এই ছবিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ঔপনিবেশিক দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে মনুষ্যত্ব। আকালের ভয়ে গ্রামের পর গ্রাম খালি করে লোকজন পালাচ্ছে। কিন্তু পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে যেতে নারাজ প্রিয়নাথ মায়ার বাঁধন ছিঁড়বে না এমনই তার শপথ, রয়ে গেল বউ মালতীকে নিয়ে। এই প্রিয়নাথই তিন দিন অভুক্ত থাকার পর সামনে গরম ভাত পেয়ে ভুলে যায় বউ মালতীও অভুক্ত। খিদের জ্বালা মালতি সহ্য করতে পারত কিন্তু স্বামীর এই রূপ সে আগে দেখেনি। খিদের কাছে স্নেহ-ভালোবাসার আত্মীয়তার চরম পরাজয় হল। লণ্ডন ফিল্ম ফেস্টিভেলে এই ছবিটি দেখানো হয়, বেশ প্রশংসিত হয়।
পরবর্তী ছবি ‘পুনশ্চ’, ‘অবশেষে’, ‘প্রতিনিধি’, ‘আকাশ কুসুম’ সমকালীন সামাজিক কাঠামোয় বেকারত্ব দারিদ্রতা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আটপৌরে জীবন, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, তার বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক দীনতার গল্প বলে। ‘আকাশ কুসুম’ ছবিতে অজয় যখন এক বহুতল বাড়ির ছাদে উঠে বন্ধুকে বলে, “শালা এই কলকাতাটাকেই কিনে ফেলব”, তখন চরিত্রটির দ্বৈতসত্ত্বার দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন আর বাস্তবের দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে। নির্মোহ কঠিন বাস্তব আর বর্ণময় রোম্যান্টিকতা- একটা থেকে পালাতে চায় আর অন্যটাকে তীব্রভাবে পেতে চায়। “ব্যক্তির দ্বন্দ্ব আসলে সমষ্টির দ্বন্দ্ব” – এই পরিসর তৈরি করে তিনি দর্শকদের তাঁর ছবির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেন। কোনো সমাধান সূত্র দেন না। লিনিয়ার হোক অথবা নন-লিনিয়ার; গল্পের গতিমুখ রাখেন মুক্ত। ফলে দর্শক কোন পূর্ব ধারণা তৈরি করার অবকাশ পান না।
অতিকথনকে বর্জন করে পরিমিত বক্তব্যের ছবির জন্য মৃণাল সেন তাঁর ছবির ভাষা আঙ্গিক এবং শৈলীতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করতেন। ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯) এমনই এক ছবি, যে ভাষা আঙ্গিক এবং শৈলীর খোঁজ এতদিন তিনি করেছেন তা পেয়েছেন এই ছবিতে। ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নিউ ওয়েভ সিনেমার পথ প্রদর্শক, অত্যন্ত কম বাজেটের চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক, ইনোভেটিভ, সাহসী ছবি। জাম্প কাট, ফ্রিজ-শট, হাতে-ধরা ক্যামেরায় জার্কি ফ্রেম আর stop-motion animation ভারতীয় চলচিত্রের ভাষাকেই পালটে দিল।
ভুবন সোম (উৎপল দত্ত) একজন বিপত্নীক বাঙালী, একাধরে সৎ, কঠোর, নিয়মনিষ্ঠ, মেজাজী রেলের বড়বাবু। তাঁর পৃথিবী তাঁর অফিসঘর আর ফাইলে ভর্তি কাজের টেবিল। তাঁর সততার কাছে ব্যক্তি সম্পর্কের কোন স্থান নেই। আপন ছেলের ক্ষেত্রেও সোমবাবু ক্ষমাহীন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ভুবন সোম মানুষটি বড় একলা। কর্মসূত্রে গুজরাতে এসে পাখি শিকারের ইচ্ছে হয়। একদিন পাখী শিকার করতে গিয়ে পরিচয় গ্রাম্য তরুণী গৌরীর (সুহাসিনী মুলে) সাথে। গৌরীর বাড়ীতে আতিথেয়তা, গৌরীর সোমবাবুকে পাখি শিকারে সঙ্গ দেওয়া, ক্রমে গৌরীর রেলে কর্মরত ঘুষখোর স্বামী সম্পর্কে জানাতে পারা, গ্রামের প্যাটেল সেজে পাখি শিকার- নিজের অভ্যস্ত একঘেঁয়ে নাগরিক জীবনের বাইরে অন্যরকম একটা দিনের অভিজ্ঞতায় অভিভূত ভুবন সোম। জীবনের অন্য এক রূপ দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি, আবিষ্কার করলেন সভ্যতার বাইরে এক অন্য ভারতবর্ষকে। সত্যজিৎ রায়, এই ছবি সম্পর্কে বলেছিলেন, “ভুবন সোম অন্য স্বাদের ছবি। সবই আছে ছবিতে: মিষ্টি মধুর এক নায়িকা, জমজমাট আবহ-সঙ্গীত, কিছু রমণীয় দৃশ্য এবং সব কিছু ছাপিয়ে ইচ্ছাপূরণের খেলা। Big Bad Bureaucrat Reformed by Rustic Belle.” সত্যজিৎ রায়ের এই সমালোচনার শেষ বাক্য মৃণাল সেনের খুব লঘু মন্তব্য মনে হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাষ্য ছিল – “আমাদের এই ডাকসাইটে আমলাটিকে আমি সংশোধন করব না, করার প্রয়োজন দেখিনা, কারণ এই মহাশয় ব্যক্তিটির মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি এক বিশিষ্টকে। তিনি রাগী ও কটুভাষী অথচ আড়ালে আবডালে নিঃসঙ্গ ও দুঃখী।”
এই ছবিটি সরকারি সিনেমা সংস্থা আজকের এনএফডিসি-র ইতিহাস বদলে দিয়েছিল, বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ছবি তৈরির ভাবনার জগতকে। কত কম খরচে, কত ভাল ছবি তৈরী করা যায় ‘ভুবন সোম’ তার উদাহরণ। ছবির এই অন্যরকম জনপ্রিয়তা এনএফডিসিকে ভবিষ্যতে নিউ ওয়েভ সিনেমা বা প্যারালাল সিনেমা প্রযোজনায় সাহস জুগিয়েছিল। ‘ভুবন সোম’ মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জীবনে একটি মাইলস্টোন। ভারতীয় নিউ ওয়েভ সিনেমা বা প্যারালাল সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম যে নামেই ডাকা হোক না কেন! তার অবস্থান মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার থেকে শত যোজন দূরে। মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার কাল্ট তৈরির দায় থাকে না। সাহসী চিন্তনের মৌলিকতার দায় নেই। দর্শককে কঠিন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে তার ব্যক্তিসত্ত্বার সামনে নগ্ন করে আত্মসমালোচনার পরিসর তৈরির দায় তার নেই; দায় নেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার, শ্রেণীশত্রুর মুখোশ ছেঁড়ার। বরং তার দায় প্ৰযোজকের কাছে আর দর্শকের বিনোদনের কাছে। মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার সময়ের সাথে প্রযুক্তির কাঁধে চেপে ঝাঁ চকচকে পেন্টহাউস তৈরির লোভ আছে কিন্তু ক্যানভাসে তাজমহল তৈরির মনন নেই, স্বল্প পরিসরে সিনেমা নামক আর্ট ফর্মের ভাষা আঙ্গিক শৈলী নিয়ে প্রতি নিয়ত নিরীক্ষার সাহস তার নেই।
ব্যতিক্রমী বিষয় ও কাহিনীর জন্য মৃনাল সেন প্রতিমুহূর্তে তাঁর সিনেমার ভাষা আঙ্গিক শৈলী নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ, ইতালিয়ান নিওরিয়েলিজম, জার্মান এক্সপ্রেসনিজম, পোস্ট মর্ডানিসম, সুরিয়ালিজমের প্রভাব মৃণাল সেনের সিনেমায় লক্ষণীয়। মৃণাল সেন তাঁর সিনেমায় সমকালীন পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা দেখেছেন মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, শৈলীতে এনেছেন ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ, ইতালিয়ান নিওরিয়েলিজমের ছন্দ, চূড়ান্ত প্রথা বিরোধী প্রবণতার জন্য সমকালীন বাস্তবতার বাঁধন ছিঁড়েছেন সুরিয়ালিজম আর জার্মান এক্সপ্রেসনিজম ব্যবহার করে। তাঁর সিনেমার কোন সমাধান সূত্র রাখেন না বরং দর্শককে নিজের ভঙ্গীতে ভাবার পরিসর তিনি তৈরি করে দেন আর দৌড় করান বহুমুখী সমাধানের পিছনে।
ফরিদপুর থেকে কলকাতা, তারপর দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেক অনেক রাজনৈতিক টানাপড়েন, উত্থান-পতন, পরিবর্তন চাক্ষুষ করছেন এই শহরে- পরাধীনতা, দেশ ভাগ, স্বাধীনতা, কংগ্রেসী আমল, যুক্তফ্রন্ট গঠন, নকশাল আন্দোলন, বামফ্রন্টের উত্থান-পতন…
মৃণাল সেনের কলকাতার প্রতি এক অন্যরকম বিস্ময় আর ভালবাসা ছিল আজীবন। ‘তৃতীয় ভুবন’ বইতে বলেছেন, “এই শহর কলকাতা ব্যস্ত, সৃষ্টিশীল, একবগ্গা। এখানে নৈরাজ্য দানা বেঁধেছে। কখনো কখনো এখানে জীবনযাত্রা পঙ্গু হয়ে যায় পুরোপুরি। কিছুটা অবিরাম ক্লান্তিহীন বৃষ্টিতে, কিছুটা রাজনৈতিক উত্তেজনায়, কিছুটা আবার নীরবতায়। তবু আমি এখনও কলকাতাকে এলডোরাডো বলে মনে করি। যেন আমি এই অ্যানাটমির একটি অংশবিশেষ।” ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর চলচিত্রে কলকাতা নিজেই একটা চলমান চরিত্র, কলকাতা, কলকাতার জীবন, কলকাতার মানুষ, তাদের চাওয়া পাওয়া, না পাওয়া, তার লড়াই, তার মূল্যবোধ, তার শ্রেণীবৈষম্য – এই সব কিছুকে নিয়েই প্রতিবাদী ও রাজনৈতিক কলকাতা স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে উঠেছিল।
১৯৭১ এর ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’(১৯৭২), ‘পদাতিক’(১৯৭৩), ‘কোরাস’(১৯৭৪), ‘একদিন প্রতিদিন’(১৯৭৯), ‘খারিজ’(১৯৮২)- এই ছবিগুলিতে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মৃণাল সেনের মনন ও চলচ্চিত্রে নাগরিক চিন্তার প্রভাব থাকলেও তা ছিল কাব্যিক কিন্তু ঋজু, রোমান্টিক কিন্তু কঠিন বাস্তবতায় পূর্ণ। ইন্টারভিউ থেকে পদাতিক- ছবিগুলির পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে কলকাতা। কলকাতার শারীরিক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সারা দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গঠনের বিশ্লেষণ করেছেন, দেশের সমকালীন রিয়েলিটিকে একটি perspective-এ এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। হ্যাঁ তাঁর বিশ্লেষণ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে, সামাজিক মূল্যবোধ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দর্শকমহলে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, কেউ একমত হয়েছেন কেউ আপত্তি তুলেছেন; কিন্তু মৃণাল সেনকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
মৃণাল সেনের প্রায় সমস্ত ছবি নাগরিক জীবনের টানাপড়েনের ফসল। ‘ইন্টারভিউ’(১৯৭০), ‘কলকাতা ৭১’(১৯৭২), ‘পদাতিক’(১৯৭৩) এই তিনটি ছবিকে ‘কলকাতা ট্রিলজি’ বলা হয়, এই ছবিগুলিতে দেখা যায় ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে, যে দেখেছে সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিকতা, স্বাধীনোত্তর রাজনৈতিক অবক্ষয়, যাকে তাড়া খাওয়া পশুর মত আজীবন দৌড়তে হচ্ছে জীবন জীবিকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য। অস্তিত্বরক্ষার এই লড়াইতে কখনও সে সোচ্চার হয়, বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, আত্মসমালোচনা করে, কখনও শোষকের চোখে চোখ রেখে ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
‘ইন্টারভিউ’-র রঞ্জিত, একটি ছোট প্রেসে প্রুফ দেখার কাজ করে, একটু বেশি আয়ের আশায় স্থায়ী চাকরির জন্য ঘুরেছে। একটা সুযোগ এল বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরিটা হল না শুধুমাত্র সাহেবি পোশাক না থাকার জন্য। হতাশ অসহায় ক্ষুব্ধ রঞ্জিত রাগে সাহেবি পোশাকের শোরুমের কাচ ভেঙে ম্যানিকিনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। এই সিনেমাতেও মৃণাল সেন তাঁর প্রথাগত ভঙ্গীতে প্রথা ভেঙেছেন। ছবির একটি অংশে ট্রামের মধ্যে মূল চরিত্র রঞ্জিত মল্লিক সরাসরি দর্শকে বলছেন, আসলে মৃণাল সেন তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা করাচ্ছেন, এর মধ্যে ক্যামেরা হাতে ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ‘কে কে মহাজন’-কে দেখা যায়, ট্রামের এক যাত্রী বলে ওঠেন, “একে আপনারা সিনেমা বলেন, এতো আমারই গল্প!”এমনই মুন্সিয়ানায় পরিচালক দর্শককে সিনেমা থেকে বাস্তবে, বাস্তব থেকে সিনেমায় টেনে নিয়ে যান।
‘কলকাতা ৭১’ ছবিটি চারটি আলাদা আলাদা গল্প নিয়ে। প্রথম গল্পের সময় ১৯৩৩, দেখা যায় একটি অতি দরিদ্র পরিবার ঝড় জলের রাতে তাদের বস্তির আস্তানা ছেড়ে আশ্রয় নিতে যায় এক বড় বাড়ি বাইরের বারান্দায় যেখানে ইতিমধ্যে অনেকেই ভিড় করছে। পরের গল্প ১৯৪৩-এর, দেখি দুর্ভিক্ষ আকালের সময় মা বিকিয়ে দিচ্ছে নিজের মেয়েকে। তৃতীয় গল্পের সময়কাল ১৯৫৩, খিদের তাড়নায় জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও চালের চোরাচালান করছে এক কিশোর। আর শেষের গল্পে দেখি ৭১-এর উত্তাল সময়ে পুঁজিপতিদের একটি এলিট ককটেল পার্টিতে উচ্চবিত্ত সমাজের আপাত ভদ্রতার মুখোশের আড়াল থেকে তাদের ক্রূর, স্বার্থসর্বস্ব ভণ্ডামির স্বরূপ খুবই নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। পরিচালক মৃণাল সেন দর্শকের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে যান, হাজার বছরের এই শোষণ দারিদ্রতা শ্রেণী বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ খোঁজার দায় রেখে যান দর্শকের কাছে, প্রজন্মের কাছে।
কলকাতা ট্রিলজির শেষ ছবি ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) ছবির শুরুতে দেখা যায় আগের ছবির নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত তরুণের গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য। ক্রমে সুমিতের সাথে পরিচয় হয় দর্শকের। সময়টা নকশাল আন্দোলনের, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার। একদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, উদ্বাস্তু মানুষের ঢল; অন্যদিকে প্রতিবাদ, আন্দোলন, পুলিশের গুলি। প্রতিবাদী তরুণরা পুলিশের গুলি খেয়ে মরছে আবার শাসকের চোখে চোখ রেখে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে নকশাল আন্দোলনের মূল্যবোধ ফিকে হতে শুরু করে, দল এবং শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতিবাদ আন্দোলন ও যুদ্ধের ধরণ জনগণের সম্মতি ও সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ। কোনো গণআন্দোলন জনগণের সমর্থন সাহচর্য না পেলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, এই বিষয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বান্ধবীর ফ্ল্যাটে আত্মগোপন করে থাকাকালীন গণআন্দোলন আর লাল পার্টির অন্তদ্বন্দ্বে বিব্রত সুমিত। একদিকে পুলিশি হামলা আর অন্যদিকে নেতৃত্বের হুমকিতে বিধস্ত সুমিত। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি ফিরলে সুমিত জানতে পারে তার বাবা অফিসের মুচলেকাপত্রে সই করেননি, জীবনের শেষে এসে এই বৃদ্ধ বয়েসে হাঁপ ধরা কলজেতেও তিনি গণশত্রুকে ঘৃণা করতে জানেন। সুমিতের বাবা সুমিতকে বলছেন, “সাহসী হও।” আসলে পূর্ব প্রজন্ম বর্তমানকে লড়াইয়ের ব্যাটন হাতে তুলে দিয়ে বলছেন লড়াইটা জারি রাখতে হবে, লড়াইয়ের পথ নিয়ে সন্দেহের বা প্রশ্নের অবকাশ সত্ত্বেও লড়াই চালাতে হবে আর বারবার আত্মসমালোচনা করতে হবে। এই ছবি আত্মসমালোচনার, সংগ্রাম জারি রাখার স্থির প্রত্যয়ের।
‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’ – মৃণাল সেনের এই কলকাতা ট্রিলজির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না ১৯৭৫-এর ‘কোরাস’ ছবিটি ছাড়া। এই ছবিতে মৃণাল সেন তাঁর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছেন। রূপক, অ্যালিগরী, ব্যঙ্গ, শ্লেষ আর সমকালীন বাস্তবতার গল্প নিয়ে কোরাস। অ্যাকাডেমিক অর্থে কোরাস গ্রীক নাটকের চরিত্র যারা ভাষ্যকার বা সূত্রধরের ভূমিকা পালন করে বা সমবেত সঙ্গীতের সদস্য। মৃণালের কোরাস ছবিতে বিস্তর মানুষের বহু লড়াই একসাথে একটা সাংগীতিক মুহূর্ত তৈরী করে একটা সমষ্টির আবেগ ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষার গল্প বলে। কোরাসের প্রকাশভঙ্গী খানিক থিয়েট্রিক্যাল, এ নিয়ে নানা কথা উঠলেও শিল্পের রাজ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক ছিল না মৃণাল সেনের, উনি মনে করতেন প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের সামাজিক ও শিল্পগত এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য বক্তব্য প্রকাশ করা, কমিউনিকেট করা যা একজন শিল্পীর প্রধান দায়িত্ব।
‘কোরাস’-এ দেখা যায় এক কাল্পনিক দুর্গ যা একটি প্রতিষ্ঠানের রূপক। সেখানে একশোটি শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ হবে। এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে, কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট টুকরো টুকরো বাস্তব জীবনের ঘটনা ‘কোরাস’ ছবির মূল উপজীব্য বিষয়।
মানুষের খিদে, দারিদ্র্যকে ধর্মের পাঁচন গিলিয়ে ভুলিয়ে রাখা, মানুষের মূল প্রাথমিক সমস্যার জন্য ধর্মের দোহাই, মনুষ্যকল্পিত সৃষ্টিকর্তাকে মিষ্টি মধুর দোষারোপ – ছবি শুরু হয় এমন দৃশ্য দিয়ে, যেখানে কীর্তনের আসরে পদকর্তা গাইছেন
১/
“অভাব না থাকে যদি
থাকে না ঈশ্বর!”
২/
“অভাব সৃজিয়া বিধি ধর্মে রাখে মন
এইভাবে ভক্ত দেবে প্রবাহ মিলন!”
৩/
“কত তন্ত্র কত মন্ত্র কত ভগবান
অভাব রচেন যিনি তিনি শক্তিমান!”
৪/
“অভাবের বরণ পাবে দেবের চরণ!”
ক্রমশ পর্দায় দেখা যায় এক মধ্যযুগীয় অথচ আধুনিক তথ্যসম্প্রচার সক্ষম দুর্গের, যা আসলে ইঙ্গিত করছে এমন একটি ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যেটি প্ৰকৃত গুণগতমানে ধারেভারে সামন্ততান্ত্রিক, আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে শুধুমাত্র প্রযুক্তিতে আর সভাসদদের বদলে রয়েছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্। এই দুর্গে একশো কর্মী প্রয়োজন, ইতিমধ্যে আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার। কোন প্রদ্ধতিতে এই বিপুল সংখ্যক আবেদনের মধ্য থেকে কর্মী নিয়োগ হবে তা নিয়ে চেয়ারম্যান সহ বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্ চিন্তিত হলেও প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত আয়ের কথা মাথায় রেখে আবেদনপত্র বিক্রি চালু থাকে। ওদিকে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার লাইন বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ বাড়তেই থাকে, ভিড় সামলাতে হিমশিম নিরাপত্তা বাহিনী। একসময় বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবেদনপত্র জমা নেওয়া মুলতুবি রাখা হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে আবেদনপত্র জমা দিতে আসা দূরদূরান্তের নানা বয়সের প্রার্থীর দল। বিক্ষোভ সামলাতে নিরাপত্তাবাহিনীর বোমা ও লাঠির আঘাতে ছত্রভঙ্গ হয় ভীড়। এই সময় গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভ(!) সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ যার দরকার চটকদার খবর, কে মরল কে বাঁচল সেটা কোনো মুখ্য বিষয় নয়। সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার থেকেই আমারা কয়েকজন মানুষের জীবনের গল্প জানতে পারি। চাকরিপ্রার্থী গ্রাম্য যুবক বাদল, এক মা ও মেয়ের সংসারের গল্প জানা যায়, জানতে পারি একজন কারখানা শ্রমিক মুখুজ্যের কথা। একসময় শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত মুখুজ্যে ধর্মঘটে শামিল হন না, মালিকের কাছে মুচলেকা দিয়ে কারখানায় কাজ করতে থাকেন। ক্ষুব্ধ মুখুজ্যে পর্দায় বলে যায়, “একটা কারখানা, তিনটা ইউনিয়ন, ইউনিয়নবাজি করো, ঝগড়া করো, কাটাকাটি করো। আমি নিজে লিখব নিজের ডিমাণ্ড।” মৃণাল সেন মনে করতেন, “আমরা সবসময় sectarianism-এর বলি হয়ে দাঁড়াই, সবসময়েই আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। এবং বিচ্ছিন্নতা মানেই হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটা ধসে পড়া এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরো চাগাড় দিয়ে ওঠা, আরো জোরদার হওয়া।”
এই সব টুকরো টুকরো যাপনের গল্পের পাশে অন্যদিকে চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষোভ জমাট বাঁধতে থাকে। সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উত্তাল বানের জলের মতো ছুটে আসতে থাকে মানুষের ঢল। গ্রামের মেঠো পথ, ফসলের মাঠ, রাজপথ পেরিয়ে ছুটে আসে তারা। নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে বদ্ধপরিকর। এ ছবির মূল চরিত্র জনতা। সভ্যতার ইতিহাস আদতে শ্রেণিসংঘাতের ইতিহাস, মৃণালের আগের তিনটি ছবির চরিত্রগুলি যে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পরিণতির দিকে এগিয়েছে তার শেষ কথা আসলে বিপ্লব। শোষণ ও বঞ্চনার অবসানের একমাত্র পথ বিপ্লব। বিশ্বের শোষিত বঞ্চিতরা একজোট হলে শাসকের শোষণ নির্মূল হবেই। মৃণাল সেন কোরাস ছবিতে শোষিতদের পক্ষে থাকার ভণিতা করেননি, বরং দরদ দিয়ে তাঁর স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে শ্রেণীর অবস্থানকে, শ্রেণীসংগ্রামকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজা দেশে’ ছবিতে আমরা দেখি হীরক রাজা শোষিতের দলে মিশে গিয়ে নিজের স্বৈরশাসক-মূর্তিকে দড়ি ধরে টান মেরে খান খান করেছেন, নিজেরই তৈরি করা সাম্রাজ্য ধ্বংস করছেন। ইতিহাস কখনই এমন ঘটনার পক্ষে সায় দেয় না, শাসক শোষক কখনই শোষিতের দলে ভেড়ে না। এমন ‘উদারনৈতিক গোলমেলে ইতিহাস’ বাতিল করতে একজন শিল্পীকে শুধুমাত্র শ্রেণী সংগ্রাম বুঝলেই হবে না, শোষিতের সমব্যথী হলেও হবে না, বরং নিজের আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন। বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করার মনন থাকার দরকার। তবেই তাঁর শিল্পে এর যথার্থ প্রকাশ ঘটবে।
১৯৭৬-এর ‘মৃগয়া’ ব্রিটিশ রাজের সময়ের গল্প নিয়ে ছবি। তাতেও সমকালীনতা ছাপ স্পষ্ট, সেই শোষিতের গল্প। ১৯৭৯-তে তৈরী করলেন ‘একদিন প্রতিদিন’, এক চাকুরীরতা মহিলার গল্প তার পরিচিত অপরিচিত মানুষজনের চোখে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সারাক্ষণ তাকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। তার পোশাক আশাক, এমনকি অসাবধানতাবশত কপালের ঘসে যাওয়া টিপও তার চরিত্র নিয়েও সন্দেহের প্রশ্ন তুলছে। একটি নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়াটা এবং সাতজনের সংসারের দায়িত্ব নেওয়াটা নিতান্তই অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে আমাদের নাগরিক উচিৎ অনুচিতের দ্বন্দ্বে। মৃণাল সেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রশ্ন রেখে যান দর্শকের সামনে।
‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩), ‘জেনেসিস’(১৯৮৬), ‘মহাপৃথিবী’(১৯৯১) ‘অন্তরীণ’(১৯৯৩) ছবিগুলিতে সময়ের দাবি মেনে সমকালীন সমাজবাস্তবতার শর্তপূরণের দাবিটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। বাস্তবকে আপন দৃষ্টিতে সাজিয়ে গুছিয়ে তার পুনর্বিন্যাস করেছেন।
মৃণাল সেন শিল্প এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁর শিল্প ভাবনার আঙ্গিকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা চালিয়েছেন, নান্দনিকতার প্রলেপ দিয়ে গল্পের কৃত্রিম কাঠামো ভেঙে সমাজমনস্ক সংবেদনশীলতায় সমকালীন সমাজসত্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্বকে সমষ্টির দ্বন্দ্বে উন্নীত করেছেন। কাহিনী নয় বরং বক্তব্য ও চরিত্রের মনোজগৎই ছিল তাঁর চলচ্চিত্রের মূল উপাদান। তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে নিয়ত নিরীক্ষা অনুশীলন এবং তার প্রথা ভাঙা প্রয়োগ সিনেমার ইতিহাসে তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সমকালীনতার কারিগর অতিক্রান্ত ইতিহাসের আনাচ কানাচ থেকে যা কিছু আহরণ করেছিলেন তা রেখে গেছেন সিনেমাবোদ্ধা, সিনেমাপ্রেমী দর্শক ও ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে।
লেখা – বাপ্পাদিত্য
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel