পলাশী যুদ্ধের খলনায়ক উমিচাঁদ ছিলেন নওয়াবী আমলের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। পলাশীর যুদ্ধতে নবাবের পতন হলে তাঁর সম্পত্তির চার আনা অংশ দিতে হবে বলে এক চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হন উমিচাঁদ।
এক যুবক নবাব প্রাণপণে চেষ্টা করলেন বাংলা বাঁচাতে। অপরদিকে পরিণত বয়সের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা ক্রমাগত সাহায্য করে গেল ইংরেজদের। ফলাফল প্রথমে ইংরেজ বাহিনীর কলকাতা দখল এবং পরে বাংলা দখল। ২ জানুয়ারি ১৭৫৭, কলকাতা পুনর্দখল করে ইংরেজরা। এরপর পলাশির যুদ্ধে কলকাতা এবং বাংলাকে পরিপূর্ণভাবে দখলে এনেছিল ব্রিটিশরা। বিশ্বাসঘাতকতার মুলে ছিল প্রভাবশালী রায়দুর্লভ মানিকচাঁদ, জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদ।
অনেকটা পিছনে গেলে ছবিটা আরও স্পষ্ট হতে পারে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ, টমাস রো কোম্পানিকে চিঠি লিখেছিলেন, আর যাই হয়ে যাক তাদের এই কম সৈন্য নিয়ে স্থলভাগে লড়াই করা যাবে না। তিনি স্পষ্ট বলে দেন, ‘যদি লাভজনক বাণিজ্য করতে চান তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করুন আর সমুদ্রে আপনাদের কার্যক্রম সীমিত রাখুন। বিতর্ক পরিত্যাগ করে এটা নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করাই ভালো যে ভারতে স্থলযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।’
১৬৮১ সালে স্যার জোসিয়া চাইল্ড কোম্পানি পুরনো নীতি ভুলিয়ে স্থলপথে ভারত দখলের পরিকল্পনা করে। দিল্লির সম্রাটদের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ থাকলেও তাদের আসল লক্ষ্য বাংলা তথা কলকাতার দিকে ছিল। কারণ ঐতিহাসিকরা মনে করছেন, এখানে ছিল গঙ্গা নদী যা বাণিজ্যের জন্য অসাধারণ জায়গা। নবাব আলীবর্দী খাঁ পূর্ব ভারতে কোম্পানির ক্ষমতাকে দমিয়ে রেখেছিলেন। সিরাজ নবাব হওয়ার পর সেই চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা এবং বেইমানি। তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পলাশীর যুদ্ধ’ বই এমন তথ্যই দিচ্ছে। ভিতরে ভিতরে সিরাজকে ফোঁপরা করে দিয়েছিল কলকাতার প্রভাবশালী রায়দুর্লভ মানিকচাঁদ, জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদ। যদিও এদের সবার উপরে অবশ্যই আলীবর্দী খাঁর বোনের স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। যাই হোক এক এক করে সবার কথা বলা হবে Stay Curious SiS পুরো পরিবার এর সাথে l এখন বলবো উমিচাঁদের গল্প l
পলাশী ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা উমিচাঁদ ছিলেন নওয়াবী আমলের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। ভারতীয় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলায় আসেন। বিষ্ণুদাস শেঠ নামে কলকাতার এক দাদনি ব্যবসায়ী ও দালাল উমিচাঁদের মুর্শিদাবাদ যাবার ব্যয়ভার বহন করেন। পরবর্তী সময়ে আঠারো শতকের ত্রিশের দশকে তিনি কলকাতায় নিজেকে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি আলীবর্দী খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। উঁমিচাদ মূলত শোরা ও আফিম এর ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ কোম্পানিতে শোরা সরবরাহের একজন বড় ঠিকাদার।
আগে বলা হয়েছে উমিচাঁদ মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রশাসনকে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত লাভজনক শোরার ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আলীবর্দী খানের ভাই হাজী আহমদ কোম্পানি এবং সে সঙ্গে মুর্শিদাবাদের নওয়াবের নিকট উমিচাঁদের ব্যবসায়িক জামিনদার ছিলেন। বিশাল ধনসম্পদ ও অভিজাত মহলের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগের ফলে তিনি আলীবর্দী খান এবং পরবর্তীকালে সিরাজউদ্দৌলার ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজনে পরিণত হন। পলাশী ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কোম্পানি মুর্শিদাবাদ দরবারে উমিচাঁদের প্রভাবকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগায়। উমিচাঁদের মাধ্যমেই কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ দরবারের যোগাযোগ পরিচালিত হতো। উমিচাঁদ প্রথমে সিরাজউদ্দৌলার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কোম্পানির কাছে সেনাপতি ইয়ার লতিফ খানের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এ প্রস্তাব গৃহীত হয় নি। পরবর্তী সময়ে উইলিয়ম ওয়াট্স, মীরজাফর এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং উমিচাঁদ তখন মীরজাফরের অনুকূলে সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
পলাশী যুদ্ধ পরবর্তী সিরাজের পতন হলে তাকে নবাব সম্পত্তির চার আনা অংশ দিতে হবে বলে ইংরেজদের সঙ্গে এক জাল চুক্তি পত্র সই করে এই উমিচাঁদ। ইংরেজ নৌ-সেনাপতি ওয়াটস ছিলেন এই চুক্তিপত্রের প্রধান ব্যক্তি। লাল কাগজ ও সাদা কাগজে এই দুটি চুক্তিপত্রের সই হয়। পরবর্তীতে সিরাজের পতনের পরে ওয়াটস প্রদত্ত এই চুক্তি জাল বলে প্রমাণিত হয়। উমিচাঁদ নবাবের ধনরত্ন ও সম্পদ থেকে মোট ৪০ লক্ষ টাকা টাকার দাবীদার ছিলেন, যা’ বর্তমান মুদ্রামানে ৯০০ কোটি টাকার সমান। উমি চাঁদ এই জাল দলিলের জন্য সিরাজের সম্পত্তির কোন অর্থ পান নাই। এই অর্থের শোকে উমিচাঁদ বদ্ধ পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে যান। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে আকাশের দিকে মুখ করে লম্ফ দিতে দিতে সর্বদাই লাল কাগজ ও সাদা কাগজ বলে চিৎকার করে বেড়াতেন। এভাবে উমিচাঁদ চিৎকার করতে করতে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কি নিদারুণ ও দুর্বিষহ তার এই মৃত্যু।