নেপোলিয়ন এবং তার প্রথম স্ত্রী জোসেফাইনের বহুল আলোচিত প্রেমের গল্প ফরাসি দেশ তথা সমগ্র বিশ্বেই বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল। আজকে বলবো নেপোলিয়ন এবং তার স্ত্রীর জীবনের সাথে ভারতবর্ষের কিছু ঐতিহ্যেবাহী পণ্য কিভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিভাবে তাদের রোমাঞ্চের সাথে ভারতের কাশ্মীর যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। সূক্ষ্ম পশমিনা শাল জোসেফাইনের খুব পছন্দ ছিল। তাই নেপোলিয়ন প্রায়ই তাকে এই শাল উপহার হিসেবে পাঠাতেন। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন মিশর অভিযানের সময় তিনি এই শাল গুলোর সাথে পরিচিত হন। এক বাক্স শাল তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। তারপর সেগুলোকে তিনি সংগ্রহ করে জোসেফাইনকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শালগুলো প্রচন্ডভাবে জোসেফাইনকে আপ্লূত করে তুলেছিল। তিনি ভীষণ পছন্দ করেছিলেন শালগুলো এবং ব্যক্তিগতভাবে এটাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। তার পরে ইউরোপের ফ্যাশনের জগতের এক উপাদান হিসেবে শালগুলো ব্যবহার করা শুরু হয়।
হিমালয় পাহাড়ে অবস্থিত এক বিশেষ ধরনের স্বতন্ত্র জাতের ছাগলের পশম দিয়ে শালগুলো তৈরি হতো। এই পশমিনা শব্দটি পশম শব্দ থেকেই এসেছে। ফার্সি ভাষায় এটাকে উল বলা হতো। হাজার হাজার বছর ধরে কাশ্মীরের শিল্পীরা এই সুক্ষ্ম শাল তৈরি করে যাচ্ছিল। তবে ১৫ শতকে কাশ্মীরের শাসক সুলতান জয়ন উল আবদিনের (১৪১৮-১৪৭০ খ্রিস্টাব্দ) অধিনে এটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বলা ভালো এখানেও মোঘল সম্রাটদের অবদান রয়েছে। ১৭ শতকের আগে পশমিনার উলগুলো রঙিন ছিল না। শালগুলি বেশিরভাগ সাদা, কালো, বাদামী বা ধূসর রঙের হতো। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে শাল গুলোকে আরও ফ্যাশনেবল করে তোলা হয়। সম্রাট আকবর এই পশমিনা শালের উপরে সূচিকর্মের প্রচলন করেন। এই ধরনের কারুকাজ করা শাল তৈরি করতে তখন প্রায় ৬ মাস লেগে যেত। অত্যন্ত দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী না হলে এ শালগুলি তৈরি করা খুব কঠিন হত। আর এই অমূল্য শালগুলো মোঘল দরবারের উচ্চপদস্থ সদস্যদের উপহার হিসেবে সম্রাট প্রদান করতেন। সময় যেতে থাকে। একটা পর্যায়ে পশমিনা শালগুলো পারস্য, অটোমান সাম্রাজ্য এবং খেদিভেট মিশরের অন্যান্য ইসলামিক অঞ্চলের খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। গল্প আছে নেপোলিয়ন যখন ১৭৯৮ সালে মিশর রাজ্যকে আক্রমণ করেছিল তখন তিনি এই শাল পূর্ণ একটি বাক্স পেয়েছিলেন। এবং তিনি তার প্রিয় স্ত্রী জোসেফাইনকে সেই শালগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিল। জোসেফাইন শালগুলো এতই পছন্দ করেছিলেন যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি এগুলো পড়তে শুরু করলেন। শীঘ্রই প্যারিসের উচ্চ সমাজে ফ্যাশনেবল মহিলারা জোসেফাইনের এই শাল প্রীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরাও পশমিনাকে পড়তে শুরু করলো। তাদের ফ্যাশনেবল পোশাক গুলোকে আরও ফ্যাশনেবল করে তুলেছিল এই শালগুলো। আর এই ৪ কোনা শালগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হত যাতে পড়ার সময় নকশাগুলো সারিবদ্ধভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠতো। বিয়ের উপহার হিসেবেও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই শালগুলো।
জোসেফাইনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শালের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল। এই শালগুলো পড়া অবস্থায় তার প্রচুর ছবি আঁকা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে কাশ্মীরের এই পশমিনাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। আজও পশমিনা স্কার্ফ এবং স্টোলগুলো তাদের সূক্ষ্মতা এবং কমনীয়তার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই শালই একবার জোসেফাইনের উপরে হত্যার আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছিল। কোন একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে জোসেফাইন শালটি যখন পড়েছিল তখন তার ভাজগুলো সঠিক হয়নি বলে, যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে জোসেফাইনকে তার শাল গুলো ঠিক করে দিচ্ছিল জেনারেল রেপ। কিন্তু এটি করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছিল বলে নেপোলিয়ন আগেই চলে গিয়েছিল। এবং দুটি গাড়ির মধ্যে ব্যবধানটা বেড়ে গিয়েছিল। ঠিক তখনি এক বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে থমকে গিয়েছিল পথচারীরা। কোন একজন আততায়ী তাদেরকে হত্যা করতে চেয়েছিল যা নাকি এই শাল টিকে ঠিক করতে গিয়ে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে জোসেফাইনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।