সত্যিই কি শায়েস্তা খানের মেয়ে পরি বিবির সাথে যুবরাজ আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল?
ইতিহাসবিদ টেলরের মতে, পরি বিবির সাথে আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল। অন্যদিকে, কানিংহ্যামের মতে, মৃত্যুর আগে পরি বিবি কুমারী ছিলেন। তিনি মারা যান ১৬৮৪ সালে, যখন তার বাবা শায়েস্তা খান বাংলার শাসক ছিলেন।
জানা যায়, ১৬৭৮ সালের ৩০ শে জুন ঢাকার শাসনকর্তা ফেদি খাঁর মৃত্যুর পর বাদশাহ আওরাঙ্গজেব তার পুত্র বিহারের শাসনকর্তা যুবরাজ আজম শাহ্কে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন । বাংলা ছিল মোঘলদের অত্যন্ত সম্মৃদ্ধশালী সুবাহ । এই বাংলা থেকেই সর্বোচ্চ পরিমাণ কর দিল্লীতে যেত। বাংলা ছিল সবচেয়ে বেশি কর প্রদানকারী প্রদেশ। তাই আওরঙ্গজেব নিজ সন্তানকে বাংলায় শাসন করতে পাঠান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকায় লালবাগ প্রাসাদ-দুর্গ নির্মাণ করতে নির্দেশ দেন। বাংলায় মোঘল আমলের তৈরী যতগুলো স্থাপনা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো লালবাগ কেল্লা।
জিজিয়া কর এবং মন্দির ধ্বংস নিয়ে আওরাঙ্গজেবের সাথে রাজপুতদের যুদ্ধ শুরু হলে আজম শাহকে আওরাঙ্গজেব দিল্লিতে ফিরে যাবার আদেশ দেন। আজম শাহ ১৪ আগস্ট, ১৬৭৯ সালে ঢাকা ত্যাগ করে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আজম শাহ ঢাকা ত্যাগ করার সময় শায়েস্তা খানকে এই লালবাগ কেল্লার কাজ শেষ করার দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু এই কেল্লাকে অনেকটা অশুভ মনে করে শায়েস্তা খান এর কাজ সম্পূর্ণ করেননি। কারণ, শায়েস্তা খানের মেয়ে ইরান দুখত বা পরি বিবির সাথে যুবরাজ আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল। এই কেল্লা নির্মাণ কালেই তার মেয়ে অকালে মারা যায় এবং এই লালবাগ কেল্লাতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তবে শায়েস্তা খানের মেয়ে পরি বিবির সাথে আজম শাহের্ বিয়ে হয়েছিল কিনা তাই নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক মতভেদ।
এদিকে আজম শাহ ঢাকায় ছিলেন মাত্র ১ বছরের মত। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, পরি বিবির সাথে আজম শাহের বিয়ে হয়েছিল তাহলে কিভাবে? শায়েস্তা খান ছিলেন বাদশাহ আওরাঙ্গজেবের মামা। সেই সম্পর্ককে টানলে পরি বিবি ছিলেন যুবরাজ আজম শাহের ফুপু। আমরা জানি যে, মোঘল আমলে বংশ দেখে বিয়ে দেয়া হতো। তাহলে এই রকম সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কি বিয়ে হয়েছিল? তাছাড়া, তখন একজন যুবরাজ বাদশার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারতো না। তারপরও যদি হয়েও থাকে, তাহলে যুবরাজ নববিবাহিতা স্ত্রীকে একা ফেলে কেন চলে যাবেন?
সাধারণত অবিবাহিতা মেয়েরা বাবা মায়ের কাছেই থাকে। কিন্তু সেই সময় শায়েস্তা খান সপরিবারে দিল্লী অথবা আগ্রায় ছিলেন। তাহলে পরি বিবি কোথায় ছিলেন ? আর এই অল্প সময়ে ঢাকায় থাকাকালীন বিয়েটাই বা কবে করলেন যুবরাজ?
“Glimpses of Old Dhaka” বইতে তৈফুর বলেন শায়েস্তা খানের মেয়ের সাথে আজম শাহের বিয়ে হয়েছে তার কোনো প্রমান নেই। তাছাড়া তিনি আরও বলেন, ঢাকায় আসার আগেই তার তিনজন স্ত্রী ছিল। তিনি যখন খুব ছোট তার চাচা, দারা শিখোর মেয়ে জাহানজেব বানু বেগমকে তিনি বিয়ে করেন। তারপর ১৬৭৭ সালে গৌহাটির রাজকন্যা রোমানি গোভারু এবং সুলতান মুরাদের নাতনির সাথে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে দিল্লী গেলে তার আবার বিজাপুরের রাজকন্যা সাহার বানু বেগমের সাথে বিয়ে হয়। এই হলো তার চারজন স্ত্রীর বর্ণনা। তাহলে পরি বিবি কোথায়?
ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্টের বিবরণ থেকে জানা যায়, যুবরাজ যখন ঢাকা ত্যাগ করেন তখন তার সাথে শুধু তার ছেলে বিদার বখ্ত ছিল। কোনো স্ত্রীর কথা উল্লেখ ছিল না। সুতরাং, আমরা এটা বলতেই পারি, শায়েস্তা খানের মেয়ে পরি বিবির সাথে যুবরাজ আজম শাহের বিয়ে হয়নি এবং ইতিহাসেও এই বিয়ের পক্ষে কোনো প্রমান নেই।
আমরা আগেই বলেছি, আজম শাহ এর চারজন স্ত্রীর মধ্যে গৌহাটি রাজ্যের বৌদ্ধ রাজকন্যা রামানি গভারু ছিলেন একজন। গৌহাটি জয় করার সময় সুবেদার মীর জুমলা এই রাজকন্যাকে নিয়ে আসেন আওরাঙ্গজেবের হারেমে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বাদশাহ তার নিজের পুত্র আজম শাহের সাথে তার বিয়ে দেন। ধর্মান্তরিত করার পর তার নাম দেয়া হয় রহমাত বানু বেগম। আজম শাহ যখন ঢাকায় আসেন তখন তার সাথে রহমাত বানু বেগমও ছিলেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী ও রাজকুমারের প্রিয় স্ত্রী। অত্যন্ত সুন্দরী হওয়ার কারণে তাকে পরির সাথে তুলনা করা হতো। কিন্তু যুবরাজ ঢাকা ত্যাগ করার পর তার কথা আর শোনা যায়নি। ইতিহাসবিদ তৈফুরের মতে, এই রহমাত বানু বেগমই আসলে পরি বিবি। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় রহমাত বানু মারা যান। মনে করা হয়, হয়তো লালবাগ কেল্লার এই সমাধিটি আসলে রাহমাত বানু বেগমের এবং পাশের ছোট সমাধিটি তার মেয়ে সন্তানের।
আসলে লালবাগ কেল্লায় যিনি ঘুমিয়ে আছেন কে তিনি? কোন পরি বিবি?
এই সম্পর্কে ইতিহাসের বইয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নেই। আমাদের কাজ হবে বহু দিনের এই ভুল ধারণা গুলোকে সংশোধন করা এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত করা। সেই সময় ইতিহাসের বেশিরভাগ বই লিখা হতো আরবি বা ফার্সি ভাষায়। সেই বই গুলোকে যথার্থভাবে অনুবাদ করে পরি বিবির সমাধি সংক্রান্ত সত্যতা উৎঘাটনের দায়িত্ব বর্তমান ইতিহাসবিদদের।

ক্লিওপেট্রা: আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকার ও টলেমি রাজবংশের শেষ অধ্যায়

ক্লিওপেট্রা কিন্তু সরাসরি আলেকজান্ডারের বংশধর ছিলেন না। তবে আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত সেনাপতি টলেমি (I)-এর সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল। টলেমি ছিলেন ম্যাসিডোনিয়ার অধিবাসী। সে দিক থেকে ক্লিওপেট্রাকে মেসিডোনিয়ার ক্লিওপেট্রা বলা যেতে পারে। আমরা জানি, টলেমি রাজবংশের শেষ...

কনিষ্কের ব্রোঞ্জের বাক্স: পেশোয়ার স্তূপ থেকে আবিষ্কৃত বুদ্ধের দেহাবশেষের ইতিহাস

আকারে অতি ক্ষুদ্র, মাত্র ১৯ সেন্টিমিটার লম্বা আর ১০ সেন্টিমিটার চওড়া এই ছোট্ট ব্রোঞ্জের বাক্সটি হাতে ধরে রাখা যায় খুব সহজেই। অথচ এই ক্ষুদ্র মঞ্জুষার মধ্যে লুকানো ছিল গৌতম বুদ্ধের অমূল্য দেহাবশেষ—এক অসাধারণ ঐতিহ্য, যা সময়ের বিবর্ণতার মাঝেও অম্লান। বাক্সটি যেখানে...

অভিশপ্ত রাজকুমারীর কবর: লি জিংসুন ও চীনের রহস্যময় সমাধি

অনেক অনেক বছর আগে, চীনের এক অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি ঘিরে জন্ম নেয় অজস্র কাহিনি। মানুষ বিশ্বাস করত—মৃত্যু মানেই সবকিছুর শেষ নয়। এক নতুন জীবন শুরু হয় আরেক জগতে। তাই মৃতদের সমাধিতে রেখে দেওয়া হতো দামী জিনিসপত্র, যেন পরকালেও রাজকীয়ভাবে বেঁচে থাকতে পারেন তাঁরা। কিন্তু এই...

কপিলাবস্তুর সন্ধান: গৌতম বুদ্ধের হারানো ইতিহাস যেভাবে উদ্ধার করেন বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব শুধু ভারতবর্ষেই নন, সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয় ইতিহাসকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন। তিনি বদলে দিয়েছিলেন মানুষের চিন্তাধারা, ভাবনা ও দর্শনকে। শাক্য রাজপরিবারের রাজপুত্র তিনি। কিন্তু রাজপ্রাসাদে তাঁর মন টিকল না। একদিন রাজত্ব ও কপিলাবস্তুর নগর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের...

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...