১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামের সাক্ষী, লালবাগ কেল্লা
১৮৫৭ সালে মঙ্গল পান্ডের মাধ্যমে মিরাটে স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো। যার ছোঁয়া সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও প্রথম সংগ্রাম সফলতার মুখে দেখেনি, কিন্তু তারপর থেকেই ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিলো তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। বাণিজ্য করতে এসে ইংরেজরা হাতে নিয়ে নেয় রাজদণ্ড। শুরু হয় শোষণ ও নিপীড়ণের নতুন অধ্যায়। এবং এই রাজ্য দখলের পর থেকে একটার পর একটা বিদ্রোহ ঘটতেই থাকে। তার মধ্যে ফকির আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সাঁওতাল বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, পাগলপন্থী, বিষ্ণুপুর বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। এই ছোট ছোট বিদ্রোহগুলো পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের দ্বার উন্মোচন করে, যা দাবানলের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকায় অবস্থিত ইংরেজ, ডাচ, আর্মেনিয়ানরা তখন কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করলো। অতি সচেতন হয়ে তারা পাহারা আরও বাড়িয়ে দিলো। যেকোনো মুহূর্তে ঢাকায় বিদ্রোহ হতে পারে ভেবে, তারা জলপাইগুড়ি থেকে সৈন্য এনে ঢাকাকে পাহারা দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। এই সময় শহরে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে থাকলো। যেমন: ব্রাম্মন রুটিয়ালাকে পেটানোর অপরাধে এক সিপাহীকে জরিমানা করা হয়েছিল। যখন ইংরেজ সৈন্য ঢাকায় আসে, সিপাহীর পোশাক পরা কিছু লোক কয়েকজন সৈন্যকে পেটায়। এতে করে শহরের পরিবেশ আরও থমথমে হয়ে ওঠে। এবং এই কারণেই নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই তারা লালবাগে অবস্থিত সিপাহীদের নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলো।
২২ নভেম্বর ১৮৫৭ এর ভোরের আগেই নির্দেশ মতোই কমিশনার, জজ, কিছু সিভিলিয়ান ও ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক সম্ভবত ঢাকা কলেজের কাছে জড়ো হয়। লে. লুইস, লে. ডডওয়েল ও উইলিয়াম ম্যাকফার্সন লালবাগের দিকে এগিয়ে যান। অন্যদিকে, লে. রিন্ড, ফারবেশ আরও অনেকে রওনা হন কোষাগারের দিকে সিপাহীদের নিরস্ত্র করতে। সেই সময় ১৫ জন সিপাহী তোপখানার পাহারায় ছিল। যাদের বেশিরভাগই তখন ঘুমিয়ে ছিল।
সিপাহীদের যখন নিরস্ত্র করা হচ্ছিলো তখনি লালবাগ থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইংরেজ স্বেচ্ছাসেবকরা এই আওয়াজে ভয় পেয়ে যায়। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তোপখানার সিপাহীরা পালিয়ে যায়।
নৌসেনারা যখন লালবাগ যায় সেখানে দেখে সিপাহীরা ততক্ষনে প্রস্তুত হয়েই ছিল। হয়তো তারা আগে থেকে কিছু ধারণা করতে পেরেছিলো। দেশি সিপাহীরা এই ধরণের কোনো আক্রমণ আসা করেনি। তারা সকলেই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলো। গোলাগুলির আওয়াজে অবাক হলেও তাদের কাছে থাকা দশ রাউন্ড গুলি দিয়ে তারা প্রতিউত্তর দিচ্ছিলো। তাদের মধ্যে একজন পাঞ্জাবি মহিলা ক্রমাগতভাবে পরি বিবির মাজার থেকে আত্মরক্ষার জন্য গুলি ছুড়ছিলো।
লালবাগের অস্ত্রাগারের চাবি ছিল সুবেদারের কাছে। সিপাহীদের ও সুবেদারের স্ত্রীর অনুরোধের পরও যখন তিনি চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানান তখন সিপাহীরা তাকে হত্যা করে চাবি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ইংরেজরা ততক্ষনে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। পরীবিবির মাজারের সামনে বসানো কামান দিয়ে সিপাহীরা ইংরেজদের বাধা দিচ্ছিলো। অস্ত্রের অভাবে আত্মসমর্পণ করলেও ইংরেজরা তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। কিছু সিপাহীর লাশ ফেলা হয় দুর্গের পশ্চিম দিকের পুকুরে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় অনেক সিপাহীকে। সংঘর্ষের সময় কিছু সিপাহী পালিয়ে গিয়েছিলো। ২০ জন সিপাহীকে গ্রেফতার করা হয় যাদের মধ্যে সুবেদারের স্ত্রীও ছিল। ২০ জনের মধ্যে ১১ জনকে ফাঁসি দেয়া হয় চকবাজার ও আন্টাঘর ময়দানে, যা বর্তমানে বাহাদুর সাহ পার্ক নামে পরিচিত (পাঞ্জাবি মহিলা সিপাহীকেও আন্টাঘরে ফাঁসি দেয়া হয়।)। ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সলিমুল্লাহ এতিমখানার দক্ষিণে কবর দেয়া হয়, এটি একসময় ‘গোরে শহীদ মহল্লা’ নামে পরিচিত ছিল। পালিয়ে যাওয়া সিপাহীদের যারা ধরা পড়েছিল তাদেরকে এক গির্জার ফাঁকা জায়গায় তৈরী ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল।
উত্তর ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের যে সূত্রপাত ঘটে তার সম্পূর্ণ প্রভাব ঢাকায় এসে পড়েনি। ঢাকায় তখন শিখ এবং পাঠান মিলে মোট ২৬০ জন সিপাহী ছিল। তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতো না। বাংলাদেশে একমাত্র চট্রগ্রামে সিপাহীরা সংগ্রাম করেছিল। ঢাকার সিপাহীরা শুধু উত্তেজিত হয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিলো এরকম কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু সেটা যে এতো জলদি, তা তারা বুঝতে পারেনি। ইংরেজদের অতি আতংকের কারণেই তারা এই আক্রমণ করেছিল। সরকারি তথ্যমতে, লালবাগে ৪১ জন সিপাহী ও ৩ জন ইংরেজ নৌসেনা নিহত হন।
আসলে কেন এই সংগ্রাম সফল হয়নি? তখন ইংরেজদের সাথে শুধু জমিদার বা ধনীরা নয়, মধ্যবিত্তদের কেউ কেউ হাত মিলিয়ে ছিল। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইংরেজ সরকারকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের কোনো উপায়ও ছিলোনা। সিপাহীদের হেরে যাওয়ার খবর ছিল তাদের জন্য আনন্দের। যে আন্টাঘর ময়দানে সিপাহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল, সাধারণ মানুষ অনেকদিন সেই জায়গায় যেতে ভয় পেতো। তৈফুর বলেছেন, লালবাগের যে পুকুরে সিপাহীদের লাশ ফেলা হয়েছিল, সেই জায়গায় এক ধরণের ভৌতিক পরিবেশ তৈরী হয়েছিল। অনেকেই নাকি সেই জায়গায় থেকে, ‘ভাই পানি’ , ‘ভাই পানি’ বলে চিৎকার শুনতে পেতো। হয়তো তৃষ্ণার্ত মৃত সিপাহীর আত্মা সাধারণ মানুষের কাছে একটু পানি চেয়ে আকুতি জানাতো। এগুলো সবই গল্প। কিন্তু এই গল্পগুলোই অনেকদিন মানুষের মনে দাগ কেটেছিল।
সুতরাং আমাদের এই লালবাগ কেল্লা শুধু মোঘল স্থাপনা নয়, পরি বিবির মাজার নয়, আমাদের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মাহুতি দেয়া বীর শহীদদের আত্মত্যাগের শহীদ মিনার। এই শহীদদেরও আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। ১৯৭১ এর আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তার পেছনে এই শহীদদেরও অবদান অপরিসীম।