চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন ভারত উপমহাদেশের মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি গ্রীকদের কাছে স্যান্ড্রোকোটাস নামে পরিচিত। তিনি ৩৪০ খিস্টপূর্বে জন্মগ্রহণ। এই বংশটির নাম এসেছে তার মা মুরার থেকে। আবার কেউ কেউ বলেন, মৌর্য কথাটি এসেছে ময়ূর থেকে। মৌর্য বংশ আসলে শাক্য বংশের একটি শাখা। যে শাক্য বংশে গৌতম বুদ্ধ জন্ম নিয়েছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে অনেকগুলি উপাধিতে ডাকা হয়। তার মধ্যে প্রধান হলঃ চন্দ্রশ্রী, প্রিয়দর্শন ও ভ্রিশাল। ভ্রিশাল অর্থ শুদ্রের সন্তান। অবশ্য মহাকাব্য মহাবংশ থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন হ্মত্রিয়। চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষক ছিলেন চাণক্য বা কৌটিল্যা, যিনি পরবর্তীকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হন। চাণক্যর সাহায্যে তিনি একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। চাণক্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং মগধ রাজ্য আক্রমন করেন। মগধের নন্দবংশের রাজাকে পরাজিত করে মগধ দখল করেন। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বে মগধের রাজধানী পাটলীপুত্র জয় করেন। চন্দ্রগুপ্ত মগধে কেন্দ্রিয় প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। বেশিরভাগ শক্তি তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ তাঁর দায়িত্ব পালনে সাহায্য করেন। সাম্রাজ্যটি বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল। পাটালিপুত্র ছিল রাজধানী।
সেই সময় ভারত অসংখ্য রাজ্য এবং প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত ছিল। তাদের মধ্যে মগধ রাজ্যও ছিল সবচেয়ে বড়, যার শুরু করেছিলেন রাজা বিন্দুসার (খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ – ৪৯২)। মগধের সীমানা অনেকটা প্রসারিত ছিল মধ্য, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে এই উপমহাদেশে আক্রমণ করেছিলেন। ফলে উত্তর-পশ্চিমের বেশিরভাগ এলাকা বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছিল। এই সময় মগধের শাসক ছিলেন নন্দ রাজবংশের ধনানন্দ (৩২৯-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব)। রোমান ঐতিহাসিক কার্টিয়াসের মত অনুসারে, তাঁর ধনসম্পদ এবং ২০,০০০ ঘোড়া বাহিনি, ২,০০,০০০ পদাতিক বাহিনি, ২,০০০ রথ এবং ৩,০০০ হাতি ছিল। যা ম্যাসেডোনিয়ার সৈন্যদের ভয় ও হতাশাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। চন্দ্রগুপ্তের বেশিরভাগ জীবন এবং উৎস এখনও রহস্যের মধ্যে ডুবে আছে। তাঁর সম্পর্কে আসল ঐতিহাসিক উৎসগুলির চেয়ে কিংবদন্তি ও লোককাহিনীই বেশি। চন্দ্রগুপ্তের একমাত্র সুনির্দিষ্ট শিলালিপি হল দ্বিতীয় শতাব্দীর জুনাগড়ের শিলালিপিতে। ঐতিহাসিক শাস্ত্রির মতে, মৌর্যদের দ্বারা নন্দদের রাজত্বের দখলের বিবরণগুলির জন্য আমাদের অবশ্যই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবং গল্প-কাহিনী সম্পর্কে জানতে হবে।
বৌদ্ধ, জৈন এবং প্রাচীন সাহিত্যগুলি বিভিন্ন বর্ণনা দেয়। যেখানে তাকে ক্ষত্রিয় বলা হয়। আবার নেপাল- তিব্বত সীমান্তের মরিয়া বংশের শাসক পিপ্পালিভাইনের শাখা বলে। কেউ কেউ দাবি করেন যে, তিনি সাধারণ পরিবারেরই জন্ম নেন। চন্দ্রগুপ্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং মুকুট অর্জনের উপায় খুঁজছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করেছিলেন। মনে করা হয় তাঁর সেনাবাহিনীকে মগধে যুদ্ধ করার জন্য বলেছিলেন। অবশ্য, মগধ রাজ্য থেকে চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করার জন্য উত্তর-পশ্চিমে সমস্ত পথ যাওয়া সম্ভব ছিল না। তার পরিবর্তে তিনি ধনানন্দের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন বলে মনে হয় এবং তাঁর সেনাবাহিনীতে চাকরি চেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, রোমান ইতিহাসবিদ জাস্টিন ভুল করে ধনানন্দের পরিবর্তে আলেকজান্ডারের কথা বলেছেন। চন্দ্রগুপ্তের সাথে চাণক্যর সম্পর্ক নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে তিনি ছিলেন তাঁর সেরা শিক্ষক ও মিত্র। লোককথায় আছে, ধনানন্দের দরবার থেকে ফিরে আসার পথে চাণক্য একটি গ্রামে একটি ছেলেকে দেখেছিলেন। যে খেলায় একজন মহান রাজা হওয়ার গুণাবলী প্রদর্শন করছিলো। চাণক্য তাকে ভবিষ্যৎ রাজা হিসাবে গ্রহণ করেন। তার ভবিষ্যতের ভূমিকার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। চন্দ্রগুপ্ত তার সৈন্যদের মনোবল বাড়িয়ে তোলেন এবং গ্রীক-ম্যাসেডোনিয়ার হামলাকে চ্যালেঞ্জ জানান। বিশাখাদত্ত রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষস বইয়ে এই গল্পের অনেক বর্ণনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রে সিংহাসন সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হন। ধনানন্দ পালিয়ে গিয়েছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোযোগ দেন। মৌর্য রাজ্য বর্তমান বিহারের রাজ্য এবং ওড়িশা এবং বাংলা থেকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূল অর্থাৎ বর্তমান কর্ণাটক রাজ্য পর্যন্ত ছিল।
চন্দ্রগুপ্ত পূর্বদিকে আলেকজান্ডারের সেনাপ্রধান সেলিউকাসের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধটি একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ সালে শেষ হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত বর্তমান আফগানিস্তানের কান্দাহার অঞ্চল, পাকিস্তানের দক্ষিণ বালুচিস্তান এবং পরোপামিসাদাই অঞ্চলগুলি দখল করেছিলেন। গ্রীকদের ৫০০ টি হাতি দেওয়া হয়েছিল। লোকে বলে যে, সেলিউকাস তাঁর কন্যা হেলেনাকে চন্দ্রগুপ্তের সাথে বিয়ে দেন। মেগাস্থিনিসক পটলিপুত্রের মৌর্য আদালতে উপস্থিত হন এবং গ্রীক রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরে তিনি মৌর্য প্রশাসন সম্পর্কে বই লিখেছিলেন। যাঁর নাম ইন্ডিকা। মুদ্রারাক্ষস থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত ব্রাহ্মণ ধর্ম ত্যাগ করে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কর্ণাটকের প্রাচীন শিলালিপিতে তার কথা বলা হয়েছে। তিনি জৈন গুরু ভদ্রাবাহুর সাথে কর্ণাটকে যান এবং পরে সাললেখানার রীতি অনুসরণ করতে গিয়ে মারা যান। চন্দ্রগুপ্ত ২৪ বছর রাজত্ব করেন এবং তার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বিন্দুসার শাসক হন। যিনি ছিলেন মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট দ্যা গ্রেট অশোকের বাবা।