বিবাহসূত্রে ১৯৪৫ সালে তাঁকে চলে আসতে হয় চাঁপাই নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরে। পরবর্তীসময়ে পরিবারের শ্রেণি-অবস্থানকে অতিক্রম করে, কমিউনিস্ট নেতা ও স্বামী রমেন্দ্রনাথ মিত্র এর সঙ্গে, তিনি যুক্ত হন জমিদারি উচ্ছেদ ও জোতদারি শোষণের বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলনে। ১৯৪৬-৪৭ সালে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের উপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলার ১৯টি জেলায় গড়ে ওঠে তেভাগা আন্দোলন, তা পরিব্যপ্ত থাকে ১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত। তেভাগার দাবিতে রাজশাহী জেলার, বিশেষভাবে নাচোলের কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে তাঁর এতটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে, তারা তাঁকে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, সে সঙ্গে নিজেদের একজন বলেও ভাবতেন। ইলা মিত্র ক্রমশ হয়ে ওঠেন সাঁওতাল ও অন্যান্য কৃষকদের ‘রাণীমা’। সাঁওতাল মেয়েদের ভেতরে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার এবং তাদেরকে সংগঠনে টেনে আনার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র সবিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। বরেন্দ্র এলাকায় প্রচলিত ব্যবস্থায় বিশ আড়ি (কাঠা/ ধামা) ধান কাটা ও মাড়ানোর জন্য জমিতে চাষাবাদ করেছেন যে কৃষক বা ঐ উদ্দেশ্যে নিযুক্ত মজুর পেতেন তিন আড়ি ধান। ঐ ধানের পরিমাণ বাড়িয়ে সাত আড়ি করা এবং ফসলের তেভাগা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তাঁর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে তা জায়গা করে নিয়েছে কালোত্তীর্ণ স্থানীয় লোকগীতিতে। তবে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন শেষাবধি সফল হয়নি। কৃষকদের সঙ্গে সংঘর্ষে দারোগাসহ চারজন পুলিশ নিহত হওয়ার সূত্রে পাকিস্তানি শাসকবর্গ আদিবাসীদের ওপর প্রচন্ড নিপীড়ন চালাতে শুরু করলে নাচোলের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। ইলা মিত্র নিজে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন, এ ছাড়া তাঁকে এক নম্বর আসামি করে অনিমেষ লাহিড়ী, বৃন্দাবন সাহা, শেখ আজাহার হোসেনসহ মোট ৩১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করা হয় এবং বিচারে ইলা মিত্রসহ ২৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তবে তাঁর মুক্তির দাবিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হন। নাচোলে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি পূর্ব বাংলার সংসদে উত্থাপনের চেষ্টা মুসলিম লীগ সরকার প্রতিহত করে। তবে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় হীরেন মুখার্জী ইলা মিত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কলকাতা যাবার পর ইলা মিত্র আর পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেননি।