যে কোন যুগেই ধর্মই ছিল সকল বিবাদের মূল কারণ। এখনো তাই আছে। বিভিন্ন সময়ের এই ধর্মযুদ্ধগুলো পৃথিবীতে নতুন নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের সবথেকে শান্তিপূর্ণ সময় ছিল মোরসের যুগে। মোরসরা ছিল আফ্রিকার এক যাযাবর জাতি। তারা ৮ম শতাব্দীতে স্পেন আক্রমণ করেছিল। তারা মুসলমান ছিল এবং স্পেনে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
সময়ের সাথে সাথে, মোরসরা দক্ষিণ স্পেনের কর্দোভায় উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। খেলাফত পতনের আগ পর্যন্ত তারা প্রায় তিন শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিল। মোরসরা যখন স্পেনের আলমোরাভিদদের হাতে ধরা পড়ে তখন স্পেনে আবার খ্রিস্টান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের ঐতিহ্যগুলি স্পেন থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে। কিন্তু প্রায় ৭০০ বছরের মোরস প্রভাব স্পেনের উপর একটি বিশেষ চিহ্ন রেখেছিল, যা পশ্চিম ইউরোপের বাকী অংশ থেকে স্পেনকে আলাদা করে তুলেছিল। সেই সময় ইতিহাসের কিছু সেরা ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছিল, যাদের আশ্চর্য সৃষ্টি এখনও আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন জিরিয়াব, যার অবদান আজও বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশন ডিজাইন, সংগীত, কবিতা, গ্যাস্ট্রোনমি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্বলজ্বল করছে।
জিরিয়াব ছিলেন নবম শতকের আরব পলিম্যাথ, যার সুন্দর কণ্ঠের জন্যে কৃষ্ণকোকিল নামে পরিচিত ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল বাগদাদে খলিফা হারুন – উর – রশিদের সময়ে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, জিরিয়াব আফ্রিকান অথবা কুর্দি বংশোদ্ভূত কৃতদাস ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। সেই সময় বাগদাদ ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। খলিফা ছিলেন সংগীতের অনুরাগী। তার সভার প্রধান শিল্পী ছিলেন ইসহাক – আল – মৌসুলি। আর জিরিয়াব ছিলেন তারই শিষ্য।
একবার খলিফার দরবারে জিরিয়াবের ডাক পরে। খলিফা তাকে তার গুরুর বাদ্যযন্ত্র ‘উদ’ বাজিয়ে গান গাইতে বলেন। কিন্তু জিরিয়াব ‘উদ’ বাজিয়ে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানান। সেই জায়গায় তিনি তার নিজের তৈরী একটি বাদ্যযন্ত্রে নিজের তোলা সুরে গান গেয়ে শোনান। খলিফা তার গান শুনে অত্যন্ত খুশি হন। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হন ইসহাকের প্রতি, কারণ এতদিন পর্যন্ত এই প্রতিভাকে ইসহাক লুকিয়ে রেখেছিলেন। জিরিয়াবের প্রতি খলিফার এই সুনজর ইসহাক ভালোভাবে নিতে পারেননি। ইসহাক তখন বেশ বুঝতে পারছিলেন জিরিয়াবের জন্য তার জায়গা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। তাই দেরি না করে তিনি জিরিয়াবকে বাগদাদ ছাড়তে বাধ্য করেন।
বাগদাদ ছাড়ার পর জিরিয়াব তিউনিসিয়া হয়ে স্পেনের আন্দালুসের দিকে যান। সেখানে তিনি রাজদরবারে প্রধান সংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ পান। ধীরে ধীরে তিনি আন্দালুসের সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সেখানে তিনি একটি গানের স্কুলও নির্মাণ করেছিলেন। সেই স্কুলটি আজও বিশ্বের সবার জন্য একমাত্র উন্মুক্ত গানের স্কুল হিসেবে পরিচিত। জিরিয়াব অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রায় দশ হাজার গান তার মুখস্ত ছিল। তিনি ‘নুবা’ নামক এক আন্দালুসীয় সঙ্গীতের সুরের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সুরের মিশ্রণ ঘটান, যা আজও সেখানে অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ রাগ সঙ্গীতের মতোই ২৪ ঘন্টার উপযোগী ২৪টি ‘নুবা’ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের চার্চের মিউজিককে জিরিয়াবের এই নুবাগুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে এই সঙ্গীত ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক নামে সকলের কাছে পরিচিত। বর্তমানে স্প্যানিশ গিটার তারই তৈরী বাদ্যযন্ত্র ‘উদ’ -এর পরিবর্তিত রূপ। তার এইসব সাফল্যের কারণে তাকে স্পেনের ইসলামিক সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
কিন্তু শুধুমাত্র গান নয়, তার পা পড়েছিল স্পেনের ফ্যাশন, হেয়ারস্টাইল, লাইফস্টাইল এর উপরেও। তিনিই প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে ইউরোপে দাবা খেলার প্রচলন করেন।
সেই সময় স্পেনে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো নিয়ম কানুন মানা হতো না। জিরিয়াবই প্রথম ফরাসিদের থ্রি – কোর্স মিল বা তিন ধাপে খাবার প্রচলন শুরু করেন। প্রথমে স্যুপ, তারপর মেইন ডিশ সবশেষে মিষ্টি জাতীয় খাবার। এই নিয়ম পরবর্তীতে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরে। শুধু তাই নয়, তিনি ডাইনিং টেবিলের সাথে চামড়ার চেয়ার, টেবিল ক্লথ ও কাচের গ্লাসের ব্যবহার শুরু করেন। তার উদ্ভাবিত খাবার আসপেরাগাস বা শতমূলী আজও জনপ্রিয়। ধারণা করা হয়, জনপ্রিয় খাবার জিলাপিও নাকি তারই সৃষ্টি।
জিরিয়াবকে বলা হয় আধুনিক ফ্যাশনের প্রবর্তক। আগে যখন শুধু গরমকাল ও শীতকালে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পড়ার প্রচলন ছিলো, সেখানে তিনি নানা ঋতুতে নানা রকম পোশাকের ফ্যাশন চালু করেন। শুধুমাত্র ভিন্ন ধরণের পোশাক নয়, সেইসব পোশাকের রং-ও তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। যেমন, গ্রীষ্মকালের জন্য সাদা রঙের পোশাক, বসন্তকালের জন্য উজ্জ্বল রঙের আর শীতকালের জন্য চালু করলেন গাঢ় রঙের উলের পোশাক।পরবর্তীতে তা ইউরোপের ফ্যাশন বলে পরিচিতি পায়। কাপড় পরিষ্কার করার পাউডার, দাঁত পরিষ্কার করার টুথপেস্ট, শরীরের দুর্গন্ধ দূর করার ডিওডোরেন্ট স্প্রে ইত্যাদি তারই সৃষ্টি। মেয়েদের লম্বা চুলকে ছোট করার ফ্যাশনও তার হাত ধরেই এসেছে। তার আবিষ্কৃত বিভিন্ন সুগন্ধি ও পরিষ্কার পোশাক পড়ার প্রচলন মেয়েদেরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল সেই সময়ে।
জিরিয়াব ছিলেন একজন সত্যিকার প্রতিভাবান মানুষ। তিনি সময়ের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। জিরিয়াবের প্রচলিত সবকিছুই যে তার উদ্ভাবিত এমনটা নয়। বরং তিনি বাগদাদ ও আন্দালুসের সংস্কৃতিকে এক করেছিলেন এবং সেইসব সংস্কৃতিতে যোগ করেছিলেন এক নতুন মাত্রা। তার মৃত্যুর পরে ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে আন্দালুসে ছুঁটে আসতো মানুষ আর যাওয়ার সময় নিয়ে যেত জিরিয়াবের চালু করা অভিনব জীবনযাত্রা। বর্তমান বিশ্বে অনেকেই জানেনা, যারা এই জীবনধারাকে ইউরোপের নিজস্ব সংস্কৃতি মনে করে, তা আসলে একজন মুসলমানের হাত ধরে এসেছে। ৬৮ বছর বয়সে এই উজ্জ্বল নক্ষত্র পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। কিন্তু আজও জিরিয়াব বেঁচে আছেন তার তৈরী জীবনধারা, ফ্যাশন ও জ্ঞান – বিজ্ঞানের মাঝে।