১৪৯২ সালের ১৭ই এপ্রিল, গ্রানাডা, স্পেন। রাজকীয় সভা চলছে আল-আন্দালুসের (Al-Andalus) আলহাম্বরা (Alhambra) রাজপ্রাসাদে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস উপস্থিত হয়েছেন স্পেনের রাজা ফার্দিনান্ড এবং রানী ইসাবেলার আমন্ত্রনে। আলহাম্বরা রাজপ্রাসাদের এই সভাতেই কলম্বাসের আমেরিকা অভিযান এবং তার জন্য অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। আজকের এই লেখা অবশ্য কলোম্বাস বা রানী ইসাবেলাকে নিয়ে নয়। এটি আসলে এই অতিথিরা যে প্রাসাদটিতে বসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, তার নির্মাণের নেপথ্যে যারা, তাদের উত্থানের বিস্ময়কর উপাখ্যান নিয়ে। স্পেনের তখনকার মুরস শাসকরা আলহাম্বরা রাজপ্রাসাদটি ইউরোপের বুকে প্রথম নির্মাণ করেছিল ৮৮৯ সালের দিকে অত্যন্ত ছোট আকারে। পরবর্তীতে, চৌদ্দশো শতাব্দীতে এটাকে পরিপূর্ণ রাজপ্রাসাদ হিসেবে রূপান্তরিত করে স্পেনের মুরস শাসকরাই। তখনকার নাসরিদ (Nasrid Dynasty) রাজত্বের শাসক মোহাম্মদ ইবনে ইউসুফ বেন নাসের (আলহাম্বরার নামেই বেশী পরিচিত) এই প্রাসাদকে প্রথম রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন। সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা, এবং নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে এটি সন্দেহাতীতভাবে এখনও বিশ্বের একটি বিস্ময়।
এই অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের মননকে প্রথমে সম্পৃক্ত করতে হবে উত্তর আফ্রিকা তথা ইসলামিক জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং দর্শনের গভীর মর্মার্থের সাথে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায় আমাদের সবার মনে, যারা এই চমৎকার নিদর্শনটি নির্মাণ করেছিলেন আসলে তাঁরা কারা, কি তাঁদের পরিচয়? কোথা থেকে এসেছিলেন এই বুদ্ধিদীপ্ত জনগোষ্ঠী ইউরোপকে সাতশো বছরের উপর শাসন করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে? এই স্মার্ট প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী মুরস (Moors) নামেই পরিচিত। মুরসরা আসলে উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের কিছু উপজাতির সমন্বয়ে একটি মুসলিম জাতি গোষ্ঠী। এদের ইউরোপ বিজয় এবং শাসনের রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীর উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাস বলে, মুসলিমদের ইউরোপ শাসনের প্রথম গোড়াপত্তন হয় ৬৫২ সালে বাইজান্টাইন সিসিলী (Byzantine) জয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই বিজয় ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাদেরকে বিতাড়িত হতে হয় ইউরোপ থেকে সহসাই। পরবর্তীতে, ৭১১ খীষ্টাব্দে সাত হাজার উত্তর আফ্রিকার মুরস অশ্বারোহী স্পেন এবং মরক্কোর মধ্যকার জিব্রাল্টার জলপথ অতিক্রম করে স্পেনের দক্ষিণাংশ দখল করে ফেলে। এই জিব্রাল্টারকে এক সময় ইউরোপ মনে করতো এটি আফ্রিকার সাথে তাদের একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা। কিন্তু মুসলিম তথা মুরসরা এই প্রতিরক্ষা-জলপথকে বানিয়ে ফেললো তাদের জন্য ইউরোপ প্রবেশের সহজ একটি হাইওয়ে! শুরু হলো বুদ্ধিদীপ্ত শক্তিশালী এক নতুন সভ্যতার ইউরোপ শাসনের সাতশো বছরের বর্ণীল উপাখ্যান। এই নতুন সভ্যতার মূল উৎপত্তি স্থল আরবের মরুভুমি। এই সভ্যতার মূলশক্তির ভিত্তিস্তম্ভ ঈশ্বর অনুপ্রাণিত একশ্বরবাদের উপর স্থির বিশ্বাস এবং আস্থা। মুরসরা ইউরোপের দক্ষিণাংশে আইবেরিয়া (Iberia) অঞ্চলে এমন একটি সমাজ তৈরি করেছিল, যা ছিল অত্যন্ত সম্পদশালী, শক্তিশালী, বৌদ্ধিকভাবে কৌতুহলী, জ্ঞানের প্রতি উৎসুক, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল। জানতে ইচ্ছে করছে না খুব, এই রোমাঞ্চকর ইতিহাসের যাত্রা কোথা থেকে? কে সে এই ইতিহাসের প্রথম সাহসী রচয়িতা?
আব্দাল রহমান-১ (Abd al-Rahman I) ছিলেন বৃহত্তর আইবেরিয়ার মুসলিম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মূলত পর্তুগাল এবং স্পেনের বিশাল এলাকাকে বলা হতো আইবেরিয়া। মুরসরা এই এলাকার নতুন নামকরণ করে আল-আন্দালুস (Al-Andalus)। আব্দাল রহমান ছিলেন দামেস্কের শাসক উমাইয়া রাজবংশের এক রাজপূত্র। তাঁর বয়স যখন উনিশ, ৭৫০ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী আব্বাসীয়রা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উমাইয়াদের দামেস্কের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে। আব্দাল রহমান তাঁর ভাই ইয়াহিয়া, চার বছরের ছেলে সুলায়মান, তাঁর মুক্ত দাস বেদর, আর বোনদের নিয়ে দামেস্ক থেকে পালিয়ে যান। আব্বাসীয়রা আব্দাল রহমানকে খুঁজতে সব জায়গায় অভিযান চালাতে লাগলো। সর্বস্ত লেলিয়ে দেওয়া হলো অসংখ্য অশ্বরোহী ঘাতক। আব্দাল রহমান বেদরকে নিয়ে ফিলিস্তান, সিনাই মরুভুমি, এবং মিশর হয়ে অনেক বিপদ-সংকুল পথ এবং চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ৭৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পৌঁছে যান স্পেনের আল-আন্দালুস এলাকার আলমুনেসে। স্পেনের মাটিতে আগে কখনো কোন উমাইয়া বংশের সদস্য পা ফেলেন নি।
আল-আন্দালুসের জনগণ তখন ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে থাকলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কারণ? আব্দাল রাহমানের নতুন ইসলামিক সমাজ ছিল প্রগতিশীল। এই সমাজের ছিল জ্ঞান, আর্থিক সম্মৃদ্ধি, আধুনিক সামাজিক নীতিমালা, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা। তিনি কর্ডোবাতে প্রবর্তন করেন আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা। এই কৃষিই আমূল পরিবর্তন করে ফেলে আল-আন্দালুসের আর্থিক অবস্থা, এনে দেয় অসীম ধন-সম্পদ। কৃষির অভূত উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবন করা হয় নতুন নতুন সব অভিনব কারিগরী কৌশল। ইউরোপে প্রথমবারের মতো শুরু হয় কাগজের উৎপাদন। কাগজ তো প্রথম আবিষ্কার করেছিল চীন, তাহলে তখনকার মুসলিমরা কাগজ উৎপাদনের জ্ঞান পেলো কোথা থেকে? স্পেনের মুসলিমরা কাগজ তৈরির কৌশল শিখেছিল চীনাদের কাছ থেকে, কারণ চীনের সাথে তাদের ছিল দীর্ঘ বাণিজ্যিক সম্পর্ক । এই অভূতপূর্ব আর্থিক উন্নয়নের অপরিসীম প্রভাব পরে জ্ঞান চর্চায়ও। নবম শতাব্দীতে ফ্রান্সের লাইব্রেরীগুলোতে যেখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৯০০, ঠিক একই সময়, শুধুমাত্র কর্ডোবার একটি লাইব্রেরীতেই পাঁচ লক্ষের উপর বই ছিল। শুধু তাই নয়, কর্ডোবাতে গড়ে উঠেছিল ৭০টি লাইব্রেরী। প্রতি বছর লেখা হতো ষাট হাজারের মতো পুস্তক।
ঐ সময় এই শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট। চিকিৎসা বিদ্যায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ কর্ডোবা থেকে পিছিয়ে ছিল কমপক্ষে চারশো বছর। সে সময়ের কর্ডোবার বিখ্যাত সার্জন আবু কাসিসের চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার সংগৃহীত চিকিৎসার লিখিত বর্ণনা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বব্যপী। কর্ডোবার বিখ্যাত মার্বেলের ৬০০ স্থম্ভবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন আব্দাল রহমান ৭৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে। পরবর্তীতে আল-আন্দালুসের মুসলিম শাসকরা এই এলাকাকে নিয়ে যায় সভ্যতার চরম এক শিখরে। বিশেষ করে আব্দুর রহমান-৩ মাত্র একুশ বছর বয়সে ৯১২ সালে কর্ডোবার শাসনভার নিয়ে স্পেনের উন্নয়নকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।
প্রায় তিনশো বছর স্পেনকে উন্নয়নের এক স্বর্ণ যুগে নিয়ে আব্দাল রহমানের মুরস শাসনের দুঃখজনক ইতি ঘটে একাদশ শতাব্দীতে। ১০৯৫ সালে স্পেনের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম ক্রুসেড ঘোষণা করে। খ্রীষ্টানরা আল-আন্দালুস আক্রমন করে স্পেনের উত্তর দিক থেকে। ধ্বংস করতে থাকে একের পর এক মুসলিম কীর্তি, পুড়িয়ে ফেলতে লাগলো সভ্যতার সব নিদর্শন, ভেঙে ফেলতে লাগলো কৃষির আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, শুরু হলো মুসলিমদের প্রতি জোরপূর্বক অন্যায় চাঁদাবাজি। তাদের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ালো “আমাদেরকে অর্থ দাও, নতুবা আমরা ধ্বংস করে ফেলবো তোমাদের সব।” এই অত্যাচার চললো পুরো একাদশ শতাব্দী ধরে।
পরের দুই শতাব্দী আল-আন্দালুসের দুর্বল মুসলিম শাসকরা টিকে থাকলো খ্রীষ্টান ক্যাথলিকদেরকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে। এ থেকে রক্ষা পেতে মুসলিম শাসকরা মরক্কো থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসলো নতুন এক মুসলিম বাহিনী। এই নতুন বাহিনীর ভিত্তি ছিল কট্ট্রর ইসলামিক চিন্তা ধারা। তারা আল-আন্দালুসের অভূতপূর্ব বিজ্ঞান এবং কৃষ্টির উন্নয়ন ভালোভাবে গ্রহণ করলো না। শুরু হলো আবার নতুন ভাবে ধ্বংসলীলা। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের লুন্ঠন এবং ধ্বংস চললো মুসলিমের উপর মুসলিমের।
এই লেখাটি আরম্ভ করা হয়েছিল ১৪৯২ সাল দিয়ে, ফিরে যাই আবার সেই ১৪৯২ সালে। খ্রীষ্টান ক্যাথলিকরা স্পেন সম্পূর্ণভাবে তাদের দখলে নেয় ১৪৯২ সালেই। দীর্ঘ বিরোধ এবং যুদ্ধবিগ্রহের পর, ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারী মুসলিমরা বাধ্য হয় আলহাম্বরা প্রাসাদ খ্রীষ্টানদের হাতে তুলে দিতে। শুরু হয় স্পেনে জাতিগত ধ্বংসের (Ethnic cleansing) এক অকল্পনীয় পরিকল্পনা। শুধু তাই নয়, ১৪৯২ সালে ৩১ মার্চে রানী ইসাবেলা ইহুদীদের স্পেন থেকে বিতাড়িত করার ডিক্রী জারি করে। পরের শতাব্দীতে তিন লক্ষ মুসলিমকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করা হয়, দশ লক্ষেরও বেশী আরবী মূল্যবান বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। মুসলিমদের সাতশো বছরের গৌরবময় অধ্যায়কে এক এক করে মুছে ফেলা হয় ইচ্ছাকৃত ভাবে। স্পেনে মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্ব এমনভাবে বিলুপ্ত করা হয় যাতে তাদের কোনো কীর্তি স্পেনে না থাকে। স্পেনের গল্প-উপন্যাস-সিনেমা মুরসেরকে উপস্থাপনা করা হয় ভিলেন রূপে। স্পেনে এখনো চলছে ইতিহাসকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার সিস্টেম্যাটিক অপচেষ্টা! দুঃখজনক!
তথ্য সূত্র:
* “When The Moors Ruled In Europe,” Channel 4 (UK), A documentary presented by Bettany Hughes, Directed by Timothy Copestake (2005).
* Irwin, Robert (2004). The Alhambra. Cambridge, MA: Harvard University Press.
* Alhambra Wikipedia.
ছবি:
* প্রথম দুটো ইমেজ ছাড়া, বাকী সবগুলো ইমেজ লেখকের।