আকাশ কালো করে সমুদ্রতীরে ভিড়লো কতগুলো জাহাজ। বিশাল তাদের আকৃতি। এ যেনো সমুদ্রের বুকে বিশাল একেকটি ভাসমান শহর। হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো তীরের মানুষেরা, মস্ত বড় দামী লাল সিল্কের পালের দিকে। হাতে আঁকা বড় বড় চোখগুলো যেনো হিমদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। এ তো পৃথিবীর বুকে কোনো বিস্ময়ের চেয়ে কম কিছু নয়, যা আগে কেউ কখনো দেখে নি। সাত মাস্তুলবিশিষ্ট বিশাল বিশাল দৈত্যাকৃতির জাহাজগুলো যেনো ক্ষমতা ও আভিজাত্যের জ্বলন্ত প্রতীক। আর সবচেয়ে বড় জাহাজটিতে সগর্বে দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করছেন একজন সুউচ্চ ও সুদর্শন অ্যাডমিরাল। তার নাম ঝেং-হে।

অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌ-অভিযানের মানচিত্র। ছবি: সংগৃহীত

বহুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখা চীন এবার আবারো সদর্পে পা বাড়াচ্ছে বাণিজ্য করবার জন্য। আসলে চীন তো সব কালেই ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেই ছিলো। আজ থেকে ৬০০ বছর আগেও ছিলো একই চিত্র। বলছি চীনের একজন মুসলমান খোঁজা অ্যাডমিরালের গল্প, যিনি ভেসে বেড়িয়েছিলেন সমুদ্র থেকে সমুদ্রে। তার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ও যোগ্যতাবল আজও একটি রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। অ্যাডমিরাল ঝেং-হে ছিলেন একজন সর্বোচ্চ সফল প্রধান নৌসেনাপতি। আর তখন চলছিলো আবিষ্কারের যুগ। সেই আবিষ্কারের যুগে দেখিয়েছিলেন তিনি তার অসাধারণ প্রতিভা। ১৪২১ সালে ঝেং-হের মাধ্যমে চীন নেমেছিলো পৃথিবীকে জয় করবার নেশায়, কিন্তু মত্ত হতে পারে নি। চাইলে অবশ্য তাও সম্ভব করতে পারতো চীন, কলম্বাসের ১০০ বছর আগেই করতে পারতো আমেরিকা আবিষ্কার।

চেং হো, ছবি: সংগৃহীত

১৩৭১ সাল। ইউনান প্রদেশে চীনের মুসলিম ‘হুই’ বংশে জন্মগ্রহণ করে শিশু মা-হা বা সান-পাও। আর দশটা শিশুর মতো সেও বেড়ে উঠছিলো স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তার জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো এলো একটি দিন। তার বয়স তখন ১১ বছর। চীনে সে সময় মিং সাম্রাজ্য (১৩৬৮-১৬৪৪ সাল) তার শাসন পরিচালনা করছে। মিং সৈন্য আক্রমণ করে বসলো ইউনান প্রদেশ, দখলও করে নিলো। ১১ বছরের মা-হাকে মিং রাজধানী নানজিং এর রাজদরবারে নিয়োগ দেয়া হলো।

চীনের রাজদরবারে একটি ভয়ানক ও নৃশংস নিয়ম প্রচলিত ছিলো প্রাচীনকালে। হারেমের হাজারখানেক নারী ও রাজপরিবারের অন্যান্য নারীদেরকে বিশুদ্ধ রাখবার উদ্দেশ্যে এবং রাজার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ থাকবার জন্য রাজদরবারে কর্মরত সকল পুরুষকে বিপজ্জনক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খোঁজা বানানো হতো। এই নিষ্ঠুর নিয়ম পালন করতে গিয়ে অগণিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর যারা বেঁচে গিয়েছে, তাদেরই একজন হলো সেই মা-হা। হ্যাঁ, ১৩ বছর বয়স হবার পরই ভাগ্যের নির্মমতায় খোঁজা বানানো হয় তাকে।

রেমে প্রচুর রক্ষিতা রাখা হতো; ছবি: সংগৃহীত

তবে মা-হার গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং এর শুরুই হয়েছে তাকে নপুংসক করবার পর থেকে। মা-হাকে প্রথম মিং সম্রাটের চতুর্থ ছেলে ঝু-ডির খেদমতে নিযুক্ত করা হয়। মা-হা এবং ঝু-ডির সম্পর্ক দাস এবং মনিবের হলেও তাদের মাঝে তৈরী হয়েছিলো এক অদ্ভূত স্নেহের ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তৈরী হয়েছিলো সৌহার্দ্য ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের জের ধরেই মা-হার জীবন সম্পূর্ণরূপে বদলে গিয়েছিলো।

১৪০২ সাল। ঝু-ডি নিজের ভাইয়ের ছেলেকে সরিয়ে মিং সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নেন, গ্রহণ করেন ‘ইয়ংলে’ পদবী, যার অর্থ ‘শাশ্বত আনন্দ’। সম্রাট হবার পর তিনি সমস্ত বিদ্রোহী এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহীদেরকে কঠোরভাবে দমন করেন। মিং সম্রাট হবার জন্য এবং বিদ্রোহীদের দমন করবার জন্য টানা তিন বছর ঝু-ডিকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন মা-হা। আর এ কারণে মা-হার প্রতি ঝু-ডি ভীষণ কৃতজ্ঞ হন। তা ছাড়া এতোদিন মা-হার সাথে থেকে তিনি তার অসাধারণ যোগ্যতার সাথে পরিচিত হয়ে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, এই ব্যক্তিই তার রাষ্ট্রকে দিবে অন্য মাত্রা। তিনি মা-হাকে নপুংসক কমিটির পরিচালক এবং নৌসেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেন। যুদ্ধের ময়দানে ‘চেংলুনবা’ নামের একটি জায়গায় মা-হার প্রিয় ঘোড়াটি মারা গিয়েছিলো। তাই উচ্চ পদে আসীন করে মা-হাকে ‘চেং-হো’ নাম দেন ঝু-ডি। আবার অনেকে এ-ও বলেন, ‘চেং’ ছিলো তার প্রিয় ঘোড়ার নাম এবং সেই ঘোড়ার নাম অনুসারেই তাকে ‘চেং-হো’ নাম দেয়া হয়। সে যা-ই হোক, পরবর্তীতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ‘চেং-হো’ এর পরিবর্তিত রূপ হিসেবে ‘ঝেং-হে’ পরিচিতি পান মা-হা।

নানচিং শহরে চেং হো-র সম্মানে জাদুঘর, ছবি: সংগৃহীত

জোর করে ক্ষমতা দখল নিশ্চিতভাবেই জনসাধারণের মনে ভীতি ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে -এমন ভাবনা থেকে সম্রাট ঝু-ডি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তিনি রাজকীয় নৌবহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিলো সমুদ্রবাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের কাছে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের নমুনা তুলে ধরা, নিজেদের ক্ষমতার রাজকীয় প্রদর্শন করা।

আদেশ দেন ঝু-ডি সাতটি বিরাট শুকনো ডক তৈরীর। প্রত্যেক ডকে তিনটি করে জাহাজ তৈরী শুরু হয়। দিন-রাত এক করে বিরামহীনভাবে কাজ করতে থাকে কর্মীরা। তিন বছরের মধ্যে তৈরী হয়ে যায় প্রায় ১৬০০ জাহাজ।

সবচেয়ে বড় জাহাজটি ছিলো আকৃতিতে বিশাল। নয়টি মাস্তুলে পালগুলো যেনো এক একটা দৈত্য। এটাকে বলা হতো ‘ট্রেজার বোট’ বা ‘গুপ্তধনের জাহাজ’। ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০০ ফুট প্রস্থের সেই জাহাজের লাল রঙা সিল্কের পালগুলো মানুষের মনে তৈরী করতো বিস্ময়। জাহাজের সামনের দিকে আঁকা ছিলো মস্ত বড় এক জোড়া চোখ। এই চোখ আঁকা হতো এক অদ্ভূত বিশ্বাসের কারণে। এমনটাই মানা হতো যে, এই চোখজোড়া দিয়েই জাহাজ তার পথ চিনে নিবে, আর দূর থেকে সতর্ক হবে আসন্ন কোনো বিপদ দেখে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগে এতো বড় জাহাজ কেউ কখনো দেখে নি। ‘জীবনের চেয়েও বিশাল’ –এমন বিশেষণই দেয়া হয়েছিলো সেই জাহাজগুলোকে।

অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌ-অভিযান, ছবি: সংগৃহীত

আসলে এতো বিশাল জাহাজ তৈরীর পেছনের মনঃস্তত্ত্ব কি ছিলো সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন আসতেই পারে, দম্ভ আর আভিজাত্য প্রদর্শন কি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো? হ্যাঁ, সময়টা আসলে তেমনই ছিলো, যে যতো বড় জাহাজের মালিক সে-ই ততো সম্মানিত।

১৪০৫ সাল। চীনের মিং সম্রাট ঝু-ডির নির্দেশে শুরু হয় প্রথম সমুদ্র অভিযান। ট্রেজার বোটগুলোসহ মোট ৩৭০টি জাহাজ রওয়ানা হয়েছিলো সেই সমুদ্রযাত্রায়। সম্রাট সবচেয়ে যোগ্য অ্যাডমিরাল হিসেবে ঝেং-হেকেই বেছে নিলেন, দিলেন নেতৃত্বদানের সুযোগ। সম্রাটের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো তার ওপর। অসংখ্য মিলিটারি ক্যাম্পেইনে সম্রাটকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ঝেং-হে। শুধু তা-ই নয়, সফল ছিলেন তিনি, দিয়েছিলেন অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয়। তিনি জানতেন, ঝেং-হে –ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তার সাম্রাজ্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।

তবে শুধু ঝেং-হের যোগ্যতাই সম্রাটকে মুগ্ধ করেছে –এ কথাও পুরোপুরি ঠিক নয়। গুণ তো তার ছিলোই, তবে সেই সাথে ছিলো অসম্ভব সৌন্দর্য। সম্রাট ভীষণ গর্ব করতেন ঝেং-হের সৌন্দর্য নিয়ে। প্রায় সাত ফুট লম্বা দীর্ঘদেহী ঝেং-হে ছিলেন বলিষ্ঠ গড়ন, স্পষ্ট অবয়ব, সুপ্রশস্ত কোমর এবং পরিষ্কার ও জোরালো কন্ঠস্বরের অধিকারী। তার চলাফেরা ছিলো বাঘের মতো। মোটকথা, এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্যাকেজ ছিলেন তিনি। কেমন যেনো ক্ষমতা ও আভিজাত্যের এক পরিপূর্ণ ছাপ ছিলো তার মাঝে, একদম জীবন্ত সেই ছাপ। হয়তো ঝেং-হের বাহ্যিক সৌন্দর্যের জাঁকজমককেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন সম্রাট, সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ও আভিজাত্যের প্রকটতাকে স্পষ্ট করবার জন্য।

কুয়ানচৌ সামুদ্রিক জাদুঘরে এ চেং হো-র মূর্তি, ছবি: সংগৃহীত

ট্রেজার জাহাজের দায়িত্ব নেবার পক্ষে যথেষ্ট যোগ্যতা ঝেং-হের ছিলো বলেই সম্রাট তাকে সেই মর্যাদা দিয়েছিলেন। আর এটি ছিলো সর্বোচ্চ মর্যাদা। এমন সম্মান এর আগে আর কাউকেই দেয়া হয় নি। সমুদ্র অভিযানগুলোতে রাজকীয় নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছিলো তাকে।

ঝেং-হের সমস্ত কাহিনীই খুব সাবধানে লিখে গিয়েছেন সে সময় তার সঙ্গে অবস্থানকারী চতুর্থ নৌবহরে নিয়োগ পাওয়া অনুবাদক ও লেখক মা-হুয়ান। তার লেখা থেকেই জানা গেছে বিস্ময় জাগানিয়া সে সব জাহাজের গল্প। ১৪১৩ সালের সেই অভিযানে ২৮ হাজার ৫৬০ জন মানুষ নিয়ে ৬৩টি জাহাজ রওয়ানা হয়েছিলো বাণিজ্যের জন্য।

অসংখ্য সমুদ্র বন্দরে ভিড়েছে ঝেং-হের জাহাজ, হয়েছে বাণিজ্যিক বিনিময়। বহু দামী জিনিসপত্র, লিনেন, পোর্সেলিন পাত্র ইত্যাদি; এমনকি অদ্ভূত সব গাছপালা এবং জীবিত প্রাণীও আদান-প্রদান হয়েছে এসব জাহাজের মাধ্যমে। আসলে বিষয়টা ছিলো কিছুটা মাফিয়াদের মতো; পরোক্ষভাবে মানুষকে জানান দেয়া যে, তাদেরকে সহযোগিতা করার বিনিময়ে সম্রাটের অধীনস্থতা তাদের মেনে নিতে হবে।

ঝেং-হের জীবদ্দশায় ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি মোট সাতটি সমুদ্র অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ভীষণভাবে সফল হয়েছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, কোনো এক অভিযানে বাংলায় এসেছিলো ঝেং-হের জাহাজ। কেউ কেউ বলেন, তিনি নিজেই এসেছিলেন; আবার কেউ কেউ বলেন, তার নৌবহরেরই অন্য কোনো জাহাজ এসে ভিড়েছিলো বাংলায়। আসল ঘটনা যেটাই হোক, ঝেং-হের জাহাজ যে বাংলায় এসেছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তা-ই নয়, বাংলার সুলতান সাইফুদ্দীন হামজা শাহ সেই জাহাজের মাধ্যমে চীনের ক্ষমতাধর মিং সম্রাটের জন্য উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন একটি জিরাফ। এই জিরাফ পরবর্তীতে সম্রাট ঝু-ডির সবচেয়ে পছন্দনীয় প্রাণীতে পরিণত হয়েছিলো।

চীনা চিত্রশিল্পী শেন দুর আঁকা বাংলার জিরাফ। ছবি: সংগৃহীত

ঝেং-হের জাহাজগুলো চম্পা, মালাক্কা, সুমাত্রা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি অনেকগুলো অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। সেসব সমুদ্র অভিযানে সম্মুখযুদ্ধে জলদস্যুদেরকে হারিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। একরকম বাধ্য হয়েই বশ্যতা স্বীকার করে নিতো বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা বিশাল এই নৌবহরের সামনে তাদের সম্রাটের প্রতি।

সম্রাট ইয়ংলে। ছবি: সংগৃহীত

ঝেং-হের অভূতপূর্ব ক্ষমতায়ন চীনের খোঁজা জনগোষ্ঠীর মাঝে এক নতুন আশার আলো দেখিয়েছিলো। দিনে দিনে ক্ষমতাবান হয়ে উঠছিলো তারা। কিন্তু চীনের রাজবংশীয়রা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে হয়েছিলো সংঘবদ্ধ। ১৪২৪ সালে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনাকালে অসুস্থ হয়ে মারা যান সম্রাট ঝু-ডি ইয়ংলে। আর এর মাধ্যমেই চীনের বাণিজ্যিক নৌ অভিযান শিথিল হওয়া শুরু করে। তখন সবেমাত্র ঝেং-হে তার ৬ষ্ঠ অভিযান শেষ করেছেন। চীনা রাজবংশীয়রা শুরু থেকেই এই নৌ অভিযানের বিরোধিতা করে আসছিলো। তাদের মতে, এভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা চীনের জন্য অপমানজনক। তবে আসলে এর পেছনে ছিলো আত্মঘাতী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, চিরতরে খোঁজাদের দমন করবার পরিকল্পনা করছিলো তারা।

চীনা খোজাকরণ; ছবি: সংগৃহীত

ঝু-ডির ছেলে সমুদ্র অভিযানের বিরোধিতা করেছিলো ঠিকই, কিন্তু এক বছর পরেই তার মৃত্যু হওয়ায় তার ছেলে সম্রাট জুয়ানডে দাদার ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে আবারো ঝেং-হেকে সমুদ্র অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এটিই ছিলো তার শেষ অভিযান। সেবার কালিকুটে ভিড়েছিলো ঝেং-হের জাহাজ। ১৪৩৩ সালে কালিকুট থেকে ফেরার পথে মাঝসমুদ্রে মারা যান ৬২ বছর বয়সী অসম বীর, সাহসী, প্রতিভাবান অ্যাডমিরাল ঝেং-হে। আর এর পরই সমুদ্র অভিযান বন্ধ তথা খোঁজাদের দমন করতে সক্ষম হন চীনা রাজবংশীয়রা। এই আড়ালে চলে যাওয়া কিন্তু চীনের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে নি, বরং এনেছিলো অসম্মান, উপহাস ও অনিরাপত্তা।

নানচিং শহরে চেং হো-র সমাধি, ছবি: সংগৃহীত

ঝেং-হের অবদানকে আজও ভুলতে পারে নি চীনবাসী। পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে বহু দেশ ঘুরে তিনি তৈরী করেছিলেন চীনের জন্য অঘোষিত এক কলোনি। অনেকে তো এ-ও বলেন যে, ক্রিস্টোফার কলোম্বাসেরও বহু আগে আমেরিকায় গিয়েছিলেন তিনি, যদিও এর কোনো স্পষ্ট দলিল নেই। তার সেই বিরাটকায় জাহাজগুলোর সমমানের জাহাজ তৈরী হয়েছিলো ২য় বিশ্বযুদ্ধেরও পরে। কলোম্বাসের জাহাজও তার জাহাজের সামনে নিতান্তই একটি খেলনা নৌকা। তাই আজও তার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় সর্বকালের সেরা, সফল ও মেধাবী অ্যাডমিরাল ঝেং-হেকে।

রেফারেন্সঃ

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...