গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য, গুপ্ত শাসন প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খ্রিস্টীয় তিন শতকের শেষ এবং চার শতকের প্রথমদিকে সম্ভবত প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা সমুদ্রগুপ্তের মাধ্যমে বাংলায় গুপ্ত শাসন সম্প্রসারিত হয়। শিলালিপি, প্রশস্তিলিপি, তাম্রশাসন, মুদ্রা, সাহিত্যিক উপকরণ এবং বিদেশিদের বর্ণনা থেকে বাংলায় গুপ্ত শাসন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল। মহারাজ শ্রীগুপ্ত ধ্রুপদী সভ্যতা-র আদর্শে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গুপ্ত রাজারা সম্ভবত বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং কুষাণ রাজাদের সামন্ত হিসাবে উত্তর প্রদেশে শাসন করতেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ( ৩১৯-২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে – ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিয়ে করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় তাঁর প্রাধান্য স্থাপন করেন । তাঁর রাজ্য উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার এবং বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর ছেলে সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করে যান । প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত এই দুইজন ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সম্রাট তাদের সময় সাম্রাজ্যের সীমা দক্ষিণ ভারতেও প্রসার লাভ করে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে কুষাণরা ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজারা কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে এই দুই সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের ফলে এই রাজনৈতিক শুন্যতার অবসান হয় । কুষাণ ও সাতবাহন এই দুই সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও আয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহারের চেয়ে উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং গোড়ার দিকে মুদ্রা ও শিলালিপি প্রধানত এখান থেকেই পাওয়া গেছে ।
গুপ্ত রাজাদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ( ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে – ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)। শৌর্য-বীর্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ভারত ইতিহাসে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন । সিংহাসনে বসার পরই সমুদ্রগুপ্ত রাজ্য বাড়ানোর কাজে লেগে যান। সমুদ্রগুপ্ত তাঁর ৪০ বছরের রাজত্বকালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করেন এবং এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নর্মদা তীর পর্যন্ত ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পশ্চিমে চম্বল ও যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অশোকের শান্তি ও অহিংসা নীতি বর্জন করে সামরিক শক্তির সাহায্যে তিনি এক সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেন। তাঁর সিংহাসনে বসার সঠিক সময় সম্বন্ধে জানা যায়নি, সম্ভবত তিনি ৩২০ খ্রিস্টাব্দের পর সম্রাট হন। ড. রোমিলা থাপারের মতে, তিনি ৩৩৫ সাল নাগাদ উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনে বসেন। অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা তাঁর অধীন না হলেও তাঁরা তাঁকে কর দিতেন । তাঁর বিজয় নীতির ফলে গঙ্গা-যমুনা, দোয়াব, রহিলখন্ড, পূর্ব মালবের কিছু অংশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তা ছাড়া সমতট (পূর্ববঙ্গ), দাবাক (সম্ভবত আসামের নওগাঁও), কামরূপ, নেপাল, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর প্রভৃতি উপজাতিও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন ।
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিলিপি সূত্রে জানা যায় যে, তিনি সমতট ছাড়া বাংলার অন্য সব জনপদ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। কালক্রমে করদ রাজ্যও গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। কারণ ছয় শতকের প্রথম দিকে (৫০৭-০৮ খ্রি.) এ অঞ্চলে বৈন্যগুপ্ত নামে গুপ্ত বংশীয় এক রাজা ছিলেন। তিনি এক দানপত্র সম্পাদন করে তাঁরই একজন অনুগত ব্যক্তিকে ভূমি দান করেন বলে গুনাইঘর তাম্রশাসনে উল্লেখ করা আছে, যদিও নিজস্ব দলিলপত্রে বৈন্যগুপ্ত ‘মহারাজ’ উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রায় তাঁকে ‘দ্বাদশাদিত্য’ এবং নালন্দায় প্রাপ্ত একটি সীলমোহরে ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সমুদ্রগুপ্তের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের আগের প্রত্যন্ত রাজ্য ছিল নেপাল, কর্তৃপুর, কামরূপ, ডবাক (আসাম অথবা ঢাকা), এবং সমগ্র উত্তর বাংলা যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীন ছিল তা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তাম্রশাসনের ভিত্তিতে প্রমাণিত।
প্রথম কুমারগুপ্তের সময় (৪৩২-৪৪৮ খ্রি.) থেকে উত্তর বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে গড়ে ওঠে। এটির নাম ছিল তখন ‘পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি’। বুধগুপ্তের দামোদরপুর তাম্রশাসন (৪৭৮ খ্রি.) থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পাঁচ শতকে উত্তর বাংলা ছিল পুরোপুরিভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অঞ্চলে গুপ্ত প্রাদেশিক শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল পুন্ড্রনগর বা মহাস্থান। এখানে গুপ্তদের সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সভাকবি হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে তাঁর বিজয় কাহিনি জানতে পারা যায় । সমুদ্রগুপ্ত যে সব রাজ্য জয় করেছিলেন, তাদের মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা যেতে পারে । প্রথমভাগে রয়েছে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকার রাজ্যগুলির রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাদের রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন । দ্বিতীয়ভাগে পড়ে পূর্ব হিমালয়স্থিত রাজ্যগুলি এবং নেপাল, বঙ্গ, আসাম প্রভৃতি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের রাজ্য ও পাঞ্জাবের কয়েকটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র।
তৃতীয়ভাগে রয়েছে বিন্ধ্য অঞ্চলের অটবিক রাজ্যগুলি । চতুর্থভাগে বলা হয়েছে দক্ষিণ-ভারতে পরাজিত ১২ জন রাজার নাম । সবশেষে পঞ্চমভাগে শক ও কুষাণ রাজাদের নামের তালিকা । উত্তর ভারতে সমুদ্রগুপ্ত যেসব রাজাকে পরাজিত করেন, তাঁরা হলেন অহিচ্ছত্ররাজ অচ্যুত (বেরিলী), মতিল (উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল), বলবর্মন (অনেকের মতে কামরূপ রাজ), চন্দ্রবর্মণ (বাঁকুড়া জেলার গোলকর্ণ) ও রুদ্রদেবের (বুন্দেলখন্ড) নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । দক্ষিণ ভারতে যে রাজাদের তিনি পরাজিত করেন— কোশলরাজ মহেন্দ্র (মহানদী উপত্যকা), মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, কুরলের মন্তরাজ, পিষ্ঠপুর বা পিঠাপুরমের (গোদাবরী জেলা) মহেন্দ্রগিরি, কোট্টুরের (উত্তর তামিলনাড়ু) স্বামীদত্ত, এরন্ডপল্লের (উত্তর তামিলনাড়ু) দমন, কাঞ্চীর পল্লবরাজ বিষ্ণুগোপ, অবমুক্তর নীলরাজ (কাশ্মীরের কাছাকাছি অঞ্চল), বেঙ্গীর (কৃষ্ণা ও গোদাবরীর মধ্যাঞ্চল) হস্তিবর্মণ, পালক্করাজ (নেলোর) উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের (ভিজাগাপত্তম) কুবের ও কুন্তলপুরের (উত্তর আর্কট) ধনঞ্জয়।
তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্যই তিনি গাঙ্গেয় উপত্যকার একটি ছোট্ট রাজ্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । আর্যাবর্ত থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সফল সামরিক অভিযান তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর, বিভিন্ন রাজাকে পরাজিত করে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন । ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ তাঁকে ভারতের নেপোলিয়ান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি কেবল সুদক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না , তিনি সাহিত্যিক, শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । সংস্কৃত পন্ডিত হরিষেণ ও বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন । ড: রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, সমুদ্রগুপ্তের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা ভারতের ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করেছিল। গুপ্ত শাসকদের শাসনামলে ভারতে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত, তারই ফলে দেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে, তাই গুপ্তযুগকে বলা হয় ভারতের স্বর্ণযুগ। এই যুগ ছিল আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, শিল্প, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গনিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম ও দর্শনের বিশেষ উৎকর্ষের যুগ। গুপ্ত যুগের সময় অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা এঁদের অবির্ভাব হয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদী গুপ্তদের আদি পরিচয় নিয়ে পন্ডিত-গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে। শ্রীগুপ্ত হচ্ছেন গুপ্ত বংশের আদি পুরুষ। এল্যানের মতে, পাটলিপুত্র (মগধের ভিতরে) নগরের কিছুটা দূরেই শ্রীগুপ্তের রাজত্ব ছিল। অন্যদিকে ধীরেন্দ্র চন্দ্র গাঙ্গুলী, চিনের পরিব্রাজক ই- ৎসিঙ এর বর্ণনায় গুপ্তদের আদি বাসস্থান মগধে নয় বাংলার মুর্শিদাবাদে ছিল বলে মনে করেন। ই-ৎসিঙ্ ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন। এর পাঁচশো বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় দু’শতকে চীনা পরিভ্রমণকারী হুই লন, নাল্ন্দা পরিদর্শন করেন। সে সময় একজন ‘মহারাজা’ শ্রীগুপ্ত একটি পবিত্র স্থানের পাশে চীনা পুরোহিতদের জন্য একটি চিনা মন্দির নির্মাণ করে দেন। এ মন্দিরের ব্যয়ভারের জন্যতিনি ২৪টি গ্রামও দান করেন।
মন্দিরটি নালন্দা থেকে ২৪০ মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল এবং গঙ্গার গতিপথ ধরে নালন্দা থেকে চল্লিশ যোজন দূরত্বে ছিল মুর্শিদাবাদের অবস্থান। এভাবে ই-ৎসিঙ্-এর বিবরণের দূরত্ব ও দিক বিচার করে গুপ্তদের আদি বাসস্থান বাংলার মুর্শিদাবাদে ছিল বলে মন্তব্য করেন। হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী বলেন, উত্তর বঙ্গ বা বরেন্দ্র ছিল গুপ্ত রাজাদের মূল বাসস্থান। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের একটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপির একটি ছবির নিচে যে বর্ননা দেয়া আছে তাতে ‘বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপন স্তূপ’ লেখা থেকেও মনে হয় চীনা মন্দিরটি বরেন্দ্রের মৃগস্থাপন স্তূপের পাশেই অর্থাৎ বরেন্দ্র বা এর আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত ছিল। সুতরাং একথা বলা যেতে পারে যে, গুপ্তদের আদি নিবাস ছিল খুব সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ অথবা উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রীতে, যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল গুপ্তযুগের (৩৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে – ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় । “দেবীচন্দ্রগুপ্তম্” নাটক থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন । তিনি একজন শক রাজার হাতে পরাজিত হয়ে নিজ স্ত্রী ধ্রুবদেবীকে তাঁর হাতে সমর্পণ করেন । তখন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সেই রাজাকে হত্যা করে রানির মর্যাদা রক্ষা করেন । পরে রামগুপ্তকে হত্যা করে ও ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করে সিংহাসন দখল করেন । অনেকে এই কাহিনি সত্য বলেও মনে করেন ।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পিতা সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ী নীতি অনুসরন করেন । তিনি কেবলমাত্র বাহু বল দিয়েই রাজ্য জয় করেন নি। তিনি ইউরোপের হ্যাপস্বার্গ ও বুঁরবো রাজাদের মতো বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করেও রাজ্য বিস্তার করেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল শকদের যুদ্ধে পরাজিত করা । যুদ্ধ জয়ের স্মৃতিতে তিনি এক রৌপমুদ্রা প্রচলন করেন। শকদের পরাজয়ের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত হয় । তাছাড়া এর ফলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ভারতীয় বণিকদের প্রসার ঘটে । তিনি বাকাটক রাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে তাঁর কন্যা প্রভাবতীর বিয়ে দিয়ে দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম অঞ্চলে তাঁর প্রাধান্য স্থাপন করেন । বিয়ের পাঁচ বছর পর রুদ্রসেনের মৃত্যু হলে প্রভাবতী তাঁর ছেলের অবিভাবক হিসাবে রাজত্ব করেন । ফলে বাকাটক রাজ্য কার্যত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ।
চন্দ্রগুপ্ত বিভিন্ন মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য উপাধি ব্যবহার করেছেন । শকদের পরাজিত করে তিনি “শকারি” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন । তাই অনেকের মতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত হচ্ছেন বিক্রমাদিত্য শকারি, যাঁর রাজসভায় কালিদাস ও বরাহমিহিরসহ নয়জন রত্ন ছিলেন। অবশ্য নবরত্নের সবাই তাঁর সমসাময়িক ছিলেন কিনা, এবং বিক্রমাদিত্য ও চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি ছিলেন কি না সেটা সুনিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই বিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন । তাঁর রাজত্বকাল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষতার জন্য ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । সমুদ্রগুপ্তের পাশে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে কিছুটা ম্লান বলে মনে হতে পারে, সমুদ্রগুপ্তের মতো চমকপ্রদ সামরিক প্রতিভা তার ছিল না। তিনি শকদের পরাজিত করে এবং পশ্চিম মালব ও গুজরাট জয় করে তাঁর সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । উজ্জয়িনী ছিল মালবের রাজধানী । সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয় নীতি সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সামরিক শক্তির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যে যাতে সুশাসন থাকে সে দিকে তাঁর নজর ছিল, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁর বাবার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না, বরং অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন । তবে রোমিলা থাপারের মতে, গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতা ও সুফল কেবল মাত্র সমাজের উঁচু তলার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র কুমারগুপ্ত (৪১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে – ৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) মগধের সিংহাসনে বসেন। তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানা অক্ষুন্ন রাখেন । নতুন করে কোনো রাজ্য জয় না করলেও তিনি অশ্বমেধের যজ্ঞ করেছিলেন । তাঁর সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে হুন আক্রমন হয় । যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত হূনদের পরাজিত করে আসন্ন বিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করেন । গুপ্তযুগের শেষ শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন স্কন্দগুপ্ত তিনি ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । হুন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে “ভারতের রক্ষাকারী” বলে অভিহিত করেন । তিনি সুশাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন । জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায় তিনি সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদ সংস্কার করেন । তাঁর মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় ।
অন্যান্য স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মতো গুপ্ত শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিল সম্রাটের সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার উপর । কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজাদের সেই যোগ্যতা না থাকায় গুপ্তরাজ্যের পতন শুরু হয়। পরে সিংহাসনে কে বসবে তা নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কলহ ও বিরোধ দেখা দেয়, যা গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল। প্রাদেশিক শাসক ও সামন্ত প্রভুরা এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। কাথিয়াবাড়ের শাসনকর্তা বুধগুপ্ত মহারাজ উপাধি নিয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে শুরু করেন । দক্ষিণ কোশল ও নর্মদা অঞ্চলের রাজারা নামে মাত্র গুপ্ত সম্রাটের অধীনে ছিলেন । বাংলাও স্বাধীন হয়ে যায় । পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটরা সামরিক শক্তিকে অবহেলা করে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে অহিংস নীতি গ্রহণ করেন, হুনরা যখন আক্রমণ করে, তখন সেই আক্রমণ তারা ঠেকাতে পারেনি। গুপ্তযুগে ভারতের রফতানি বানিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। রাজস্বের পরিমাণ কমে যায়, মুদ্রা ব্যবস্থায় ক্রমাবনতি দেখা দেয় । অর্থনৈতিক বিপর্যয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে দেয় ।
গুপ্ত শাসনামলে বাংলায় কতগুলি প্রশাসনিক স্তর ছিল যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’, ‘বীথি’ ও ‘গ্রাম’। এ সব প্রশাসনিক স্তরের প্রত্যেকটির প্রধান কেন্দ্রে একটি করে ‘অধিকরণ’ (অধিষ্ঠান) ছিল। ‘ভুক্তি’ ছিল সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক ইউনিট। সমসাময়িক লিপিমালায় ‘পুন্ড্রবর্ধন’ (সমগ্র উত্তরবঙ্গ) এবং ‘বর্ধমান’ (প্রাচীন রাঢ়ের দক্ষিণাংশ) নামে দুটি ভুক্তি ছিল বলে জানা যায়। রাজার একজন ডেপুটি ভুক্তি শাসন করতেন। ‘ভুক্তি’ প্রশাসককে ‘উপরিক’ বা ‘উপরিক মহারাজ’ বলা হতো। ‘বিষয়’ ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট। ‘বিষয়’ প্রশাসকের উপাধি ছিল ‘কুমারমাত্য’ এবং ‘আযুক্তক’। লিপিমালা থেকে ‘কোটিবর্ষ বিষয় ( সেকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী চারজন সদস্য ও স্বয়ং বিষয়পতির সমন্বয়ে এ উপদেষ্টামন্ডলী গঠিত হতো), পঞ্চনগরী বিষয়, ‘বরাকমন্ডল বিষয়’ ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়। বিষয়াধিকরণে ‘পুস্তপাল’ (দলিল রক্ষক) নামে এক শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। ‘খিল’ (পতিত জমি), ‘ক্ষেত্রে’ (চাষযোগ্য), ‘বাস্তু’ (বসবাসের উপযোগী) ভূমির নাম পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে ভূমির পরিমাপের একক ছিল কূল্যবাপ’ ও ‘দ্রোণবাপ’। এ ছাড়াও ‘পাটক’, ‘ভূ-পাটক’, ‘আঢক’, ‘কাকিনি’, ‘খাদিক’, ‘হাল’, ‘দ্রোণ’ ইত্যাদিও পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত যুগ সামগ্রিকভাবে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে খ্যাত। এ সময়ে প্রজাহিতৈষী কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় যে শান্তি, সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রকাশ ঘটে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলা তার সুফল ভোগ করে। বাংলা সর্বভারতীয় বাণিজ্যেরও অংশীদার হয়। গুপ্ত যুগে বাংলায় সোনা ও রুপার মুদ্রার প্রচলন হয়। স্বর্ণ মুদ্রার বহুল প্রচলন বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধির পরিচয় দেয়। সুপারি, রেশম, তুলা, নারিকেল, লবণ, চিনি ইত্যাদি বাংলা থেকে রপ্তানি করা হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে এসময় বাংলার বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে গুপ্ত-অনুকরণ মুদ্রা পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় বাংলা মুদ্রা অর্থনীতির সুফল ভোগ করেছে। শিল্পের দিক থেকেও গুপ্ত যুগে বাংলার অগ্রগতি দেখা যায়, গুপ্ত যুগে উত্তর ভারতে ভাস্কর্য শিল্পের যে বিবর্তন দেখা যায় বাংলার ভাস্কর্যেও তার সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে। উত্তর বাংলায় পাওয়া অল্প কিছু নিদর্শনে এ বিবর্তনের প্রমাণ রয়েছে। পরে বাংলার পাল ভাস্কর্যে গুপ্তযুগের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে সহনশীলতার জন্যও গুপ্ত যুগ বিখ্যাত। গুপ্ত সম্রাটরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী হলেও সে সময়ে বাংলায় বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করেছে।
#তথ্যসূত্র #উইকিপিডিয়া #বাংলাপিডিয়া #গ্রন্থপঞ্জি RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Calcutta, 1971; এ.এম চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঢাকা, ৭ম সংস্করণ, ১৯৯৮।