তাজমহল বিক্রির আসল রহস্য কি??
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আগ্রার মুসলিম ঐতিহ্য তাজমহল ভাঙার চিন্তা করেছিল! অদ্ভুৎ শোনা গেলেও, ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক তাজমহল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। সত্যিই কি তাজমহল বিক্রি হয়েছিল? নাকি ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিকের নামে নিন্দুকেরা মিথ্যা দোষারোপ করেছিল? আসুন জানা যাক সে কাহিনি।
সম্প্রতি, সেই ১৮৩০ সালের চাঞ্চল্যকর কাহিনীর সুরাহা করতে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট হিস্টরি বিভাগের অধ্যাপক কবিতা সিং গত কয়েক বছর ধরে ভারত ও ব্রিটেনে বহু সেমিনারে তথ্য প্রমাণসহ তাজমহল বিক্রির নেপথ্যের কাহিনি তুলে ধরেন। বিশ্বের সপ্তমাশ্বার্চযের একটি ভারতের আগ্রার মোঘল আমলে নির্মিত স¤্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমের নিদর্শন মমতাজ মহলের সমাধি তাজমহল। যা প্রত্যেকবারই নতুন আশ্বর্য ও বিস্ময় মনে হয়। যার নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে এবং শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। উস্তাদ আহমেদ লাহুরি তাজমহলের প্রধান নকশাকার। যেখানে তিনি নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য সন্মিলন ব্যবহার করেছেন। জানা যায়, তাজমহল বিক্রির আসল রহস্য তাজমহল নয়, ‘আগ্রা ফোর্ট’ থেকে শুরু –
প্রথমে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক আগ্রা ফোর্টের ভেতরের ‘দিওয়ান এ-খাস’, ও হাম্মামখানার বিভিন্ন জিনিসপত্র নিলামে তুলে লন্ডনে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে আপনি ‘দিওয়ান এ-খাস’ এর ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখবেন যে, শাহী হাম্মামখানার ভেতরের অংশের একপাশের দেয়ালে সাদা চুনকাম করা যা মোঘল স্থাপত্যের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। এমনকি, সেখানে দুটি দরজা নতুন সংযোজন বলে প্রতীয়মান হয়। আগ্রা ফোর্টের মার্বেল বিক্রির ঘটনা ছিল পরীক্ষামূলক। তারপর তিনি তাজমহল বিক্রির মহাপরিকল্পনা করেন। কিন্তু সম্পূর্ণ তাজমহল নিলামে তোলা হলে ৫০০ ডলারের বেশি না উঠায় সেই যাত্রায় তাজমহল ব্রিটিশদের লোভাতুর চক্ষু থেকে রক্ষা পায়। অবশ্য লর্ড বেন্টিকের বন্ধুরা ও সকল ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা এসবকে পুরোপুরি মিথ্যা অপপ্রচার এবং এর কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু আজও লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে আগ্রা ফোর্টের অলংকৃত কলাম প্রদর্শিত হচ্ছে। অথচ ইংরেজ রাজনীতিবিদ মার্কুস বেরেসফোর্ড, তাঁর ‘জার্নাল অব মাই লাইফ ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে এবং ইংরেজ প্রশাসক স্যার উইলিয়াম সিলিম্যান তাঁর বিখ্যাত আতœজীবনীতে তাজমহল ও আগ্রা ফোর্টের মার্বেল বিক্রির উল্লেখ করেছেন। বেরেসফোর্ড বলেন – ‘যে শ্বেত মার্বেলগুলো লন্ডনে নেয়া হয়েছিল সেগুলো তাদের আধুনিক ভবনের সাথে খাপ খাই না, বিধায় পাথরগুলোকে পেপার ওয়েট ও কোন কোন ক্ষেত্রে তরকারী কাটার পাথর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর বেন্টিকের পাঠানো তাজ বিক্রির প্রস্তাবনার কপি কমান্ডার স্যার এইচ ফেনের কাছে ছিল।’
এছাড়া ‘ফানি পার্কস’ ভ্রমনবৃত্তান্তে এ বিষয়ে লেখা আছে। এমনকি ১৮৩১ সালের ২৬ জুলাই ‘জন বুল’ নামক (পরবর্তীতে দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকা) সংবাদপত্রে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে আশ্বর্যজনক ঘটনা হলো, মথুরার শেঠ লক্ষœীচাঁদ জৈন নিলামে প্রস্তাবিত মূল্য ২ লাখ রুপির ডাকও দিয়েছিলেন এবং ২য় বার নিলাম উঠলে তিনি ৭ লাখ প্রস্তাব করেছিলেন। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় তাজমহল বিক্রির নিলামের সে সংবাদ ঘটা করে প্রকাশও করা হয়েছিল।
দুনিয়ার সামনে নতুন করে এই বিতর্ক আবার নিয়ে আসেন লক্ষœীচাঁদ জৈন এর বংশধর বিজয় কুমার জৈন ২০০৫ সালে “মথুরা শেঠ” নামক একটি বই প্রকাশ করে। যেখানে তিনি এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। যাইহোক, ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক তাজমহল বিক্রি করার যে হাস্যকর ও একইসাথে ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয় তা তাকে বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বোকা হিসেবে পরিচিত করেছে। আসলে, উইলিয়াম বেন্টিক, ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তাকে কোম্পানীর আর্থিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যালান্স করার উদ্দেশ্যে নিয়োগ দেয়া হয়। কারণ বার্মার সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধের সময় তাদের প্রচুর অর্থ ব্যায় হয় ফলে অর্থাভাব দেখা দেয়। যাইহোক, নিলামে বেশি মূল্য না উঠায় এবং সাম্প্রদায়িকতার সংঘর্সের ভয়ে সে যাত্রাই সম্রাট শাহজাহানের অমরকীর্তি তাজমহল রক্ষা পায়, যা আজও জাজ্বল্যমান। তাজমহল বিশ্বের সপ্তমাশ্বার্চযের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত।