আপনি জানেন কি? ভারতীয় উপমহাদেশের কলকাতা মেডিকেল কলেজ ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও আগে মেয়েদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলো।
ব্রজকিশোর বসু, তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের একজন সংস্কারক। তিনি বিহারের ভাগলপুর স্কুলের প্রধানশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। অভয়চরণ মল্লিকের সাথে মিলে মেয়েদের অধিকারের জন্য তিনি আন্দোলন করেছেন আর ভাগলপুরেই প্রথম মহিলা সমিতিও স্থাপন করেছিলেন। এই বজ্রকিশোর বসুর ঘরেই জন্ম নেয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী বসু।
১৮৬১ সালের ১৮ জুলাইয়ে বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদসিতে কাদম্বিনীর জন্ম। এটি তাদের আদি নিবাস। আবার অনেকের মতে, তার বাবা ভাগলপুরের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে তার জন্ম ভাগলপুরে। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ইংরেজী মাধ্যমে। প্রথমে ঢাকার ব্রাহ্ম ইডেন মহিলা বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে কলকাতার বালিগঞ্জের বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে। ১৮৭৮ সালে বেথুন স্কুলে পড়াকালীন প্রথম মেয়ে হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে বেথুন কলেজ থেকে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং স্নাতক পড়া শুরু করেন। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু সেই কলেজের প্রথম মিহিলা গ্র্যাজুয়েট। তারাই ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। এই বেথুন কলেজেই কাদম্বিনী তার শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সংস্পর্শে আসেন। দ্বারকানাথ ছিলেন একজন বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও জনদরদী সাংবাদিক। তিনিই কাদম্বিনীকে তাঁর পূর্ণ মানবিক সম্ভাবনাগুলোকে উপলব্ধিতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
গ্র্যাজুয়েট হবার পর পরই কাদম্বিনী তিনি ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু সেই সময় মেয়েদের জন্য ডাক্তারি পড়া এতটা সহজ ছিল না। ১৮৭৫ সাল থেকে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে মহিলা শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পেলেও বাংলায় তা সম্ভব ছিল না। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি এবারও কাদম্বিনীর পাশে ছিলেন। একরকম লড়াই করে ১৮৮৪ সালে কাদম্বিনী কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্রথম মহিলা শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। শুরু হয় তার নতুন পথচলা। মেডিকেলে ভর্তির পর কাদম্বিনী তার শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন। তখনকার হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজ তাদের এই বিয়েকে মেনে নেয়নি। কারণ দ্বারকানাথ ছিলেন ৩৯ বছরের বিপত্নীক, ৬ সন্তানের পিতা আর কাদম্বিনী ছিলেন ২১ বছরের তরুণী। তারা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের সামনের জীবন কতটা কঠিন হতে চলেছে।
কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় সরকারের কাছ থেকে মাসে ২০ টাকা করে স্কলারশিপও পেতেন। ডাক্তারি ফাইনাল পরীক্ষায় একজন অধ্যাপক কাদম্বিনীকে একটি প্র্যাকটিক্যালে ফেল করান। যে কারণে কাদম্বিনী তার এমএ সার্টিফিকেট পাননি। সে শুধুমাত্র এলএমএস সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে বের হবার পরে অধ্যক্ষ ডঃ জেএম কোটসের কাছ থেকে জিএমসিবি ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার অনুমতিও পেয়েছিলেন।
চিকিৎসক ও সমাজকর্মী হিসেবে কাদম্বিনীর সুনাম শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রমান পাই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের লেখা একটি চিঠি থেকে। ১৮৮৮ এর ফেব্রুয়ারিতে নাইটিঙ্গেল তার বন্ধুকে লেখা পত্রে কাদম্বিনীর বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার কথা বারবার উল্লেখ করে বলেন,”
“(তিনি) মেডিসিন এবং সার্জারি পরীক্ষায় প্রথম লাইসেন্স প্রাপ্ত মহিলা ডাক্তার হিসেবে পাস করেছেন এবং আগামী মার্চ মাসে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে চলেছেন। একজন বিবাহিত মহিলা যিনি দুটি সন্তান মারা যাওয়ার পরে এখন এক সন্তানের জননী হিসেবে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি বিশ্রামে থাকার জন্য মাত্র তেরদিন অনুপস্থিত ছিলেন এবং আমার বিশ্বাস সে একটি লেকচারও বাদ দেননি। ” ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলও কাদম্বিনীর নিষ্ঠার প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আরও জেনে অবাক লাগে, তিনিই চিঠিতে কাদম্বিনীকে লেডি ডাফারিন মহিলা হাসপাতালে মহিলা ডাক্তার হিসেবে যোগদান করানোর সুপারিশ করেছিলেন। সেই হাসপাতালে তার মাসিক বেতন ছিল ৩০০ টাকা যা বর্তমান সময়ের ৪ লক্ষ টাকারও বেশি।
ব্রিটিশ নারীবাদী সমাজ সংস্কারক ও লেখিকা অ্যানি বেস্যান্ট কাদম্বিনীকে তাঁর “How India Wrought for Freedom” বইতে “ভারতের স্বাধীনতা ভারতের নারীবাদকে উন্নীত করবে” এমন প্রতীক হিসাবে দিয়েছিলেন।
কাদম্বিনী ইংল্যান্ডে গিয়ে আরও পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সব বাধাকে অতিক্রম করে এই বাঙালি মহিলা তার বাচ্চাদেরকে তার বড় বোনের কাছে দেখাশোনার ভার দিয়ে ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।
তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও দ্বারকানাথের সমর্থন তাকে অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিলো। লন্ডনে তার মামাতো ভাই ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের সহায়তায় কাদম্বিনী এডিনবার্গের স্কটিশ কলেজে মেডিকেল সায়েন্সে ট্রিপল ডিপ্লোমা কোর্সে অংশ নেন। যেহেতু তিনি ইতিমধ্যে সিইউ থেকে বিএ ডিগ্রি এবং সিএমসি থেকে জিএমসিবি ডিগ্রি পেয়েছিলেন তাই তিনি খুব অল্প সময়ে তার ট্রিপল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছিলেন এবং তিনি শুধুমাত্র ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
সে বছর ১৪ জন সফল প্রার্থীর মধ্যে তিনিই একমাত্র মহিলা এবং বিরল কীর্তি অর্জনকারী প্রথম ভারতীয় বাঙালি মহিলা। তিনি প্যাডিয়াট্রিক্স এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞেরও বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
কিন্তু তার এমএ ডিগ্রি না থাকায় ব্রিটিশ ডাক্তাররা তাকে ছোট নজরে দেখতে থাকে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুশীলন শুরু করেছিলেন কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন। তাকে ডাক্তার হিসেবে না দেখে সাধারণ ধাত্রী হিসেবেই দেখা হতো। একটা ঘটনা এমন ছিলো, তিনি ও তার সহকারী এক ধনী বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদেরকে ঘরে পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তাদের খাবারও বারান্দায় দেয়া হয়েছিল এবং তা তাদেরকেই পরিষ্কার করতে বলা হয়েছিল। এতেই বোঝা যায় কতটা কষ্টের ছিলেন তার ডাক্তারি জীবন।
শুধু তাই নয়। হিন্দু রক্ষনশীল পরিবারগুলো তাকে নানাভাবে অপমান করতে থাকে। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রক্ষনশীল বাংলা পত্রিকা বঙ্গবাসীতে কাদম্বিনীকে পরোক্ষ ভাবে বেশ্যা বলেছিল । কাদম্বিনী এর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং জয়ী হন। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পালকে ১০০ টাকা জরিমানা এবং ছয় মাসের জেল দেওয়া হয়।
তিনি একবার নেপালের রানীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে সুস্থ করতে সাহায্য করেছিলেন। এরপর থেকে তাকে রাজ পরিবারের চিকিৎসার জন্য ডাকা হতো। এর মাঝেই আরেকটি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল যখন পুরুষ চিকিৎসকরা একটি মেয়ের পেটে টিউমার সনাক্ত করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন মেয়েটি গর্ভবতী যা পরবর্তীতে সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ এই শিশুটিকে নিরাপদে প্রসব করাতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি।
কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা । তিনি ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক। তিনি তার স্বামীর মতোই আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন । কাদম্বিনী কবি কামিনী রায়ের সাথে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিহার এবং ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করেছিলেন।
আট সন্তানের মা হওয়ায় সংসারের জন্যও তাকে বেশ সময় দিতে হত । বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ নেয়া সত্ত্বেও তিনি তার চিকিৎসা বিদ্যাকে কখনো অবহেলা করেননি। তার দায়িত্বের সাথে কখনো আপস করেননি। কাদম্বিনী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। কিন্তু এই সমস্যাকে তিনি তার কাজের মধ্যে আসতে দেননি। ১৯৩৩ সালের ৩ অক্টোবর ৬৩ বছর বয়সী কাদম্বিনী একজন রোগীর গুরুতর অপারেশন করেছিলেন। অপারেশন শেষে বাড়িতে ফিরেও এসেছিলেন। আর সেই সন্ধ্যায় তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এভাবেই নিরলসভাবে কাজ করতে করতেই চলে গিয়েছিলেন বাংলার এই মহিয়সী নারী, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ তার একটি লেখায় লিখেছিলেন, “গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বিনী ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে সফল এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। সেইসময়ের বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি এগিয়ে ছিলেন। সব বাধা অতিক্রম করে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তাঁর এই ক্ষমতা তাঁকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে। ” তিনি কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথের সম্পর্ক নিয়ে বলেছিলেন, “এটি আসলে পারস্পরিক ভালবাসা, সংবেদনশীলতা এবং বুদ্ধিভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবচেয়ে অস্বাভাবিক সম্পর্ক।”