বাংলায় মোঘল আমলের তৈরী যতগুলো স্থাপনা আছে তার মধ্যে সব চেয়ে আকর্ষণীয় হলো লালবাগ কেল্লা। ১৬৭৮ সালে সুবেদার ফেদির মৃত্যুর পর বাদশাহ আওরাঙ্গজেব তার পুত্র বিহারের শাসনকর্তা যুবরাজ আজম শাহ্কে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন এবং রাজকার্যের সুবিধার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেন। কারণ, এই বাংলা থেকে তখন ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অর্থ কর হিসেবে যেত দিল্লীতে। ঢাকায় এসেই আজম শাহ লালবাগ কেল্লার কাজ শুরু করেন।
আমরা এখন যে লালবাগ কেল্লা দেখছি , সেখানেই আছে শায়েস্তা খানের মেয়ে পরি বিবির সমাধি। আজম শাহ ঢাকা ত্যাগ করার সময় শায়েস্তা খানকে এই লালবাগ কেল্লার কাজ শেষ করার দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু এই কেল্লাকে অনেকটা অশুভ মনে করে শায়েস্তা খান এর কাজ সম্পূর্ণ করেননি। কারণ, শায়েস্তা খানের মেয়ে ইরান দুখত বা পরি বিবির সাথে যুবরাজ আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল এবং এই কেল্লা নির্মাণ কালেই তার মেয়ে অকালে মারা যায়।
ইতিহাসবিদ টেলরের ধারণা মতে, পরি বিবির সাথে আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল। অন্যদিকে, লর্ড কানিংহ্যামের মতে পরি বিবি মৃত্যুর আগে কুমারী ছিলেন। তিনি মারা যান ১৬৮৪ সালে, যখন তার বাবা শায়েস্তা খান বাংলার শাসক ছিলেন।
এদিকে আজম শাহ ঢাকা ত্যাগ করেন ১৬৭৯ সালে। তিনি ঢাকায় ছিলেন মাত্র ১ বছরের মত। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, পরি বিবির সাথে আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল তাহলে তা কিভাবে? শায়েস্তা খান ছিলেন বাদশাহ আওরাঙ্গজেবের মামা। সেই সম্পর্ককে টানলে পরি বিবি ছিলেন যুবরাজ আজম শাহের ফুপু। আমরা জানি যে, মোঘল আমলে বংশ দেখে বিয়ে দেয়া হতো। তাহলে এই রকম সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কি বিয়ে হয়েছিল? তাছাড়া, তখন একজন যুবরাজ বাদশার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারতো না। তারপরও যদি হয়েও থাকে, তাহলে যুবরাজ নববিবাহিতা স্ত্রীকে একা ফেলে কেন চলে যাবেন?
সাধারণত অবিবাহিতা মেয়েরা বাবা মায়ের কাছেই থাকে। কিন্তু সেই সময় শায়েস্তা খান সপরিবারে দিল্লী অথবা আগ্রায় ছিলেন। তাহলে পরি বিবি কোথায় ছিলেন ? আর এই অল্প সময়ে ঢাকায় থাকাকালীন বিয়েটাই বা কবে করলেন যুবরাজ?
ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ডসের বিবরণ থেকে জানা যায়, যুবরাজ যখন ঢাকা ত্যাগ করেন তখন তার সাথে শুধু তার ছেলে বিদার বখ্ত ছিল। কোনো স্ত্রীর কথা উল্লেখ ছিল না। সুতরাং, আমরা এটা বলতেই পারি, শায়েস্তা খানের মেয়ে পরি বিবির সাথে যুবরাজ আজম শাহের বিয়ে হয়নি এবং ইতিহাসেও এই বিয়ের পক্ষে কোনো প্রমান নেই।
আজম শাহ এর স্ত্রী ছিলেন চারজন। তার মধ্যে গৌহাটি রাজ্যের বৌদ্ধ রাজকন্যা রামানি গভারু ছিলেন একজন। গৌহাটি জয় করার সময় সুবেদার মীর জুমলা এই রাজকন্যাকে নিয়ে আসেন আওরাঙ্গজেবের হারেমে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বাদশাহ তার নিজের পুত্র আজম শাহের সাথে তার বিয়ে দেন। ধর্মান্তরিত করার পর তার নাম দেয়া হয় রহমাত বানু বেগম। আজম শাহ যখন ঢাকায় আসেন তখন তার সাথে রহমাত বানু বেগমও ছিলেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী ও রাজকুমারের প্রিয় স্ত্রী। অত্যন্ত সুন্দরী হওয়ার কারণে তাকে পরির সাথে তুলনা করা হতো। কিন্তু যুবরাজ ঢাকা ত্যাগ করার পর তার কথা আর শোনা যায়নি। ইতিহাসবিদ তৈফুরের মতে, এই রহমাত বানু বেগমই আসলে পরি বিবি। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় রহমাত বানু মারা যান। বলা হয়, লালবাগ কেল্লার এই সমাধিটি আসলে রাহমাত বানু বেগমের এবং পাশের ছোট সমাধিটি তার মেয়ে সন্তানের।
আসলে লালবাগ কেল্লায় যিনি ঘুমিয়ে আছেন কে তিনি? কোন পরি বিবি? পরি বিবির এই রহস্য সমাধান করতে হলে আমাদের আরও জানতে হবে। উল্টাতে হবে ইতিহাসের আরও কয়েকটা পাতা।
বিঃ দ্রঃ ১। আজম শাহের ঢাকায় অবস্থানের সময়কাল – ১৬৭৮ -১৬৭৯
২। পরি বিবির মৃত্যুর সময়কাল – ১৬৮৪ (লর্ড কানিংহ্যাম), ১৬৭৮ – ১৬৭৯ (সৈয়দ আলবাদ হোসেন)